সেদিন বিকেল ৪টা ৩৩ মিনিটে পুড়েছিল গোটা ব্রাজিল

ব্রাজিলিয়ানদের হৃদয়ে সেই শোকের গভীরতা পাতালপুরীর মতো। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহন করেছে এই শোক। ব্রাজিলের কিংবদন্তি ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার নেলসন রদ্রিগেজ একবার বলেছিলেন, ‘সব জায়গাতেই জাতীয় বিপর্যয় আছে, যেটা অমোচনীয়, হিরোশিমার মতো। আমাদের বিপর্যয়, আমাদের হিরোশিমা হলো ১৯৫০ সালে উরুগুয়ের বিপক্ষে হার।’

ব্রাজিলিয়ানদের কাছে সেই হারের অপর নাম ‘মারাকানাজ্জো’। কেউ কেউ ‘ও মারাকানাকো’ও বলেন। পর্তুগিজ ভাষা থেকে ইংরেজিতে অর্থ দাঁড়ায় ‘দ্য মারাকানা ব্লো’—বাংলায় যা মারাকানার আঘাত বা বিপর্যয়। আদতে সেটা ১৯৫০ বিশ্বকাপে চার দলের চূড়ান্ত গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ। যেটা আসলে অলিখিত ফাইনাল এবং ড্র করলেই চ্যাম্পিয়ন হতো ব্রাজিল। কিন্তু দুই লাখের বেশি ব্রাজিলিয়ান সমর্থকের উপস্থিতিতে মারাকানায় উরুগুয়ের বিপক্ষে সেদিন ২–১ গোলে হেরেছিল সেলেসাওরা।

আরও পড়ুন

মানুষ অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে হয় পাথর। পাথর হয়ে চেপে বসা সেই হার ব্রাজিলিয়ানরা এখনো ভুলতে পারেননি। একটি ঘটনা বললে সেই হারের ক্ষতের গভীরতা আন্দাজ করে নিতে সুবিধা হতে পারে। ব্রাজিলের লেখক অ্যালেক্স বেলোজ যা বর্ণনা করেছেন তাঁর ‘futebol’ বইয়ে। সেই ম্যাচে উরুগুয়ের দ্বিতীয় গোল করা আলসিদেস ঘিঘিয়া ২০০০ সালে গিয়েছিলেন রিওতে। বিমানবন্দরের কাস্টমসে অল্প বয়সী তরুণী কর্মকর্তার কাছে পাসপোর্ট দেওয়ার পর তিনি সেটা কিছুক্ষণ দেখে জানতে চান, ‘আপনি কি সেই ঘিঘিয়া?’

২০০৯ সালে মারাকানায় নিজের পায়ের ছাপ দেন ঘিঘিয়া
রয়টার্স

উরুগুয়ে কিংবদন্তি একটু বিস্মিত। তরুণী মেয়েটির বয়স অনেক কম। সেই হার হয়তো তাঁর জানা থাকতে পারে, কিন্তু ঘিঘিয়ার নামটা মনে রাখা বিস্ময়কর। ‘হ্যাঁ, আমিই সে’ বলে ঘিঘিয়া মেয়েটিকে বলেছিলেন, ‘১৯৫০ তো অনেক আগের কথা।’ মেয়েটি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ব্রাজিলে আমরা প্রতিদিনই এটি হৃদয়ে অনুভব করি।’

ঘিঘিয়ার সেই ঘটনার ১৪ বছর পর থেকে কোনো কোনো ব্রাজিলিয়ান চাইলে মেয়েটির এই দাবির সংশোধনী দিতে পারেন। কারণ, ২০১৪ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের পর থেকে ব্রাজিলিয়ানদের হৃদয়ে জায়গা করে নেয় মারাকানাজ্জোর মতোই আরেকটি গভীর ক্ষত—মিনেইরাজো; জার্মানির কাছে ৭–১ গোলের সেই হার!

