জেলেদের গ্রাম, তা–ও প্রায় ১০০০ মানুষের; সেই গ্রামের এক ক্লাবের রূপকথার গল্প
গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বাজে সময় কাটাচ্ছে সুইডেন জাতীয় ফুটবল দল। ইউরোপিয়ান অঞ্চলের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ‘বি’ গ্রুপের তলানিতে রয়েছে সুইডিশরা। ২০২৬ বিশ্বকাপে সরাসরি জায়গা করে নিতে নিজেদের ম্যাচগুলো জেতার পাশাপাশি অন্য দলের ফলের ওপরও নির্ভর করতে হবে। সুইডিশদের এই হতাশায় প্রেরণা হতে পারে তাদের দেশেরই একটি ‘রূপকথার গল্প’। শুধু সুইডিশ কেন, যেকোনো দেশের মানুষ কিংবা খেলাধুলার দলগুলোর প্রেরণা হতে পারে মিয়ালবি।
মিয়ালবি? সুইডেনের শীর্ষ লিগ আলসভেনসকানে খেলা দল। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের জেলে গ্রাম হ্যালেভিক, যে গ্রামের জনসংখ্যা মাত্র ১০০০–এর কাছাকাছি, সেখান থেকে উঠে আসা ক্লাবটি সুইডেনের শীর্ষ লিগ জিতে জন্ম দিয়েছে রূপকথার।
হ্যালেভিক গ্রামের দেয়ালে একটি কথা খোদাই করা আছে, ‘মেক দ্য ইম্পসিবল পসিবল’ (অসম্ভবকে সম্ভব করো)’—সেখানকার এই ক্লাব মাঠে যেন ঠিক এই কথারই বাস্তবায়ন করল।
৮৬ বছরের পুরোনো এই ক্লাবটি এর আগে কখনো সুইডেনের শীর্ষ লিগের শিরোপা জিততে পারেনি। ১৯৩৯ সালে যাত্রা শুরুর পর এ পর্যন্ত ১৩ মৌসুম সুইডেনের শীর্ষ লিগে খেলেছে মিয়ালবি। ২০২০ সালে আলসভেনসকানে ফেরার পর আর অবনমন ঘটেনি। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, এবার সেই পথে মিয়ালবি কি না দেশের শীর্ষ লিগটাই জিতে নিল!
গতকাল গোথেনবার্গকে ২–০ গোলে হারানোর মধ্য দিয়ে সুইডেনের শীর্ষ লিগ জয় নিশ্চিত হয় মিয়ালবির।
আলসভেনসকানে চলতি মৌসুমে ২৬ ম্যাচে ৬৬ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে মিয়ালবি। ২৭ ম্যাচে ৫৫ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় হ্যামারবাইয়ের সঙ্গে ১১ পয়েন্ট ব্যবধানে এগিয়ে ক্লাবটি। সবগুলো দলের হাতেই আছে আর তিনটি করে ম্যাচ। মিয়ালবি নিজেদের এই তিন ম্যাচে কোনো পয়েন্ট না পেলেও শীর্ষস্থান থেকে তাদের কেউ সরাতে পারবে না।
খেলাধুলাভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘দ্য অ্যাথলেটিক’ মিয়ালবির এই অগ্রযাত্রাকে তুলনা করেছে ২০১৫–১৬ মৌসুমে লেস্টার সিটির ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ জয়কে। তাদের মতে, লেস্টার সেবার যেমন খুব অপ্রত্যাশিতভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, মিয়ালবিও তেমনি এবার ইউরোপিয়ান লিগগুলোর মধ্যে খুব অপ্রত্যাশিত এক চ্যাম্পিয়ন। লেস্টার যে মৌসুমে প্রিমিয়ার জিতল, মিয়ালবি সে মৌসুমে সুইডিশ ফুটবলের তৃতীয় স্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে।
মিয়ালবির এবারের অগ্রযাত্রাকে কেন অলৌকিক ঘটনা বলা হচ্ছে, তার কারণ বোঝাতে একটি পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। আলসভেনসকানে গত ১২ মৌসুমে ৮ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মালমো। সুইডেনের এই পরাশক্তি ক্লাবের যে বাজেট, তার ১৫ শতাংশ বাজেট মিয়ালবির।
ক্লাবটির কোচ আন্দ্রেয়াস টরস্টেনসনের সহকারী কার্ল মারিয়াস আকসাম ফুটবলে একজন ‘ট্যাকটিক্যাল গুরু’—‘ভিজ্যুয়াল পারসেপশন ইন ফুটবল’ বিষয়ে তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রি আছে। যদিও মিয়ালবিতে যোগ দেওয়ার আগে আকসাম কখনো কোনো ক্লাবে কোচিং করাননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফুটবল নিয়ে তাঁর বিভিন্ন পোস্টগুলো দেখার পর মিয়ালবি তাঁকে এই দায়িত্ব দিয়েছে। আর এর পর থেকেই পারফরম্যান্সের তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সম্পূর্ণ পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে খেলোয়াড়দের সই করিয়েছে ক্লাবটি। যেমন ধরুন তাদের গাম্বিয়ান ফরোয়ার্ড আবদৌলিয়ে মান্নেহ এরই মধ্যে ইউরোপের কিছু বড় ক্লাবের নজর কেড়েছেন।
