আজও মাঠ থেকে মাঠে ‘যাযাবর’ আলফাজ

আলফাজ আহমেদের মোহামেডান এখন অনুশীলন করছে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশাল ইউনিভার্সিটির মাঠেশামসুল হক

আজ এ মাঠ। কাল ও মাঠ। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অনুশীলন মানেই যেন যাযাবরের মতো ঘোরা।

১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত মোহামেডানের নিজস্ব একটা মাঠ হয়নি। ফলে অনুশীলনের জন্য প্রতিবছরই এখানে–সেখানে ঘুরতে হয়। এই মৌসুমে যেমন মতিঝিল ক্লাব চত্বরের একচিলতে উঠানের বাইরে মোহামেডান এখন পঞ্চম মাঠে অনুশীলন করছে!

অক্টোবরের শুরুতে সপ্তাহখানেক অনুশীলন করেছিল পল্টন আউটার স্টেডিয়ামে। কিন্তু সেখানে নানা সমস্যা। ক্রিকেট অনুশীলন বেশি হয় সেখানে। আউটার স্টেডিয়াম থেকে সরে দৈনিক সাত হাজার টাকা ভাড়ায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) মাঠে অনুশীলন চলে সপ্তাহখানেক। কিন্তু একই মাঠে চট্টগ্রাম আবাহনীও অনুশীলন করে বলে অনেক সময় সূচি মেলে না। অগত্যা ফাঁকে ফাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠেও গিয়েছে মোহামেডান।

সমস্যার সমাধানে স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার ও ঢাকা দক্ষিণের মেয়রের মাধ্যমে গেন্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠ পেয়েছিল মোহামেডান। ওই মাঠে অনুশীলন চলে মাসখানেক। কিন্তু সমস্যা হলো, সেখানে অনুশীলন করতে হলে তা করতে হয় সকাল ১০টায়। কোচ আলফাজ আহমেদের ভাষায়, ‘ধূপখোলায় বিশাল মাঠ। কিন্তু অনেক দলই সেখানে অনুশীলন করে। ১০টার সময় গেলে ভিড় কম থাকে। ওই সময়টায় ওখানে আমরা অনুশীলন করেছি। টাইমিংটা ভালো না। তা ছাড়া মাঠের অবস্থাও ভালো নয়। মরা ঘাস, অসমতল। তাই ওখান থেকে চলে এসেছি।’

সকাল ৯টার মধ্যে ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটির মাঠে অনুশীলন শেষ করতে হয় মোহামেডানকে
শামসুল হক

শেষ পর্যন্ত ৪ জানুয়ারি থেকে রাজধানীর ১০০ ফিট এলাকায় মোহামেডানের অনুশীলন চলছে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি মাঠে। গত বছর কিছুদিন এই মাঠে অনুশীলন করেছিল সাদা–কালোরা। সকাল ৯টার মধ্যে ওই মাঠে অনুশীলন শেষ করতে হয়। মোহামেডান ক্লাব সভাপতি সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল মুবীন এই মাঠের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তবে এই মাঠ নিয়েও পুরোপুরি খুশি নন আলফাজ, ‘মাঠটার কিছু জায়গা ভালো আছে, পাসিং-টাসিং করানো যায়। কিন্তু কিছু জায়গায় শক্ত মাটি, ব্যথা পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। মেয়র কাপসহ অনেক খেলা হয়েছে ওখানে। ফলে মাঠটা আগের মতো আর নেই।’

আরও পড়ুন

মাঠে মাঠে ঘুরে অনুশীলন করা অবশ্য আলফাজ আহমেদের জন্য নতুন কিছু নয়। বছর পাঁচেক ধরে কোচ হিসেবে মোহামেডানের সঙ্গে যুক্ত থাকায় আরও কিছু মাঠে অনুশীলন করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান কোচ শন লেনের সহকারী থাকার সময় অনুশীলনের জন্য তখন প্রায়ই যাওয়া হতো ক্লাবসংলগ্ন বাফুফের টার্ফে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম চত্বরে আউটার স্টেডিয়াম, কমলাপুর স্টেডিয়ামসহ নানা মাঠে গেছেন। ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটির মাঠেও (তখন এই মাঠের ভাড়া দিতে হতো) অনুশীলন হয়েছে ওই সময়। তাঁর সময়ে একবার নারায়ণগঞ্জের আলীগঞ্জের একটা মাঠেও অনুশীলন করতে যেত মোহামেডান। অনুশীলন ক্যাম্প করতে শন-যুগে মোহামেডান গেছে সুদূর বিকেএসপিতেও।