কী হয়েছিল সেদিন

১৯৫০ বিশ্বকাপের ফরম্যাট আগে জেনে রাখা ভালো। এটাই একমাত্র বিশ্বকাপ, যেখানে ফাইনাল ছিল না। ১৩ দলের সেই টুর্নামেন্টে গ্রুপ ছিল চারটি। প্রতিটি গ্রুপ থেকে শীর্ষ চার দল নিয়ে চূড়ান্ত একটি গ্রুপ বানানো হয়, যেখানে সবাই একে অপরের মুখোমুখি হয়। এ গ্রুপেরই ব্রাজিল–উরুগুয়ে শেষ ম্যাচটি হয়ে দাঁড়ায় শিরোপা নির্ধারণী। সমীকরণ ছিল এমন—ব্রাজিল ড্র করলে চ্যাম্পিয়ন, উরুগুয়েকে জিততে হবে।

অলিখিত সে ফাইনাল নিয়ে ব্রাজিলিয়ানদের তুমুল আগ্রহের কারণও ছিল। ফুটবল নিয়ে তাঁদের আবেগ এমনিতেই বাকিদের চেয়ে একটু আলাদা। তার ওপর ছিল স্বাগতিক এবং নিরঙ্কুশ ফেবারিট। কেন ফেবারিট সেটাও বলতে হয়। ৮ ম্যাচে ৪৬ গোল করে আগের বছর কোপা আমেরিকা জিতেছিল ব্রাজিল। উরুগুয়ে তাদের কাছে হজম করেছিল ৫ গোল।

উরুগুয়ে তখন আটবার কোপাজয়ী ও একবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলেও ব্রাজিলের ব্যাপারটা আলাদা ছিল। আদেমির, জাইর, নিল্টন স্যান্টোস, জিজিনিওদের নিয়ে গড়া দলটি এমনিতেই সে সময় বিশ্বের অন্যতম সেরা ছিল। এর পাশাপাশি নিজেদের আঙিনায় বিশ্বকাপ, যেখানে ব্রাজিলের প্রতিটি ম্যাচই হয়ে উঠেছিল জাতীয় উৎসব। আর সে বছরই খুলে দেওয়া হয়েছিল ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের ‘স্পিরিচুয়াল হোম’ এবং তখনকার বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম মারাকানা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম সেই বিশ্বকাপটা তাই ব্রাজিলিয়ানদের জন্য সব দিক থেকেই ছিল উৎসবের উপলক্ষ। সেটাই চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল ব্রাজিল–উরুগুয়ে ম্যাচের আগে। কিন্তু কে জানত, সেদিন বিকেল ৪টা ৩৩ মিনিটে তাঁদের জন্য অপেক্ষায় ছিল শেক্‌সপিয়ারের ট্র্যাজেডি!

আরও পড়ুন

চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন ব্রাজিলিয়ানরা। শুরু হয়েছিল আগাম উদ্‌যাপন। রিও ডি জেনিরোর সংবাদমাধ্যম ‘ও মুন্দো’ উরুগুয়ে ম্যাচের দিন আদেমিরদের ছবি ঢাউস করে ছেপে ঘোষণা দেয়—‘দিজ আর দ্য চ্যাম্পিয়নস’। জয় ধরে নিয়েই খেলোয়াড়দের আগাম স্যালুট জানিয়ে রিও ডি জেনিরোর মেয়র বলেছিলেন, ‘তোমরা খেলোয়াড়েরা আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবে...এ গোলার্ধে তোমাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।’ বিজয়ীদের সংবর্ধনা দিতে লেখা হয়েছিল নতুন গানও, তৈরি ছিল ব্যান্ড পার্টি। খেলোয়াড়দের নামাঙ্কিত স্মারক মুদ্রাও নাকি ছাড়া হয়েছিল!

১৯৫০ বিশ্বকাপে ব্রাজিল–উরুগুয়ে ম্যাচের একটি মুহূর্ত
ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ এক্স হ্যান্ডল

আর উরুগুয়ে? ব্রাজিলিয়ানদের প্রস্তুতির বহর দেখে দেশটির রাজনৈতিক নেতারা নাকি ভড়কে গিয়েছিলেন। ২০১৪ বিশ্বকাপের সময় মারাকানাজ্জো স্মরণ করে ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছিল, ম্যাচ শুরুর আগে উরুগুয়ে দূতাবাস থেকে কয়েকজন কর্মকর্তা ঘিঘিয়াদের ড্রেসিংরুমে ঢুকে অধিনায়ক ওবদুলো ভ্যারেলাকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘হারের ব্যবধান যেন কোনোমতেই ৬ গোলের না হয়। ৪ পর্যন্ত আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে সন্তুষ্ট!’

