ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ৩০০ কোটি টাকা দামের গোলরক্ষককে কতটা চেনেন

শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলে তাঁর যাত্রা শুরু ২০২০ সালে ক্লাব ব্রুগার হয়ে। ২০২৩ সালে তিনি যোগ দেন রয়্যাল আন্টওয়ার্পে। সেখান থেকে যোগ দিলেন ইউনাইটেডে। ইংলিশ ক্লাবটির সঙ্গে তাঁর চুক্তি ২০৩০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নতুন গোলরক্ষক সেনে লামেন্সছবি: এক্স

ইংলিশ ফুটবলে গ্রীষ্মকালীন দলবদলের শেষ দিন ছিল ১ সেপ্টেম্বর। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হাতে বিকল্প ছিল দুটি—এমিলিয়ানো মার্তিনেজ অথবা সেনে লামেন্স।

মার্তিনেজ আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী গোলকিপার, এক যুগের বেশি সময় ধরে আছেন ইংল্যান্ডে, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে অভিজ্ঞতায় টইটম্বুর। তাই সবার ধারণা ছিল, ৩৩ বছর বয়সী মার্তিনেজকেই অ্যাস্টন ভিলার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিতে চলেছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমগুলোও সেই ইঙ্গিত দিচ্ছিল।

কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে ইউনাইটেড নিয়ে এল মার্তিনেজের চেয়ে বয়সে ১০ বছরের ছোট সেনে লামেন্সকে; যাঁর ইংলিশ ফুটবলে খেলার অভিজ্ঞতা দূরে থাক; এখনো আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয়নি! বেলজিয়ামের এই গোলরক্ষক তাঁর দেশের বাইরে একেবারেই অপরিচিত ছিলেন।

সেই লামেন্সই পরশু ২ কোটি ১০ লাখ ইউরোর (প্রায় ৩০০ কোটি টাকা) বিনিময়ে স্বদেশি ক্লাব রয়্যাল আন্টওয়ার্প ছেড়ে ইউনাইটেডে নাম লেখানোর পর তাঁকে নিয়ে ফুটবলপ্রেমীদের আগ্রহ ও কৌতূহল বেড়েছে। ইউনাইটেড কেন তাঁকে প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক হিসেবে বেছে নিল—অনেকের মনে এমন প্রশ্নও জাগছে।

সেনে লামেন্সের জন্ম ২০০২ সালের ৭ জুলাই বেলজিয়ামের জোটেজেম শহরে। বয়সভিত্তিক ফুটবলে খেলেছেন কেআরসি বামব্রুগা, ডেন্ডার ও ক্লাব ব্রুগার যুব একাডেমি ক্লাব এনএক্সটিতে।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি করেছেন সেনে লামেন্স
ছবি: ফেসবুক

শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলে তাঁর যাত্রা শুরু ২০২০ সালে ক্লাব ব্রুগার হয়েই। ২০২৩ সালে তিনি যোগ দেন রয়্যাল আন্টওয়ার্পে। সেখান থেকে যোগ দিলেন ইউনাইটেডে। ইংলিশ ক্লাবটির সঙ্গে তাঁর চুক্তি ২০৩০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।

ক্যারিয়ারে এখনো কোনো ব্যক্তিগত অর্জন নেই লামেন্সের। দলীয় অর্জন বলতে দুটি—ক্লাব ব্রুগার হয়ে ২০২১ ও রয়্যাল আন্টওয়ার্পের হয়ে ২০২৩ সালে বেলজিয়ান সুপার কাপ জয়। খুব বেশি সাফল্য না থাকলেও গোলকিপিংয়ে তাঁর দ্রুত উন্নতি বেলজিয়াম ফুটবল–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নজর কেড়েছে। দেশটির ফুটবল অঙ্গন তাঁকে ‘থিবো কোর্তোয়ার উত্তরসূরি’ বা ‘পরবর্তী কোর্তোয়া’ ভাবছে।

লামেন্স গোলকিপার হিসেবে কেমন, সেই বর্ণনা দিয়েছিলেন মার্ক ফন বোমেল। বার্সেলোনার হয়ে ২০০৬ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা সাবেক এই ডাচ মিডফিল্ডারই আন্টওয়ার্পের কোচ থাকাকালীন লামেন্সকে ক্লাব ব্রুগা থেকে তাঁর দলে নিয়ে এসেছিলেন। ফ্লেমিশ সংবাদমাধ্যম হেট নিউসব্লাডকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফন বোমেল বলেছিলেন, ‘আমার কাছে সে অসাধারণ সম্ভাবনাময় একজন গোলরক্ষক। ভবিষ্যতে সে–ই বেলজিয়ামের গোলবার সামলাবে।’

সেনে লামেন্সকে থিবো কোর্তোয়ার উত্তরসূরি ভাবা হচ্ছে
ছবি: এক্স

লামেন্স আসার পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের গোলরক্ষকের সংখ্যা বেড়ে হলো চারজন। তিন গোলকিপার থাকতেও কোচ রুবেন আমোরিমের আরেকজনকে নিয়ে আসতে মরিয়া হয়ে ওঠার কারণ অনেকেরই জানা। গত মৌসুমে আন্দ্রে ওনানার একের পর এক শিশুতোষ ভুলের খেসারত ইউনাইটেডকে দিতে হয়েছে ম্যাচ হেরে অথবা ড্র করে।

