বার্নের সেই অলৌকিক ফাইনাল শেষ হয়নি আজও

৫ জুলাই, ১৯৫৪। রোমানিয়ার ট্রানসিলভানিয়া।

অভিনেতাদের একটি দল যাত্রাপথে বিরতি নিয়েছে। জন্মভূমি হাঙ্গেরি ছেড়ে আসা মানুষের বসবাস সেখানে। অভিনেতাদের দলটি দেখতে পায়, সবার পরনে কালো পোশাক। তারা গ্রামবাসীর কাছে জানতে চাইল, ‘আপনারা শোক পালন করছেন কেন?’

ভিড়ের ভেতর থেকে এক বৃদ্ধা জবাব দিলেন, ‘আমরা গতকালের ম্যাচটি হেরেছি।’ অভিনেতাদের দলের ভেতর থেকে একজন সেই বৃদ্ধার কাছে জানতে চাইলেন, ‘জীবনে কখনো ফুটবল ম্যাচ দেখেছেন?’ বৃদ্ধা জবাব দিলেন, ‘না, দেখিনি।’

পাল্টা প্রশ্ন, তাহলে এত শোক কীসের?

ঘটনাটি এ পর্যন্ত বলে হাঙ্গেরির কিংবদন্তি রেডিও ধারাভাষ্যকার ও সাংবাদিক গিওর্গি সেপিসি চোখ মুছলেন। তারপর বললেন বাকিটা। কীসের শোক—এমন প্রশ্নের জবাবে সেই বৃদ্ধা সরল মনে বলেছিলেন, ‘এখানে সবাই বলাবলি করছিল, আমরা যদি আর একটি ম্যাচ জিতি, তাহলে হাঙ্গেরির সঙ্গে ট্রানসিলভানিয়া আবার মিলে যাবে; তখন আমরা হাঙ্গেরিতে ফিরে যেতে পারব।’

সেপিসির মুখে এই ঘটনা প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জার্মানির সাপ্তাহিক সাময়িকী ‘স্টার্ন’–এ।

২.

সেদিন আরেকজনের গল্প বলেছিলেন সেপিসি।

গুলা গ্রোসিচ—কালো জার্সি পরে মাঠে নামার অভ্যাস ছিল তাঁর। সেপিসি ডাকতেন ‘দ্য ব্ল্যাক প্যান্থার’। পরে গোটা হাঙ্গেরি সেই নামে ডেকেছে গোলকিপার গ্রোসিচকে। ৮৪ মিনিটে পশ্চিম জার্মানির হেলমুট রানের বাঁ পায়ের শট ঠেকাতে পারেননি। ছয় মিনিট পর শেষ বাঁশি বাজলে ওই গোলটা হাঙ্গেরির জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এরপর বলির পাঁঠা তো কাউকে না কাউকে বানাতে হবে! সে জন্য গ্রোসিচের চেয়ে আদর্শ (!) কে হতে পারেন! গ্রোসিচ নিজেও টের পেয়েছিলেন খড়্‌গ নেমে আসছে। ২০১৪ সালে মৃত্যুর আগে প্রায় প্রতিদিনই নাকি তিনি আত্মজিজ্ঞাসায় ডুবতেন, ‘বলটি কি ঠেকাতে পারতাম? ঠেকানো উচিত ছিল কি? (গোলটির পর) মাঠে সবচেয়ে নিঃসঙ্গ ব্যক্তিটি ছিলাম আমি। ম্যাচ শেষে বাকি জীবনেও সবচেয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি। ওই একটি ম্যাচ আমার জীবনকে তছনছ করে দেয়।’

১৯৫৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির স্ট্রাইকার হ্যানস শ্যাফারকে ঠেকাচ্ছেন হাঙ্গেরি গোলকিপার গ্রোসিচ
এএফপি