‘ব্ল্যাক চিফ’ নামে উরুগুয়ে ফুটবলে পরিচিত সেন্টারব্যাক ভ্যারেলা সতীর্থদের বলেছিলেন উল্টোটা। আক্রমণাত্মক খেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কানায় কানায় পূর্ণ (অফিশিয়ালি ১ লাখ ৭৩ হাজার ৮৫০ দর্শক, তবে গার্ডিয়ানের দাবি সংখ্যাটা ২ লাখ ১০ হাজারের বেশি) গ্যালারি দেখে সতীর্থদের ভ্যারেলা বলেছিলেন, ‘ভেবো না, গ্যালারির কেউ খেলবে না।’

বেলা তিনটায় শুরু হলো ম্যাচ।

ম্যাচে ব্রাজিল এগিয়ে গিয়েছিল আগে
ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ এক্স হ্যান্ডল

প্রথমার্ধে গোলশূন্য ছিল দুই দল। ব্রাজিলিয়ানদের উৎসবের মেজাজ তখন কেবল চড়তে শুরু করেছে। সে ম্যাচে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল, বাজি–পটকা ফোটাতে পুলিশ নিষেধ করলেও ব্রাজিলিয়ানরা মানেননি। কিছুক্ষণ পরপর ধোঁয়ায় ছেয়ে যাচ্ছিল মারাকানার আকাশ। বিরতির পর ৬৬ মিনিটে উরুগুয়ে মিডফিল্ডার আলবার্তো শিয়াফিনোর গোলেও আনন্দে ভাটা পড়েনি। কিন্তু নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ১১ মিনিট আগে সবকিছু চুপসে গেল ফাটা বেলুনের মতো।

আরও পড়ুন

ডান প্রান্তে বল পেয়েছিলেন উরুগুয়ের উইঙ্গার আলদাইস ঘিঘিয়া। ব্রাজিলের লেফটব্যাক বিগোদাকে কাটিয়ে এগোচ্ছিলেন। সবাই ভেবেছিল, ঘিঘিয়া বক্সে ক্রস করবেন। আন্দাজ করতে পেরে পজিশন থেকে একটু সরে যান ব্রাজিলের গোলকিপার মোয়াকির বারবোসা। এ ভুলটাই তাঁকে কুরে কুরে খেয়েছে বাকি জীবন। ঘিঘিয়ার শট বারবোসার বাঁ পাশে একচিলতে ফাঁকা জায়গা দিয়ে ব্রাজিলের জালে! নৈঃশব্দ্যের নাকি কোনো আওয়াজ হয় না। সেদিন বিকেল ৪টা ৩৩ মিনিটে ঘিঘিয়া সম্ভবত সেটাও শুনেছিলেন!

পরে সেই গোল ও মারাকানার নৈঃশব্দ্য নিয়ে ঘিঘিয়ার মন্তব্য কত জায়গায় কতভাবে ব্যবহার করা হলো—‘মাত্র তিনজন মানুষ মারাকানাকে পুরোপুরি স্তব্ধ করে দিতে পেরেছে। পোপ, ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা এবং আমি।’

ব্রাজিল তাঁর ওই গোলের পর আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি। ব্রাজিলিয়ানরাও স্বাভাবিক হতে পারেননি। গোটা ব্রাজিলে সেদিন সে সময় মাত্র কয়েকজন মানুষ হেসেছিলেন—মারাকানার গ্যালারিতে কাঁচুমাঁচু হয়ে বসা ১০০ উরুগুয়ে সমর্থক!

ব্রাজিলের পুরোনো সংবাদপত্র ও ব্লগ ঘেঁটে জানা যায়, শেষ বাঁশি বাজার পর দু–একজন মারাকানার ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন, কেউ কেউ হয়তো সফলও (!) হন। স্টেডিয়ামেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন শতাধিক মানুষ। ফিফার তখনকার সভাপতি জুলেরিমে ট্রফি তুলে দিতে যাওয়ার সময় তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশরাও হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। বাইরে লেগে যায় দাঙ্গা–হাঙ্গামা। রাতে শোনা গেল, রিওতে কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছেন।

মারাকানা স্টেডিয়াম যার নামে তৈরি—মারিও ফিলহো (পেশায় সাংবাদিক) তাঁর কলামে লিখেছিলেন, ‘শহরের প্রতিটি ঘরের জানালা বন্ধ ছিল। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে চাপা কান্নার আওয়াজ শোনা যেত। মনে হচ্ছিল, ব্রাজিলিয়ানরা তাদের সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে হারিয়েছে। সম্মান ভূলুণ্ঠিত হওয়ার নির্মম বেদনা কেউ সইতে পারেনি।’

