মারাকানায় রোমারিওর হ্যাটট্রিক দেখলেন বাজ্জো, ফিরল ’৯৪ বিশ্বকাপের স্মৃতি
সেই দৃশ্যটি ফুটবলের অন্যতম বিষাদমাখা মুহূর্ত। শত শত ক্যামেরার ফ্রেমে ধারণ করা সেই মুহূর্তের ছবি আজও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়ায়। গ্যালারিতে কিংবা টিভি পর্দায় মুহূর্তটি দেখা অনেকেই তখন ফিরে যান অতীতে। আজ থেকে ৩১ বছর আগে। ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডেনার রোজ বোল স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপ ফাইনাল। টাইব্রেকারে ইতালির শেষ শটটি চলে গেল পোস্টের ওপর দিয়ে। আরও কি বলার প্রয়োজন আছে?
আসল কথাটাই বলা হয়নি। শটটি যিনি মিস করলেন, সেই মানুষটি কোমরে হাত দিয়ে মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাওয়ায় নড়ার শক্তিটুকুও যেন তাঁর ছিল না। চারপাশে ব্রাজিলিয়ানদের বিশ্বজয়ের উল্লাস। তাদের মধ্যে এক ফোঁটা বিজন অশ্রু হয়ে ছিলেন মানুষটি। কিছুক্ষণ পর কেউ গিয়ে তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে নিলেও সেই দৃশ্যটি ফুটবলের চিরায়ত দুঃখগাথার অংশ হয়ে যায়। যে কারণে ‘রবার্তো বাজ্জো’—নামটা শুনলে সবার আগে ওই ছবিটিই ভেসে ওঠে মানসপটে, যেন আজও তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে!
সেটা ১৯৯৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল। বিশ্বকাপে ব্রাজিল ও ইতালির মধ্যে যেটা শেষ ফাইনাল। অন্য চোখে দেখলে, বিশ্বকাপে ব্রাজিল-ইতালি ধ্রুপদি দ্বৈরথে সর্বশেষ সংযোজন। যেটার শুরু হয়েছিল ১৯৩৮ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ইতালির কাছে ব্রাজিলের হার দিয়ে। এরপর ১৯৭০ বিশ্বকাপ ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে ব্রাজিলের সেই ‘জোগো বনিতো’ খেলে জয়, ১৯৭৮ বিশ্বকাপে তৃতীয়স্থান নির্ধারণী ম্যাচেও জেতে ব্রাজিল কিন্তু ১৯৮২ বিশ্বকাপে এসে গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় পর্বে ইতালির কাছে হারতে হয় ব্রাজিলকে। পাওলো রসির হ্যাটট্রিকের সামনে কুঁকড়ে গিয়েছিল সক্রেটিস-ফ্যালকাওদের স্বপ্ন। তারপর ’৯৪–এর সেই ঘটনা তো বলাই হলো। সব মিলিয়ে এসব দ্বৈরথের মধ্য দিয়ে ব্রাজিল ও ইতালির ফুটবলীয় সম্পর্কও আরও দৃঢ় হয়েছে। গাঢ় হয়েছে বন্ধুত্ব। দুই দেশের সুসম্পর্কের সে দাবি থেকেই গতকাল মারাকানা স্টেডিয়ামে ফিরিয়ে আনা হয়েছে ’৯৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের টুকরা টুকরা স্মৃতি।
ব্রাজিল ও ইতালির বিভিন্ন প্রজন্মের সাবেক ফুটবলারদের নিয়ে মারাকানায় ‘ম্যাচ অব দ্য হার্ট’ নামে প্রীতি ম্যাচ আয়োজন করা হয়েছিল। দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব উদ্যাপন, সামাজিক অংশগ্রহণমূলক সংশ্লিষ্টতা বাড়ানো এবং সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের খেলায় টেনে আনা—এসব লক্ষ্য নিয়ে ম্যাচটি আয়োজন করা হয়েছিল। গ্যালারিতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিশেষ জায়গাও রাখা হয়েছিল। আর মাঠের লড়াই? ব্রাজিলের ’৭০ বিশ্বকাপ কিংবদন্তি গারসনের ভাষায়, ‘ওরা আবার হারল।’ ইতালির এই হারের স্কোরলাইন ৮-৩।
কিন্তু ম্যাচের ফল এই খেলায় মোটেও মুখ্য বিষয় নয়। চোখের সামনে অতীত নেমে আসার শিহরণটা দর্শকদের কাছে তো ম্যাচের ফলের চেয়েও বেশি। এ কারণে রোমারিওর হ্যাটট্রিক, এদিলসনের জোড়া গোল, কাফু, মাইকন ও মাতেরাজ্জির (আত্মঘাতী) গোলকেও ছাপিয়ে গেছে কিংবদন্তিদের একসঙ্গে দেখার আনন্দ। ইতালির হয়ে দুটি গোল পাবলো অসভালদোর, একটি গোল আমোরৌসোর। নিশ্চয়ই ভাবছেন বাজ্জো কোথায়?