সে বছরের (১৯৫৪) ডিসেম্বরে গ্রোসিচের বিরুদ্ধে দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তোলেন সমাজতান্ত্রিক হাঙ্গেরির নীতিনির্ধারকেরা। কিন্তু কেউ তাঁকে বলেননি, কোন দেশের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন জন্মভূমির বিপক্ষে। কেউ তাঁর প্রতি এতটুকু করুণাও দেখাননি। ১৩ মাসব্যাপী সেই বিচারের পর প্রমাণের অভাবে মামলাটি খারিজ করা হলেও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নজরবন্দী হয়ে পড়েন গ্রোসিচ। বিচার চলাকালীন অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হওয়া নিষেধ ছিল তাঁর। বিচার শেষে তাঁর বাসার সামনে বসানো হয় কড়া পাহারা। ছাড়তে হয় জাতীয় দল (দুই বছরের জন্য), ছাড়তে হয় প্রাণের ক্লাব (হোনভেদ বুদাপেস্ট), জন্মভূমিতে আর কখনো এই ক্লাবের হয়ে খেলা হয়নি। চাকরি যায় তাঁর বাবার। গ্রোসিচের সন্তানদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল হাঙ্গেরি সরকার।

অথচ গ্রোসিচের গল্পটা ভিন্ন হতে পারত। বেঁচে থাকতে সেপিসিকে এটাই বলে গিয়েছিলেন, ‘আমরা যদি জিততে পারতাম, তাহলে আমি হোনভেদেই থাকতাম। বিচার বসত না। এই তিক্ততা সারা জীবন থাকবে আমার, সব সময়।’

আরও পড়ুন

৩.

একটি ম্যাচের কথা বলা হচ্ছিল। সেই ম্যাচে মাঠে গ্রোসিচদের উল্টো অর্ধে যারা ছিল, তারা তো জয়ী—মানে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি। তাদের অবস্থাটা কী হয়েছিল, সেটাও তো জানা প্রয়োজন।

হোর্স্ট একেল তখন ছিলেন পশ্চিম জার্মানির দলটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। খুব প্রতিভাবান কেউ ছিলেন না। তবে আর দশজন জার্মান যেমন হন, লড়াকু ও দৌড়াতে ওস্তাদ—শান্তশিষ্ট একেলও তেমনই ছিলেন। একটি ম্যাচ জিতে জার্মান ভূখণ্ডকে কেমন ওলটপালট করেছেন, একেল তা বুঝতে পেরেছিলেন জার্মানিতে ফেরার পথে এবং ফেরার পর, ‘আমরা (খেলোয়াড়দের বার্ন থেকে ফেরাতে বিশেষ ট্রেন) ট্রেনে ছিলাম এবং সিনজেনে ফেরার পর লোকজন যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল! কী যে উল্লাস সবার, হাজারে হাজারে মানুষ। আমরা যেখানেই (স্টেশন) থেমেছি, সেখানেই লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এর বাইরে কেউ জানালা খুলে দেখেছে, নারী–শিশু থেকে আবালবৃদ্ধবনিতা যারা জীবনে কখনো একটি ফুটবল ম্যাচও দেখেনি, তারাও ঘর থেকে বের হয়েছে আমাদের দেখার জন্য। কেউ বলেনি, ফুটবলাররা এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। সবাই বলেছে, আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, আমরা মানে জার্মানরা!’

একেলের যখন এই অভিজ্ঞতা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফল হিসেবে জার্মানি তখন পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্ত। কিন্তু জার্মানরা সেদিন পূর্ব–পশ্চিমে ভাগ হননি। একটি জয়ে একীভূত হয়েছিল গোটা জাতি। সে জয়ের মোড়কে জার্মান ও হাঙ্গেরিয়ান জাতির ভেতরে একটি পরিবর্তনের বীজও রোপিত হয়। বলা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হারের পর গোটা বিশ্বের সামনে মাথা হেঁট হওয়া জার্মানরা আবারও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখেছিল ওই একটি জয়ে। জার্মান ফুটবলের প্রয়াত ‘কাইজার’ (সম্রাট) ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের ভাষায়, ‘হঠাৎ করেই জার্মানি আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল।’

বেকেনবাওয়ারের এ কথার মর্মার্থ হলো, ওই একটি জয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনুশোচনা, ক্ষত এবং এ বিষয়ে আরও যা যা অনুভূতি হওয়া সম্ভব—সেসব মুছে জার্মানদের যেন পুনর্জন্ম হলো!