মর্মান্তিক সেই সময়ে ব্রাজিলিয়ানদের মনে এই বিশ্বাসটুকু ধ্রুব হয়ে যায়—ব্রাজিল আর কখনো, কোনো দিন বিশ্বকাপ জিততে পারবে না।

কে এই ঘিঘিয়া

ব্রাজিলিয়ানদের কাছে ঘিঘিয়ার পরিচয় কেমন, সেটা তো আগেই বলা হয়েছে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত গোলটি করা ছাড়াও ফুটবলার ঘিঘিয়ার অন্য সব পরিচয়ও বেশ সমৃদ্ধ। উরুগুয়ের হয়ে ১৯৫০–১৯৫২ পর্যন্ত খেলে ১২ ম্যাচে করেছেন ৪ গোল। উরুগুয়ের বিখ্যাত ক্লাব পেনারোল ও দানুবিওতে খেলার পাশাপাশি ইতালির এএস রোমা ও এসি মিলানেও খেলেছেন। সিরি আ জয়ী ঘিঘিয়া রোমায় খেলার সময় ইতালিয়ান নাগরিকত্ব পান এবং তাদের জাতীয় দলের হয়ে পাঁচ ম্যাচ খেলে একটি গোল করেছিলেন।

আলসিদেস ঘিঘিয়া (১৯২৬–২০১৫)

মারাকানার সেই ম্যাচে ঘিঘিয়া যেদিন গোল করেছিলেন, ৬৫ বছর পর সেই একই দিনে মারা যান তিনি। ২০১৫ সালে মৃত্যুর আগে ঘিঘিয়া ছিলেন, বেঁচে থাকা সবচেয়ে বেশি বয়সী বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। শুধু তা–ই নয়, ১৯৫০ বিশ্বকাপে সেই ম্যাচের দুই দলের স্কোয়াডের মধ্যে সর্বশেষ জীবিত খেলোয়াড় ছিলেন ঘিঘিয়া।

২০০৯ সালে ঘিঘিয়াকে দেশে উড়িয়ে এনে সম্মান জানিয়েছিল ব্রাজিল। মারাকানায় পেলে, ইউসেবিও, ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের পাশে তাঁর পায়ের ছাপও যত্ন করে রাখা হয়। অথচ এই ভদ্রলোকের সেই গোলকে অনেকেই বিবেচনা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে—যেটা আসলে ব্রাজিল কিংবা ব্রাজিলিয়ানরা। আর ঘিঘিয়ার বাঁ পা রূপক অর্থে যেন ঘাতকের বন্দুক। বুলেট বের হওয়ার পর যেমন ধোঁয়া ওড়ে, সেদিন ঘিঘিয়া গোলের ওই শট নেওয়ার পর মারাকানার মাটিতেও ধুলো উড়েছে।

বারবোসা: নিঃসঙ্গতার ৫০ বছর

মারাকানাজ্জো নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হওয়া ব্যক্তিটি মোয়াকির বারবোসা।

সে ম্যাচের পর বারবোসা আরও ৫০ বছর বেঁচে ছিলেন। ২০০০ সালের ২৭ মার্চ মৃত্যুর আগে কয়েক বছর ভীষণ নিঃসঙ্গ ও একাকী জীবন কেটেছে বারবোসার। স্ত্রী না–ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন আগেই। কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েছিলেন তিনি। বাড়ি পর্যন্ত হাতছাড়া হয়। ভাস্কো দ্য গামার কিংবদন্তি হওয়ায় ব্রাজিলিয়ান ক্লাবটি থেকে মাসিক একটি ভাতা পেতেন, তাতে ঘরভাড়া জুটেছে। বারবোসা মারা যাওয়ার পরদিন ব্রাজিলের এক সংবাদমাধ্যম শিরোনাম করেছিল, ‘বারবোসার দ্বিতীয় মৃত্যু’।

প্রথম মৃত্যুটা আপনি জানেন। ঘিঘিয়ার সেই গোলের জন্য ব্রাজিলিয়ানদের কাছে বাকি জীবনভর অপমান–অপদস্থ হতে হয়েছে বারবোসাকে। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে এক সাক্ষাৎকারে যা বলেছিলেন, সেটা ব্রাজিল সমর্থকদের হৃদয় এফোঁড়–ওফোঁড় করতে পারে, ‘ব্রাজিলে যেকোনো অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ৩০ বছর। কিন্তু ৫০ বছর ধরে আমি এমন এক অপরাধের শাস্তি পাচ্ছি, যেটা করিনি। এমনকি অপরাধও সাজা খাটলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। কিন্তু আমাকে কেউ কখনো ক্ষমা করেনি।’