হ্যাঁ, প্যাসাডেনার ফাইনালে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই ‘ডিভাইন পনিটেইল’ও ছিলেন। তবে মাঠে নয়। ব্রাজিলের ভক্তরা মজা করে ভাবতে পারেন, বাজ্জো বোধ হয় ’৯৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের সেই স্মৃতি ভুলতে পারেননি বলেই মাঠে নামেননি! মোটেও তা নয়। চোট নিয়ে মারাকানায় হাজির হয়েছিলেন কিংবদন্তি। স্যুট পরে ডাগআউটে বসে ম্যাচটি দেখেছেন। কিছু সময়ে উঠে দাঁড়িয়ে গ্যালারির দর্শকদের প্রতি হাত নেড়েছেন।
‘বাজ্জো! বাজ্জো!’ চিৎকারে প্রতিক্রিয়া এসেছে গ্যালারি থেকে। ‘সাদা পেলে’খ্যাত জিকোকে দেখেও চিৎকার করেছেন দর্শকেরা। টানেলে জিকো জড়িয়ে ধরেন ’৯৩ ব্যালন ডি’অরজয়ী বাজ্জোকে। জিকো ও গারসন বাজ্জোর মতোই ডাগআউটে বসে ম্যাচটি দেখেন। খেলার মধ্যে বৃষ্টি নামলেও এ ম্যাচ নিয়ে দর্শকদের উন্মাদনা কমেনি।
প্রতি অর্ধে ৩৫ মিনিট করে খেলেছে দুই দল। দ্বিতীয়ার্ধে চমক হিসেবে সাইডলাইনে আবির্ভূত ব্রাজিলের গায়িকা লুদমিলা। ব্রাজিলের সাবেক ফরোয়ার্ড এদিলসনের বদলি হিসেবে মাঠে নেমে লুদমিলা আরেকটু হলেই গোল করে ফেলেছিলেন! ২০০৬ বিশ্বকাপে জিনেদিন জিদানকে ঢুস মারা মাতেরাজ্জিকে নিয়ে ব্রাজিলিয়ানদের খুব আগ্রহ ছিল। মাঠ ছাড়ার সময় দর্শকদের অটোগ্রাফ এবং সেলফির আবদার মেটাতে হয়। ব্রাজিলকে ২০০২ বিশ্বকাপ জেতানো অধিনায়ক কাফুকে দেখে ‘ক্যাপ্টেন! ক্যাপ্টেন!’ বলে চিৎকার করেছে দর্শকদের একাংশ। পরে মাইক্রোফোন হাতে দর্শকদের সুরের মূর্ছনাতেও ভাসান।
ইতালির হয়ে মাঠে নেমেছিলেন মাতেরাজ্জি, মার্কো আমেলিয়া, ক্রিস্টিয়ান পানুচ্চি, জ্যাকার্দো, পেরোত্তা, ব্রুনো জিওদার্নো, পাবলো অসভালদো, বোরিয়েল্লো, আমোরৌসো, এদের ও আলেসান্দ্রো আলতোবেল্লি। ইতালির ’৮২ বিশ্বকাপ জয়ে ফাইনালে গোল করেছিলেন আলতোবেল্লি। ব্রাজিলের হয়ে খেলেন রোমারিও, জুনিয়র, কাফু, আলদাইর, জর্জিনিও, ক্যারেকা, এদমিলসন, লুইজাও, অ্যান্ডারসন পোলগা, জুনিয়র, জুনিনিও পলিস্তা, অ্যামারাল ও ভ্যালবের।