মেসি যাঁর কারণে সাইকেল পাননি, তাঁকেই জার্সি দিলেন

মেসির সঙ্গে জার্সি বদল করছেন গালিন্দেজছবি: টুইটার

ফুটবলের সঙ্গে আর্জেন্টাইনদের ভালোবাসার সম্পর্ক যেন সেই সৃষ্টির শুরু থেকে। আর্জেন্টিনায় বিখ্যাত এক গল্প ‘অ্যান আর্জেন্টাইনস হেভেন’। সেই গল্পে কয়েক বন্ধু একদিন বারবিকিউ পার্টিতে জড়ো হয়ে ফুটবল নিয়ে আলাপ করতে করতে হঠাৎ লক্ষ করল, তারা সবাই মারা গেছে।

কিন্তু আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনা তাদের সবাইকে বিপুল আনন্দ দিচ্ছিল। কারণ, তাদের বিশ্বাস, যদি কোনো মানুষ পোড়া মাংস খেতে খেতে ফুটবল নিয়ে আলোচনা করে, তবে তারা স্বর্গেই আছে। আর্জেন্টাইনদের কাছে ফুটবল মানে যেন এমনই এক উৎসব। অথচ সেই দেশের মানুষ হয়েও এরনান গালিন্দেজ যেন একটু অন্য রকম। না হলে কি আর আর্জেন্টিনাকে বাদ দিয়ে খেলার জন্য ইকুয়েডরকে বেছে নেন!

আরও পড়ুন

আর্জেন্টিনায় জন্ম নিয়েও গালিন্দেজের কখনো দেশটির হয়ে খেলা হয়নি। তবে হাল ছেড়ে দেননি। খেলার জন্য তাঁর যে একটি সবুজ মাঠ হলেই চলত, তাই জাতীয়তাবাদের সীমানা ভেঙে বেছে নেন লাতিন আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরকে। দেশটির নাগরিকত্ব পান ২০১৯ সালে। ইকুয়েডর জাতীয় দলের হয়ে তাঁর অভিষেক হয় ২০২১ সালে। জাতীয় দলের তাঁর যখন অভিষেক হয়, তখন বয়স প্রায় ৩৫ ছুঁই ছুঁই।

এখন পর্যন্ত খেলেছেন ১৫ ম্যাচ। আর্জেন্টিনাকে বাদ দিয়ে ইকুয়েডরকে বেছে নেওয়া প্রসঙ্গে গালিন্দেজ বলেছেন, ‘আমি আর্জেন্টিনার চেয়ে গত ১০ বছরে এখানেই (ইকুয়েডরে) বেশি স্বচ্ছন্দ। এখানে বছরে আমি ৩৪০ দিন কাটাই। আমি আর্জেন্টিনায় যাই পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে আমি কিটোকে মিস করি। এই শহরের জীবনকে আমি উপভোগ করি।’

প্রশ্ন হলো, আজ হঠাৎ কেন গালিন্দেজকে নিয়ে এত আলোচনা? নিজ জন্মভূমির বিপক্ষে ইকুয়েডরের হয়ে গোলপোস্টে দাঁড়ানো বড় ঘটনা বটে। তবে এর আগে আরও দুবার এ কাজ করেছেন গালিন্দেজ। তবে তাঁকে আলোচনার কারণটা ভিন্ন। এর আগেও আলোচিত হয়েছে এই প্রসঙ্গ। হয়তো সামনে আরও হবে। অন্তত গালিন্দেজ যতবার মেসির মুখোমুখি হবেন, ততবার তো বটেই। যদিও আজ মেসির দুর্দান্ত ফ্রি–কিকে বল যখন জালে জড়াচ্ছিল তখন স্রেফ হাঁ হয়ে তাকিয়ে ছিলেন গালিন্দেজ। পুরো ম্যাচে হাইলাইট করার মতো একমাত্র দৃশ্য এটিই। এই গোলেই যে জেতে আর্জেন্টিনা। আর ম্যাচ শেষে জার্সি বদল করেছেন মেসির সঙ্গে।