অনেক সময় বাধ্য হয়ে ক্লাব চত্বরেও কাজ চালিয়ে নিতে হয় মোহামেডানকে
শামসুল হক

অনুশীলনের জন্য সবচেয়ে বেশি মাঠে ঘোরার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে সম্ভবত আলফাজেরই। খেলোয়াড় হিসেবে প্রথম মেয়াদে মোহামেডানে ছিলেন ১৯৯৫-২০০১ পর্যন্ত। এরপর ২০০৫ ও ২০১৩ সালে। মোট ৯ বছর। এই সময়ে কত মাঠে অনুশীলন করেছেন, গুনেই শেষ করতে পারছিলেন না। মনেও নেই অনেক মাঠের কথা, ‘খেলোয়াড় হিসেবে ১৫-১৬টি মাঠে অনুশীলন করেছি। কোচ হিসেবে ৮-৯টা হবে।’

আরও পড়ুন
খেলোয়াড় হিসেবে ১৫-১৬টি মাঠে অনুশীলন করেছি। কোচ হিসেবে ৮-৯টা হবে।
আলফাজ আহমেদ, মোহামেডান কোচ

খেলোয়াড় আলফাজ মোহামেডানের সঙ্গে যেসব মাঠে অনুশীলন করেছেন, সেই তালিকটা মোটামুটি এমন—বিডিআর মাঠ (বর্তমানে বর্ডার গার্ড মাঠ), রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মাঠ, এর বিপরীতে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট স্কুল মাঠ, মহাখালী টিঅ্যান্ডটি মাঠ, তিতুমীর কলেজ মাঠ, রেসিডেনসিয়াল স্কুল অ্যান্ড মডেল কলেজ মাঠ, আর্মি স্টেডিয়াম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠ, বুয়েট মাঠ, আউটার স্টেডিয়াম, মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজ মাঠ, কমলাপুর স্টেডিয়াম, বাফুফের টার্ফ, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম, ক্লাবের আঙিনা।

এক সময়ের সতীর্থরা এখন ভিন্ন ভূমিকায় আলফাজের সহকর্মী—(বাঁ থেকে) ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব, ছাইদ হাসান কানন ও আবদুল কাইয়ুম।
শামসুল হক

এই অভিজ্ঞতা নিয়ে আস্ত একটা বই লিখে ফেলতে পারেন আলফাজ। তাতে থাকতে পারে অনেক স্মৃতি। নিজেই বলেন, ‘খেলোয়াড়ি জীবনে ভবঘুরের মতো অনুশীলন করেছি। এখনো অনেকটা সে রকমই অবস্থা। ১৯৯৫-৯৬ সালের দিকে আর্মি স্টেডিয়ামে অনুশীলন শেষে মতিঝিলে ক্লাব টেন্টে ফেরার সময় প্রতিদিন বাসে গানের আসর হতো। খেলোয়াড় মনসুর আলী গান গাইত বাসে। আমরা খুব উপভোগ করতাম। তা ছাড়া নানা মাঠে যেতে রাস্তায় যে কত সময় জ্যামে বসে কেটেছে, তার হিসাব নেই।’

আরও পড়ুন

এখন আলফাজের ভূমিকা বদলেছে। দল তৈরি করতে হয় নিজেকে। আর একটা দল তৈরিতে ভালো মাঠের বিকল্প নেই। এ জন্য আক্ষেপ করে বলেন, ‘কোচিং করানোর যে আনন্দ, সেটা পাই না এভাবে যাযাবরের মতো ঘুরে। এসব মাঠে হয়তো ফিটনেস নিয়ে কাজ করা যায়। কিন্তু উন্নতি হয় না। কোচ হিসেবে এটা আমার জন্য ভালো নয়। অথচ দেখুন, ক্লাব বা সমর্থকেরা জয় ছাড়া কিছু বোঝেন না। ফলে অনেক চাপ থাকে। অনেক কোচকে এই ঝামেলা পোহাতে হয় না।’

ঘরোয়া ফুটবলে ম্যাচ খেলতে হয় বিকেলে। কিন্তু মাঠ প্রাপ্তির শর্তে আলফাজকে অনুশীলন করাতে হয় সকালে। এ নিয়েও আছে তাঁর অতৃপ্তি, ‘বেশির ভাগ সময় বিকেলে ক্লাব চত্বরের উঠানে হালকা অনুশীলন সেরে নিই। তবে নিজস্ব একটা মাঠ থাকলে পরিকল্পনা করে অনুশীলন করা যায়, যে সুবিধাটা আমার নেই।’

নিকট ভবিষ্যতে আলফাজের এই আক্ষেপ ঘোচার কোনো সম্ভাবনা আছে বলেও মনে হয় না।