আর হাঙ্গেরি?

আরও পড়ুন

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদক জশ অ্যাশডাউন ২০১৮ সালে ওই ম্যাচ স্মরণে লিখেছিলেন, ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে সমাজতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে জনতার যে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, সেই দ্রোহের বীজটা বপন করেছিল আসলে হাঙ্গেরির সেই ‘সোনালি প্রজন্ম’। স্টার্নে লেখা হয়েছে, ওই হারের পর সুইজারল্যান্ডের বার্নের ওয়াঙ্কডর্ফ স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে হাঙ্গেরির কিছু সমর্থক ক্ষোভ দমন করতে না পেরে নাকি দোকানপাট ভাঙচুর করেছিলেন। আর বুদাপেস্টে ঘটেছিল লঙ্কাকাণ্ড। ভাঙচুর, বিদ্রোহে নরক গুলজার চলেছে কিছুদিন।

অ্যাশডাউন জানিয়েছেন, হারের পর বুদাপেস্টে ফিরতে হাঙ্গেরি ফুটবল দল কিছুদিন অপেক্ষা করেছে। সে কয়েক দিন তারা অবস্থান করেছে হাঙ্গেরির উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলের শহর তাতায়। হাঙ্গেরিয়ানদের ক্ষোভ প্রাথমিকভাবে প্রশমিত হওয়ার পর রাজধানীতে ফিরেছে ফুটবল দল। কিন্তু তুষের আগুনের মতো ভেতরে জ্বলেছে ধিকি ধিকি। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৩ লাখ হাঙ্গেরিয়ানকে সরকার বিচারের সম্মুখীন করেছিল। সাত লাখকে বিভিন্ন রায়ে শাস্তি দেওয়া হয়। এই জ্বালা সইতে সইতে বার্নে হৃদয় পোড়ার জ্বালা আর মেনে নিতে পারেননি হাঙ্গেরিয়ানরা। সে ধারাবাহিকতায়ই দুই বছর পর সংঘটিত হলো বিপ্লব, পরে যেটা নিষ্পেষিত হয়েছিল সাবেক সোভিয়েত ট্যাংকবহরের নিচে।

মিরাকল অব বার্নের পর জনতার কাঁধে পশ্চিম জার্মানির অধিনায়ক ফ্রিৎজ ওয়াল্টার। হাতে জুলেরিমে ট্রফি
ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ এক্স হ্যান্ডল

৪.

যে ম্যাচের কথা বলা হচ্ছে, এতক্ষণে আপনার বুঝে ফেলার কথা।

১৯৫৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল কিংবা জার্মান ভাষায় ‘দাস বুন্দার ফন বার্ন’—মিরাকল অব বার্ন।

অলৌকিক বিষয়টি আসলে জার্মানদের জন্য, সেটা মুদ্রার এক পিঠ। অপর পিঠেও আছে ‘বার্ন’—কিন্তু সেটা হাঙ্গেরিয়ানদের জন্য হৃদয় পোড়ার জ্বালা। কেন?
সহজ করে বলা যাক। ৭১ বছর আগের সেই ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির মুখোমুখি হওয়ার আগে চার বছরের বেশি সময় অপরাজিত ছিল হাঙ্গেরি ফুটবল দল। ১৯৫০ সালের জুন থেকে ১৯৫৪ বিশ্বকাপ শুরুর আগ পর্যন্ত অপরাজিত ছিল ৩১ ম্যাচ (১৯৫২ সালে পূর্ব জার্মানির সঙ্গে ম্যাচকে অফিশিয়াল ধরলে ৩২)। একসময় হাঙ্গেরির ডেপুটি ক্রীড়ামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা কোচ গুস্তাভ সেবেসের সে দলকে লোকে ডাকত ‘ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্স’ বা ‘মাইটি ম্যাগিয়ার্স।’ এখনো তা–ই বলা হয়।