শিরোপার সুবাস পেতে কেমন লাগছে—মিয়ালবির কোচ টরস্টেনসনের কাছে এর আগে জানতে চেয়েছিল বার্তা সংস্থা এএফপি। তৃতীয় মেয়াদে ক্লাবটির দায়িত্ব এই কোচের উত্তর শুনুন তাঁর মুখেই, ‘এখন এটা নিয়ে আপাতত ভাবার দুঃসাহস দেখাতে চাই না। এটাই আমার ঘর। আমি মিয়ালবি গ্রামে জন্মেছি...দারুণ একটা ব্যাপার হবে। স্বল্প সুযোগ–সুবিধা, অল্প বাজেট নিয়ে মিয়ালবি অনেক বছর ধরেই সুইডিশ ফুটবলে আন্ডারডগ।’
লিগ শিরোপা জয় নিশ্চিতের পর গোথেনবার্গের বিপক্ষে গোলদাতা মিয়ালবির স্ট্রাইকার জ্যাকব বের্জস্ট্রম বলেন, ‘জীবনে এমন কিছু ঘটবে তা কখনো ভাবিনি। এই দলের অংশ হতে পেরে আমি কৃতজ্ঞ। দলগত প্রচেষ্টা যে অবিশ্বাস্য দূরে নিয়ে যেতে পারে তা দেখিয়েছি আমরা।’
টরস্টেনসন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ও পরবর্তী সময়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক, যিনি সময় বের করে মিয়ালবির খেলোয়াড়দের কোচিং করান। ক্লাবটির বাল্টিক সাগর তীরবর্তী স্টেডিয়াম স্ট্রানভ্যালেনে প্রতিদিন সকালে খেলোয়াড়দের সঙ্গে সকালের নাশতা সেরে দিনের কার্যাবলি ঠিক করেন। তাঁর দলের খেলোয়াড়দের গড় বয়স ২৪ বছর। বেশির ভাগের আবাসস্থল মিয়ালবির নিকটবর্তী সবচেয়ে কাছের শহর সলভেসবোর্গে। খেলোয়াড়েরা সেখান থেকে সাধারণ গাড়িতে কিংবা গাড়িতে একসঙ্গে কয়েকজন গাদাগাদি করে অনুশীলনে আসেন।
লিগ জয় নিশ্চিতের পর টরস্টেনসন বলেছেন, ‘তিন ম্যাচ হাতে রেখে এই অভিজ্ঞতা লাভ এক পরম স্বস্তির ব্যাপার।’
গত বছরও মিয়ালবির বাজেট ছিল মাত্র ৯ মিলিয়ন ডলার, যা মালমোর বাজেটের মাত্র ৮ শতাংশ। ক্লাবটির চেয়ারম্যান ম্যাগনাস এমিউস একজন শিল্পপতি। স্বল্প বাজেট নিয়েও ক্লাবটিকে তিনি ঠিক কীভাবে সাফল্য এনে দিলেন, সে বিষয়ে খেলোয়াড়দের পানিবাহক গ্লেন হারমানসন বলেন, ‘এমিউসের কাছে এটা ব্যবসার মতো। আমরা প্রতিটি ধাপ ধরে ধরে এগিয়েছি। এ কারণে এখন যে সাফল্য আমরা পেতে যাচ্ছি, সেটা প্রাপ্যই ছিল।’
চ্যাম্পিয়নস লিগের আগামী মৌসুমের বাছাইপর্বে খেলা নিশ্চিত মিয়ালবির। কিন্তু নিজেদের স্টেডিয়ামে সেই বাছাইপর্বের ম্যাচ তারা খেলতে পারবে না। কারণ, উয়েফার যে মানদণ্ড, সেটার সঙ্গে তাদের মাত্র ৬ হাজার আসনের স্টেডিয়ামটি বেমানান।
মিয়ালবির বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই স্থানীয়, তাঁদের কোচের পরিচয় তো আগেই দেওয়া হয়েছে আর স্কাউট পেশায় একজন পোস্টম্যান। বেশি নয়, মাত্র নয় বছর আগেও চতুর্থ স্তরে নেমে যাওয়ার শঙ্কায় ছিল মিয়ালবি।
সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেশের শীর্ষ লিগ জিতল মিয়ালবি। এর আগে লিগ জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে ক্লাবটির চেয়ারম্যান এমিউস বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) বলেছিলেন, ‘আমরা যদি লিগ জিততে পারি, তাহলে এই সাফল্যের ধারেকাছেও কিছু থাকবে বলে মনে হয় না। এটা রূপকথা। প্রায়ই শুনতে হয়, আমরা কীভাবে এটা করছি? তাই এটা বলা গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা শুধু চলতি বছর থেকে এই চেষ্টা করছি না, বেশ কয়েক বছর ধরেই এটা করার চেষ্টা করছি।’