মোয়াকির বারবোসা
উইকিপিডিয়া

বারবোসা তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় কষ্টের কথাও বলে গেছেন—একবার এক নারী বারবোসাকে দেখিয়ে তাঁর বাচ্চা মেয়েকে বলছিলেন, ‘এই লোকটি গোটা ব্রাজিলকে কাঁদিয়েছিল।’

অথচ বারবোসা ছিলেন চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে বিশ্বের অন্যতম সেরা গোলকিপার। বলের স্পর্শ পেতে খালি হাতে গোলকিপিং করতেন। তিনিই প্রথম ব্রাজিলের স্থায়ী কৃষ্ণাঙ্গ গোলকিপার। ভাস্কোর হয়ে ৬৮৩ ম্যাচ খেলা এ গোলকিপার ১৯৫০ বিশ্বকাপের ওই ম্যাচের পর জাতীয় দলের হয়ে আর একটি ম্যাচই খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন, সেটা ১৯৫৩ সালে। হাঁটু ভেঙে নেন তারপর, আর খেলা হয়নি জাতীয় দলে। গ্লোবো জানিয়েছে, পেশাদার ফুটবল ছাড়ার পর মারাকানার প্রশাসনিক দপ্তরে কিছুদিন কাজ করেছেন বারবোসা।

১৯৯৪ বিশ্বকাপ সামনে রেখে তার আগের বছর দল যখন প্রস্তুতিতে, বারবোসা তখন দুঙ্গাদের অনুশীলন দেখতে চেয়েছিলেন। অভিশপ্ত বারবোসার উপস্থিতিতে পাছে দুর্ভাগ্য পেয়ে বসে দলকে—এই ভয়ে তাঁকে জাতীয় দলের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি।

তবে ব্রাজিলেরই অন্য সংবাদমাধ্যম ২০১৪ বিশ্বকাপে জানিয়েছিল, মাঠের গ্রাউন্ড স্টাফ হিসেবে চাকরি পেয়েছিলেন বারবোসা। ভেবে দেখুন তো, এক থেকে দেড়–দশক ধরে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার কিনা পেশাদার ফুটবল ছাড়ার পর কাজ করেছেন মাঠকর্মীদের সঙ্গে! সে জায়গাতেও ঠাট্টার শিকার হতে হয়েছিল বারবোসাকে। ১৯৬৩ সালে মারাকানার মাঠকর্মীদের পক্ষ থেকে তাঁকে ওই মাঠেরই একটি গোলপোস্টের আদলে কাঠের ভাস্কর্য উপহার দেওয়া হয়েছিল। অপমানে ও ক্ষোভে বারবোসা তা বাসায় এসে পুড়িয়ে ফেলেছিলেন।

সেই ম্যাচের পর প্রথম কয়েক বছর বারবোসার সঙ্গে নাকি কেউ কথা বলতেন না। পানশালায় তাঁকে দেখলে সবাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠতেন। বিবিসি তাঁকে আন্তর্জাতিক ম্যাচের ধারাভাষ্যকার হিসেবে নিয়েছিল। কিন্তু ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশনের (সিবিএফ) তৎকালীন সভাপতি রিকার্ডো টিসেইরা তাঁকে ধারাভাষ্য দিতে দেননি। এমনকি ১৯৯৪ বিশ্বকাপ সামনে রেখে তার আগের বছর দল যখন প্রস্তুতিতে, বারবোসা তখন দুঙ্গাদের অনুশীলন দেখতে চেয়েছিলেন। অভিশপ্ত বারবোসার উপস্থিতিতে পাছে দুর্ভাগ্য পেয়ে বসে দলকে—এই ভয়ে তাঁকে জাতীয় দলের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি।

আরও পড়ুন

পাঠকের জন্য তথ্য

মারাকানায় সেই হারের পর গোটা ব্রাজিলের নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া ছুঁয়ে গিয়েছিলে উরুগুয়ে অধিনায়ক ভ্যারেলাকে। ফাইনালের পর সারা রাত এক পানশালায় কাটিয়ে দেন উরুগুয়ের অধিনায়ক। খুন হয়ে যেতে পারেন, এই ভয়ে তাঁর কোনো সতীর্থই সেদিন ব্রাজিলের রাস্তায় বের হননি। দেশে ফেরার পর পুরস্কার বাবদ প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে আরেকজনের ব্যবহার করা ‘ফোর্ড–৩১’ মডেলের গাড়ি কিনতে পেরেছিলেন ভ্যারেলা। তবে শেষ জীবনে ভ্যারেলাকে ভুগতে হয় চরম দারিদ্র্যে। বেঁচে থাকতে তাঁর দায়িত্ব কেউ না নিলেও শেষকৃত্যের খরচটা ঠিকই দিয়েছিল উরুগুয়ে সরকার।