এই দলের ‘গ্যালোপিং মেজর’খ্যাত ফেরেঙ্ক পুসকাস সে সময় বিশ্বের সেরা ফুটবলার। তাঁর সতীর্থ ন্যান্দর হিদেকুটি, জোসেফ বজচিক, স্যান্দর ককসিস, গ্রোসিচ, জোলতান চিবোররাও পুসকাসের চেয়ে কিছু কম ছিলেন না। এই ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনকেই হোনভেদ ক্লাবে পেয়েছিলেন সেবেস। পঞ্চাশ–ষাটের দশকের সেই হাঙ্গেরির প্রতাপ কেমন ছিল সেটা বোঝাতে একটি উদাহরণই যথেষ্ট। সে বিশ্বকাপে হাঙ্গেরিকে কিন্তু বাছাইপর্বে খেলতে হয়নি। দুই দলের বাছাইপর্বে পোল্যান্ড তাদের বিপক্ষে খেলেনি। কারণ? প্রতিপক্ষ দলের নাম হাঙ্গেরি, কোনো আশা নেই, তাই!

ফাইনাল শুরুর আগে হাত মেলাচ্ছেন দুই দলের অধিনায়ক। হাঙ্গেরির ফেরেঙ্ক পুসকাস (ডানে) ও পশ্চিম জার্মানির ফ্রিৎজ ওয়াল্টার
ফিফা মিউজিয়াম ফেসবুক পেজ

এ দলটাই সেদিন ফাইনালে পুসকাস ও চিবোরের গোলে ২–০ ব্যবধানে এগিয়ে গিয়েছিল ৮ মিনিটের মধ্যে। সেটা এমন এক দলের বিপক্ষে, যাদের পক্ষকাল আগেও ৮–৩ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল হাঙ্গেরি। আরও বড় পরিসরে বললে এমন প্রতিপক্ষ, চার বছর আগেও যাদের অস্তিত্ব ছিল না! (পশ্চিম জার্মানি দল গঠন হয় ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারিতে।)

খুব স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বকাপ (জুলেরিমে ট্রফি) জয়ের অপেক্ষায় ছিলেন হাঙ্গেরিয়ানরা। দেশে শাসকের অত্যাচার তাঁরা এত দিন ভুলে ছিলেন পুসকাস–হিদেকুটিদের ফুটবল–সৌন্দর্যে। আর বড়জোর ৮০ মিনিট। তারপরই স্বপ্নপূরণ! কিন্তু পরবর্তী ৮০ মিনিটে যা ঘটেছিল, তা জেনে ও বুঝে কেউ কেউ বলতেই পারেন, এটাই তো বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে সেরা কামব্যাক!

১০ মিনিটে ম্যাক্সিমিলিয়ানো মোরলক এবং তারপর ১৮ ও ৮৪ মিনিটে রানের গোলে ফাইনালটা শেষ পর্যন্ত জিতেছিল পশ্চিম জার্মানি। তাদের গোলকিপার তুরেক সেদিন সেভের পর সেভ করেছিলেন। হাঙ্গেরির একটি গোলও বাতিল হয়েছিল। আসলে কি ভাগ্যে ছিল?

এই প্রশ্নের উত্তরে আবারও পেছন ফিরে তাকাতে হয়।

৫.

ইউরোপের বেশির ভাগ দল তখন ইংল্যান্ডের ব্যাকরণসম্মত কৌশলে ফুটবল খেলার চেষ্টা করত। হাঙ্গেরিয়ানরা সে পথে হাঁটেননি। বল পায়ে অহর্নিশ পজিশন পাল্টে খেলার কৌশলে তাঁরা অজেয় হয়ে উঠেছিলেন। হেলসিঙ্কিতে অলিম্পিক ফুটবলে সোনা জিতে বুদাপেস্টে ফেরার পথে পুসকাসদের বরণ করেছিলেন প্রায় চার লাখ হাঙ্গেরিয়ান। পথে পথে থামাতে হয়েছিল ট্রেন। এমন অবিশ্বাস্য আত্মবিশ্বাসের স্ফুরণ ঘটেছিল তাঁদের মধ্যে যে বল পায়ে খেলার বাইরে তাঁরা ভেবেছেন খুব কমই।