আরও পড়ুন

এবারের প্রিমিয়ার লিগ মৌসুমের শুরুতে তাই ওনানাকে বসিয়ে তুর্কি গোলরক্ষক আলতায় বায়িন্দিরের ওপর আস্থা রেখেছিলেন আমোরিম। কিন্তু বায়িন্দির আস্থার প্রতিদান দিতে তো পারেনইনি, করেছেন এক সাংঘাতিক ভুল। লিগে নিজেদের প্রথম ম্যাচে আর্সেনালের কাছে ১–০ গোলে হারে ইউনাইটেড। গোল খাওয়ার পুরো দায় বায়িন্দিরের। ফুলহামের বিপক্ষে ১–১ ড্র ও সর্বশেষ বার্নলির বিপক্ষে ৩–২ গোলে জয়ের ম্যাচেও বায়িন্দিরকে খুব একটা আত্মবিশ্বাসী মনে হয়নি।

মাঝে ইংলিশ লিগ কাপের (কারাবাও কাপ নামে পরিচিত) ম্যাচে ওনানাকে খেলিয়েছেন আমোরিম। কিন্তু চতুর্থ স্তরের দল গ্রিমসবি টাউনের বিপক্ষেও ওনানার ভুলে একটি গোল খায় ইউনাইটেড। এমনকি ২৬ শটের টাইব্রেকারে পাঁচবার বল স্পর্শ করেও চারবারই গোল ঠেকাতে ব্যর্থ হন।

নতুন মৌসুমের শুরুতেই হাস্যকর ভুল করেছেন আন্দ্রে ওনানা। তাঁর ওপর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের আর আস্থা নেই
ছবি: এক্স

ইউনাইটেডের আরেক গোলরক্ষক টম হিটনের নাম ফুটবলপ্রেমীদের মনে থাকার কথা নয়। ২০২১ সালে ক্লাবটিতে যোগ দেওয়া হিটন চার বছরে খেলার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র তিন ম্যাচ! সর্বশেষ ম্যাচটা খেলেছেন ২০২৩ সালে। তবে ৩৯ বছর বয়সী হিটন তিন ম্যাচের একটিতেও গোল খাননি (ক্লিনশিট থেকেছেন)। এরপরও তাঁর মাঠে নামার সুযোগ না পাওয়ার কারণ বয়স। একান্তই প্রয়োজন না পড়লে তাঁকে হয়তো খেলাবেন না আমোরিম।

যেহেতু মার্তিনেজও ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে চলে এসেছেন, তাই ইউনাইটেড সম্ভাবনাময় তরুণ কাউকে প্রথম পছন্দের গোলকিপার হিসেবে বেছে নিতে চেয়েছে, যিনি লম্বা সময় দলকে সেবা দিতে পারবেন। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে শেষ পর্যন্ত সেনে লামেন্সকেই কিনেছে রেড ডেভিলরা।

আরও পড়ুন

ট্রান্সফারমার্কেটের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক (বেলজিয়াম) এবং ক্লাব ব্রুগার অনুসন্ধানী বিভাগের সাবেক সদস্য বার্ট টামসিন গত কয়েক বছর লামেন্সকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ওকে অনেক আগে থেকেই বেলজিয়ামে দুর্দান্ত প্রতিভা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সে সিমোন মিনিওলের (বেলজিয়াম জাতীয় দলের সাবেক ও ক্লাব ব্রুগার বর্তমান গোলকিপার) ছায়া হয়ে থাকতে চায়নি। এ কারণেই ২০২৩ সালের গ্রীষ্মে আন্টওয়ার্পে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।’

সেনে লামেন্সের শক্তিমত্তা এবং দুর্বলতা কী কী?

লামেন্সকে বেলজিয়ামে থিবো কোর্তোয়ার দীর্ঘমেয়াদি উত্তরসূরি হিসেবে দেখা হচ্ছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানও তাঁর সম্ভাবনা ও দক্ষতার জানান দিচ্ছে। তবে উন্নতির সুযোগও আছে।

বার্ট টামসিনের ভাষায়, ‘সে মানসিকভাবে ভীষণ শক্তিশালী এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে শান্ত থাকে। গত মৌসুমে সে নিজেকে প্রমাণ করেছে। জুপিলার প্রো লিগে (বেলজিয়ামের শীর্ষ লিগ) সে–ই সবচেয়ে বেশি গোল বাঁচিয়েছে। এ ছাড়া সে এমন এক গোলকিপার, যে সব সময় ফুটবলীয় সমাধান খোঁজে এবং বাঁ–ডান দুই পায়েই খেলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।’

ঝাঁপিয়ে পড়ে গোল ঠেকানোয় পারদর্শী সেনে লামেন্স
ছবি: এক্স

লামেন্সকে কোথায় উন্নতি করে হবে, সেটিও জানিয়েছেন টামসিন, ‘শীর্ষ পর্যায়ের গোলরক্ষক হতে চাইলে ওকে আরও নির্ভুল হতে হবে। প্রায় প্রতি ম্যাচেই ছোটখাটো ভুল করে বসে, যা আসলে অভিজ্ঞতার ঘাটতির কারণে হয়। যেমন—কিক নেওয়ার ক্ষেত্রে সে দুর্বল। কখনো কখনো এ কারণে গোল খেতে হয়। তা ছাড়া সে ভুল পাসও দিয়ে থাকে। এটা পরিস্থিতি ঠিকমতো বুঝতে না পারার কারণে হয়। তবে যেহেতু সে গত মৌসুমেই আন্টওয়ার্পের প্রথম পছন্দের গোলকিপার হিসেবে খেলেছে, তাই সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আরও অভিজ্ঞ হবে এবং উন্নতি করবে।’