মারাকানায় সেদিন শেষ বাঁশি বাজার পর স্টেডিয়ামের ধারাভাষ্যকার এতটাই হতবাক ছিলেন যে সাও পাওলোয় তখন শেষ হওয়া স্পেন–সুইডেন ম্যাচের ফল ঘোষণা করতে ভুলে গিয়েছিলেন। ১৬৯ জন ব্রাজিলিয়ান হিস্টিরিয়ার শিকার হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন স্টেডিয়ামেই। ছয়জনকে মুমূর্ষু অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।
সেদিন ব্রাজিলিয়ানরা সত্যিই বিশ্বাস করেছিলেন, এত আয়োজন, এত প্রস্তুতি নিয়ে যেহেতু বিশ্বকাপ জেতা গেল না, তাই আর হয়তো কোনো দিনও সেটা জেতা যাবে না। সেই ম্যাচটাই সাদা জার্সিতে ব্রাজিলের শেষ ম্যাচ। অভিশপ্ত ভেবে সাদা জার্সি আর কখনোই দেখা যায়নি ব্রাজিল দলে।

সেদিনের সেই হারের লগ্নে মারাকানা থেকে বহু দূরে মিনাস গেরাইসে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছিল এক কিশোর। তার বাবা রেডিওতে ব্রাজিলের হার শুনে যখন কাঁদছিলেন, ছেলেটি বাবাকে ভরসা দিয়েছিল এই বলে, ‘একদিন আমি বিশ্বকাপ জেতাব ব্রাজিলকে।’ পেলে!

বাকি গল্প তো সবারই জানা। পেলে–গারিঞ্চায় ১৯৫৮ বিশ্বকাপ এল ব্রাজিলে, চার বছর পর ’৬২ বিশ্বকাপ জেতালেন গারিঞ্চা প্রায় একাই, আট বছর পর ’৭০ বিশ্বকাপ জিতল ব্রাজিল পেলে–তোস্তাওদের যৌথ প্রযোজনায়। এরপর ’৯৪ বিশ্বকাপ জিতল রোমারিও–বেবেতোদের হাত ধরে। এর আট বছর পর রোনালদো–রিভালদোরা ব্রাজিলকে এনে দিলেন পঞ্চম বিশ্বকাপ।

কিন্তু ব্রাজিলিয়ানদের হৃদয়ে মারাকানা তবু থেকে গেছে চিরকালীন এক দুঃখ হিসেবে। ২০১৪ বিশ্বকাপে ‘মিনেইরাজো’ দুঃখ শুধু ব্রাজিলিয়ানদের এই কষ্টের পাশে বসতে পারে। জার্মানির কাছে সেই হারে ব্রাজিলিয়ান পরবর্তী প্রজন্ম কি মারাকানাজ্জো একটু একটু করে ভুলতে বসেছে?

সাম্প্রতিক এক উদাহরণ দেওয়া যায়। গতকাল গ্লোবো টিভির অনুষ্ঠান ‘হু ওয়ান্টস টু বি আ মিলিয়নিয়ার’ অনুষ্ঠানে এলিজা ফেইতোজা নামের এক নারীকে সঞ্চালক ১০ লাখ ব্রাজিলিয়ান রিয়াল মূল্যের একটি প্রশ্ন করেন। সঠিক উত্তর দিতে পারলে ওই অর্থ তিনি পাবেন।

প্রশ্নটি ছিল, ‘১৯৫০ বিশ্বকাপ ফাইনালে মারাকানায় দুই লাখ মানুষকে স্তব্ধ করে দেওয়া সেই গোলটি করেছিলেন উরুগুয়ের কোন খেলোয়াড়?’

এলিজা উত্তর দেন, ‘ওবদুলিও ঘিঘিয়া।’

মারাকানায় ব্রাজিলের সেই হারের আজ ৭৫ বছর। এতদিনে ব্রাজিলিয়ানরা ঘিঘিয়ার পুরো নামটা হয়তো একটু একটু করে ভুলতে শুরু করেছেন!