বিশ্বকাপের আগে ১৯৫৩ সালের ২৫ নভেম্বর ইংল্যান্ডকে তাদেরই ঘরের মাঠে ওয়েম্বলিতে ৬–৩ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল হাঙ্গেরি। ইতিহাসে যা ‘শতাব্দীর সেরা ম্যাচ’। ঘরের মাঠে ৯০ বছর পর সেটাই প্রথম হার ইংল্যান্ডের, ওয়েম্বলিতে বিদেশি দলের প্রথম জয়ও। হাঙ্গেরি তখন গোটা বিশ্বের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত।

হাঙ্গেরি তারকা হিদেকুটির গোল
এএফপি

বিশ্বকাপে সেটাই হচ্ছিল। ‘ট্রেকুয়ার্তিস্তা’ পজিশনে হিদেকুটিকে খেলানো হাঙ্গেরির সামনে প্রতিপক্ষ দলগুলো স্রেফ উড়ে যাচ্ছিল! গ্রুপ পর্বে তাদের কাছে দক্ষিণ কোরিয়া হেরেছে ৯–০ গোলে। পরের ম্যাচ ছিল পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে এবং সে ম্যাচে কোচ সেপ হেরবের্জার ও অধিনায়ক ফ্রিৎজ ওয়াল্টারের কৌশলের কাছে মার খেয়ে যায় হাঙ্গেরি। না, হারেনি, জিতেছিল ৮–৩ গোলে। কিন্তু পশ্চিম জার্মানির আসল শক্তি হাঙ্গেরি যেন টের না পায় সে জন্য নিজেদের প্রথম ম্যাচের মাত্র চার খেলোয়াড়কে হাঙ্গেরির বিপক্ষে একাদশে রেখেছিলেন হেরবের্জার। মানে পুরো শক্তির দল মাঠে নামাননি। আর পশ্চিম জার্মানির ডিফেন্ডারদের লক্ষ্য ছিলেন পুসকাস। হাড়ে চিড় নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলারকে, যে কারণে ফাইনালে গোল করলেও আসল পুসকাসকে দেখা যায়নি।

আর ছিল বৃষ্টি। এ বিষয়ে ফ্রিৎজ ওয়াল্টারকে টানতেই হয়। ভদ্রলোক জার্মান ফুটবলের কিংবদন্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাইবেরিয়ার গুলাগ বন্দিশিবিরে মৃত্যু এড়াতে পেরেছিলেন স্রেফ ফুটবলার হওয়ার কারণে। পথিমধ্যে ইউক্রেনের বন্দিশিবিরে এক নিরাপত্তারক্ষী তাঁকে চিনে ফেলেন। সৌভাগ্যবশত বন্দীদের তালিকা থেকে তাঁর নামটা কাটা পড়ে। এই ফ্রিৎজ ওয়াল্টার ম্যালেরিয়ায় ভোগার কারণে রোদে ভালো খেলতে পারতেন না। কিন্তু বৃষ্টি নামলে তাঁর তুলনা ছিল না। ইনসাইড ফরোয়ার্ড কিংবা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে স্রেফ অবিশ্বাস্য। সেদিন ফাইনালেও বৃষ্টি নেমেছিল, হাঙ্গেরি তাতে অভ্যস্ত ছিল না। কিন্তু পশ্চিম জার্মানির তো পোয়াবারো! তাদের খেলোয়াড়দের পায়েও ছিল বৃষ্টি ও কাদায় খেলার উপযোগী নতুন একধরনের বুট—যেটার স্পাইক পাল্টানো যেত। বিরতির পর পশ্চিম জার্মানির খেলোয়াড়েরা নাকি বুটের কাদামাখা স্পাইক (দৌড়ে অসুবিধা হয়) পাল্টে মাঠে নেমেছিলেন।

বাকিটা স্কোরবোর্ডে, হাঙ্গেরিয়ান ও জার্মানদের হৃদয়ে। কেউ হয়েছেন ক্ষতবিক্ষত, কারও আবার বসন্ত।

পশ্চিম জার্মানির সেই বাসন্তিক আনন্দে কলঙ্কের দাগও লেগেছে।


৬.