আরও পড়ুন

মেসির সঙ্গে জার্সি বদল—সাম্প্রতিক সময়ে এ বিষয় নিয়ে আগ্রহ থাকে অনেকের। আর প্রায় প্রতিবারই মেসির সেই জার্সি বদলকে ঘিরে শোনা যায় নাটকীয় কোনো গল্প। এমনকি মেসির কাছ থেকে পাওয়া জার্সি ধুয়ে সমালোচিত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এবার গালিন্দেজের সঙ্গে মেসির জার্সি বদল করা নিয়ে সামনে এসেছে আরেকটি গল্প। গল্পটি নতুন না হলেও অনেকের অজানা তো বটেই। যে গল্পের শুরু ২৫ থেকে ৩০ বছর আগে, যখন এক বিন্দুতে গিয়ে মিলেছিলেন মেসি-গালিন্দেজ।

গোলের পর লিওনেল মেসি
ছবি: এএফপি

এবার শোনা যাক সেই গল্প। মেসির মতো গালিন্দেজের জন্মও রোজারিওতেই। একই বছর জন্মালেও মেসির চেয়ে গালিন্দেজ তিন মাসের বড়। দুজনই খেলতেন সাউথ জোনে। যেখানে মেসির ক্লাব ছিল নিউওয়েল’স ওল্ড বয়েজ আর গালিন্দেজ খেলতেন এস্ত্রেলা জুনিয়রসের হয়ে। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে দুজন একাধিকবার একে অপরের মুখোমুখি হয়েছিলেন।

যেখানে গালিন্দেজ নিজের জীবনের প্রথম গোলও হজম করেন মেসির কাছ থেকেই, তা–ও আবার একটি টুর্নামেন্টের ফাইনালে। যদিও সেদিন শেষ হাসি হেসেছিলেন এই গোলরক্ষকই। মেসি গোল করলেও সেই ফাইনালে মেসির দলকে হারিয়ে দিয়েছিলেন গালিন্দেজের দল। সেই টুর্নামেন্ট আরেকটি কারণে স্মরণীয়, সেদিন ট্রফির বদলে দেওয়া হয়েছিল ১০টি বাইসাইকেল। মেসিকে সেদিন বাইসাইকেল ছাড়াই মাঠ ছাড়তে হয়েছিল।

আরও পড়ুন

সেই ঐতিহাসিক ম্যাচে মেসির মুখোমুখি হওয়া নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে গালিন্দেজ বলেছিলেন, ‘সে ম্যাচের ডিভিডি আমার কাছে আছে, ম্যাচটিতে আমি বিধ্বংসী এক ফুটবলারের মুখোমুখি হয়েছিলাম। শিশু বয়সে তার ভেতরের অদম্য রূপটা আমি দেখেছি। কিন্তু এরপর সবাই যেমনটা জানে, ১২ বছর বয়সেই সে স্পেন চলে যায়। এরপর আমরা আর একে অপরের মুখোমুখি হয়নি।’

ইকুয়েডরের আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক এরনান গালিন্দেজ
ছবি: টুইটার

১২ বছর বয়সে মেসির স্পেনযাত্রা দিয়ে দুজনের যে বিচ্ছেদ, তা ইতিহাসের পথপরিক্রমা করে একই বিন্দুতে এসে প্রথম মিলেছিল ২০২১ সালের জুলাইয়ে। কোপা আমেরিকার কোয়ার্টার ফাইনালে ইকুয়েডরের মুখোমুখি হয়েছিল আর্জেন্টিনা। সেদিন ৩-০ গোলের জয়ে তৃতীয় গোলটি মেসি দিয়েছিলেন এমনই এক ফ্রি–কিক থেকে। সেই গোলের মধ্য দিয়ে মেসি নিয়ে নেন কয়েক দশক পুরোনো শৈশবের প্রতিশোধও।

এরপর বিশ্বকাপের বাছাইয়ের ম্যাচেও মুখোমুখি হয়েছিলেন তাঁরা। সেই ম্যাচে অবশ্য মেসি গোল পাননি। ইকুয়েডরের বিপক্ষে পাওয়া আর্জেন্টিনার ১-০ গোলের জয়ে লক্ষ্যভেদ করেছিলেন হুলিয়ান আলভারেজ। আর এবার ইকুয়েডর যখন বুয়েনস এইরেস থেকে পয়েন্ট নিয়ে ঘরে ফেরার স্বপ্ন দেখছিল, তখন জাদুকর মেসিই বদলে দেন গোটা দৃশ্যপট। তাঁর ফ্রি–কিক থেকে পাওয়া গোলেই বিশ্বকাপ বাছাইয়ে শুভসূচনা পেয়েছে আর্জেন্টিনা।