বার্লিনের হামবোল্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে সেই ম্যাচ নিয়ে একটি গবেষণা চালিয়েছিলেন খেলাধুলার ইতিহাসবিদ ও লেখক এরিক এগার্স। তাঁর সেই গবেষণার ফল নিয়ে ২০১০ সালে বার্তা সংস্থা রয়টার্স একটি প্রতিবেদন করেছিল, যেখানে এগার্স বলেছেন, ‘জার্মানির কিছু খেলোয়াড় ভিটামিন সি নেওয়ার কথা বলে ইনজেকশনের মাধ্যমে পেরভিতিন নিয়েছিলেন, এর পক্ষে শক্তিশালী কিছু ইঙ্গিত আছে।’

পেরভিতিন ছিল শারীরিক শক্তিবর্ধক স্টিমুল্যান্ট, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার করেছে জার্মান সেনাবাহিনী। সে বিশ্বকাপে খেলোয়াড়দের ডোপ টেস্ট করা হয়নি। এগার্সের ভাষায়, ‘সন্দেহজনক বিষয় হলো, জার্মানির খেলোয়াড়েরা গোপনে এই ইনজেকশন নিজেদের মধ্যে বণ্টন করেছিলেন এবং যে একমাত্র কারণে ব্যাপারটি পরে জানাজানি হয়েছিল সেটা হলো, ইনজেকশন ব্যবহার করা সবার জন্ডিস হয়েছিল।’ এগার্সের পক্ষে সায় দিচ্ছে ইতিহাসও। পশ্চিম জার্মানির সেই দলের এক খেলোয়াড় জন্ডিসে ভুগে মারাও গেছেন। আর এগার্সের যুক্তি হলো, ভিটামিন সির প্রয়োজন হলে তাঁরা কমলাজাতীয় ফল খেলেই পারতেন।

আন্ডারডগ হিসেবে জয়ের উল্লাস পশ্চিম জার্মানির খেলোয়াড়দের
ফিফা ওয়েবসাইট

সে যা–ই হোক, ইতিহাস পশ্চিম জার্মানির সেই জয়কে মনে রেখেছে, অবিশ্বাস্য লড়াকু এক দলের জন্ম হিসেবে, যারা পরে আরও তিনবার বিশ্বকাপ জিতেছে। আর হাঙ্গেরি?
দেশটির সত্তর–আশির দশকের সাবেক মিডফিল্ডার তিবোর নিলাসি সাংবাদিক জোনাথন উইলসন ‘বিয়ন্ড দ্য কার্টেইন’ বইয়ে বার্নের সেই হার নিয়ে একটি মন্তব্য করেছিলেন, ‘ব্যাপারটা এমন যে ( হারের পর) হাঙ্গেরির ফুটবল সেই মুহূর্তেই আটকে রইল। সেখান থেকে আমরা আর কখনোই বের হতে পারিনি।’

হাঙ্গেরি আর কখনো, কোনো দিন বিশ্বসেরা দল হতে পারেনি।

অপেক্ষায় অপেক্ষায় ক্লান্ত ও হতাশ হতে হতে কোনো কোনো হাঙ্গেরিয়ান সেই হারকে এখন অভিশাপও মনে করেন। আসলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে হাঙ্গেরিয়ানরা সেই ফাইনাল থেকে এখনো বের হতে পারেননি। এখনো অঙ্ক কষা হয়, সেই ফাইনালে কী করলে ম্যাচটা জেতা যেত। অর্থাৎ হাঙ্গেরিয়ানদের সেই ফাইনাল শেষ হয়নি আজও।
৭১ বছর ধরে হাঙ্গেরিয়ানরা যে ফাইনাল খেলে যাচ্ছেন তার শুরুটা হয়েছিল আজকের দিনে।

আরও পড়ুন