জাতীয় দলে খেলে ফুটবলাররা চোট পেলে ক্লাব কি ক্ষতিপূরণ পায়
যেকোনো ক্লাবের কোচের কাছেই ব্যাপারটা দুঃস্বপ্ন; আন্তর্জাতিক বিরতিতে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের ছাড়তে হয়। ১০ দিন পর দেখা যায়, দেশের হয়ে খেলে তাঁরা ফিরছেন চোট নিয়ে। তাতে ক্লাবগুলোর পরবর্তী কিছু ম্যাচে চোট পাওয়া এই খেলোয়াড়দের পাওয়ার সুযোগ থাকে না।
ক্লাব ফুটবল ও আন্তর্জাতিক ফুটবল পাশাপাশি চলার এই এক ঝুঁকি। এটা প্রতিরোধের বাস্তবসম্মত কোনো উপায়ও নেই।
আর্সেনালকে জিজ্ঞেস করতে পারেন, গত শনিবার সেনেগালের বিপক্ষে ২-০ গোলে জয়ের প্রীতি ম্যাচে ব্রাজিলিয়ান তারকা গ্যাব্রিয়েল চোট পেয়ে মাঠ ছাড়ার সময় তাদের কেমন লেগেছে? দুঃখ প্রকাশ করেছেন ব্রাজিল কোচ কার্লো আনচেলত্তি, ‘আমরা হতাশ এবং খুবই দুঃখিত। (চোটের ধরন) কতটা খারাপ? ঠিক বলতে পারব না। সে অ্যাডাক্টরে চোট পেয়েছে। চিকিৎসক দল দেখভাল করছে।’
চলতি মৌসুমে আর্সেনালের রক্ষণে অবিচ্ছেদ্য অংশ গ্যাব্রিয়েল। স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে যত দ্রুত সম্ভব সুস্থ অবস্থায় ফিরে পেতে চাইবে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবটি। সামনের দুটি সপ্তাহে আর্সেনালের সামনে প্রিমিয়ার লিগে দুটি ম্যাচ (প্রতিপক্ষ টটেনহাম ও চেলসি) এবং চ্যাম্পিয়নস লিগেও মাঠে নামতে হবে।
প্রিমিয়ার লিগের আরেক ক্লাব নিউক্যাসল ইউনাইটেডও একই সমস্যায় ভুগেছে গত সেপ্টেম্বরে। তাদের ফরোয়ার্ড ইয়োনে উইসা নিজের দেশ ডিআর কঙ্গোর হয়ে ম্যাচে চোট পান। বুন্দেসলিগার দল বায়ার্ন মিউনিখও আলফন্সো ডেভিসকে নিয়ে একই সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত মার্চে কানাডার হয়ে ম্যাচে এসিএল চোট পেয়ে দীর্ঘদিনের জন্য মাঠের বাইরে ছিটকে পড়েন ডেভিস।
তবে এমন পরিস্থিতিতেও ক্লাবগুলোর একটু স্বস্তির জায়গা আছে। সেটাই ব্যাখ্যা করেছে খেলাধুলাভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘দ্য অ্যাথলেটিক’।
প্রশ্ন হলো, জাতীয় দলের হয়ে খেলায় কোনো খেলোয়াড় চোট পেলে সেই খেলোয়াড়ের ক্লাব কি সে জন্য ক্ষতিপূরণ পায়?
ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা ২০১২ সালেই টের পায়, এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। ক্লাব বনাম আন্তর্জাতিক ফুটবলের মধ্যে বহুদিনের টানাপোড়েনের সমাপ্তি টানতে একটি বিমাব্যবস্থা চালু করে ফিফা। সে বছর ইউরো শুরুর আগেই এ ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়।
ইউরোপিয়ান ক্লাব অ্যাসোসিয়েশন (ইসিএ) নতুন বন্দোবস্তের জন্য ফিফাকে চাপ দিয়েছিল। পরে ফিফার সিদ্ধান্তকে ক্লাব ও জাতীয় ফেডারেশনের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করার ‘মাইলফলক মুহূর্ত’ হিসেবে তারা ঘোষণা করে। ফিফার ক্লাব প্রটেকশন প্রোগ্রামের (সিপিপি) নামেই বিষয়টির রহস্য লুকিয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্লাবগুলোকে তারা এ বিষয়ে সাহায্য করেছে। তাতে বেতন-ভাতা দিয়ে অন্যদের সুবিধার জন্য নিজেদের ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কাটা কমেছে ক্লাবগুলোর।
কোনো খেলোয়াড় চোটের কারণে ন্যূনতম ২৮ দিনের জন্য মাঠের বাইরে ছিটকে পড়লে তিনি সিপিপির মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠেন। ফিফা সেই খেলোয়াড়ের পাওনা মিটিয়ে দেয়। এ ব্যবস্থায় অবশ্য মাঠের বাইরে চলে যাওয়া খেলোয়াড়কে আগেভাগে সুস্থ করে তুলতে পারে না ক্লাবগুলো। তবে আর্থিক সহায়তার কারণে ক্লাবগুলোর ক্ষোভ অন্তত একটু হলেও প্রশমিত হয়।
ফিফার বর্তমান সিপিপি নীতিমালা ২০২৩ থেকে ২০২৬ সালের শেষ পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। জাতীয় দলেও খেলোয়াড়দের সুরক্ষিত রাখার কাজটা করা হয় এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে। খেলোয়াড় যখন ক্লাব ছেড়ে যান আন্তর্জাতিক বিরতিতে, তখন থেকে ক্লাবে তাঁর ফেরা পর্যন্ত এই নীতিমালা কার্যকর থাকে। এর মধ্যে রয়েছে ম্যাচ, অনুশীলন সেশন ও ভ্রমণ।
ক্লাবগুলো কী পরিমাণ অর্থ পায়
বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ। ২০২৩ সালে সদস্যদেশগুলোর কাছে ফিফার তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারি ফাতমা সামুরার পাঠানো নথি অনুযায়ী, মাত্র একটি চোটের কারণে কোনো ক্লাব এক বছরে চোট পাওয়া খেলোয়াড়ের বেতন-ভাতা দিতে সাড়ে ৭ মিলিয়ন ইউরো (প্রায় ১০৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা) অর্থ দাবি করতে পারে, যেটা দিনে সর্বোচ্চ ২০ হাজার ৫৪৮ ইউরো। অঙ্কটি শুধু চোট পাওয়া খেলোয়াড়ের মূল বেতন মেটানোর জন্য নির্ধারিত। বোনাস, ইমেজ-স্বত্ব কিংবা চিকিৎসা খরচ এর আওতাভুক্ত নয়।
ধরুন, কোনো খেলোয়াড়ের সাপ্তাহিক বেতন ২০ হাজার পাউন্ড। দেশের হয়ে খেলতে গিয়ে চোট পাওয়ায় তাঁকে ১২ সপ্তাহ মাঠের বাইরে থাকতে হবে। তখন ফিফা তাঁর ক্লাবকে সেই সময়ে চোট পাওয়া খেলোয়াড়ের বেতন মেটাতে ২ লাখ ৪০ হাজার পাউন্ড প্রদান করবে। যদি সপ্তাহে ৪০ হাজার পাউন্ড বেতন পাওয়া কেউ চোট পেয়ে ছয় মাসের জন্য মাঠের বাইরে চলে যান, ফিফা তাহলে চোট পাওয়া সেই খেলোয়াড়ের বেতন হিসেবে তাঁর ক্লাবকে ১০ লাখ পাউন্ডের কিছু বেশি অর্থ প্রদান করবে।
এ ব্যবস্থায় কি কোনো সীমাবদ্ধতা আছে
ফিফার এই ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক ফুটবলারদের বেশির ভাগের বেতন পুরোপুরি মেটাতে যথেষ্ট। তবে বড় তারকা এবং উচ্চ বেতন পাওয়া খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে এটা পুরোপুরি কাভার করতে পারে না। একজন খেলোয়াড় যতই বেতন পান না কেন, ফিফা সর্বোচ্চ প্রায় সাপ্তাহিক ১ লাখ ২০ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত বেতন মেটাতে পারবে।
এ কারণে আর্লিং হলান্ড, মোহাম্মদ সালাহর মতো বিশ্বমানের তারকারা দেশের হয়ে ম্যাচে চোট পেলে তাঁদের বেতনের অল্প অংশ কাভার করা সম্ভব হয়। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ক্লাব আল নাসর শুধু তাঁর বেতনের একটি অংশই দাবি করতে পারবে যদি তিনি পর্তুগালের হয়ে খেলতে গিয়ে চোট পান।
ফিফাও সিপিপির মাধ্যমে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। এর বার্ষিক তহবিল মাত্র ৮ কোটি ইউরো পর্যন্ত সীমিত, তাই যদি আন্তর্জাতিক দায়িত্বে থাকা অনেক খেলোয়াড় একসঙ্গে চোট পান, তাহলে সব ক্লাবই তাদের মাঠের বাইরে থাকা খেলোয়াড়দের বেতন পুরোপুরি ফেরত পাবে না।
নারী ও পুরুষদের ফুটবলে সিপিপি কার্যকর। কিন্তু বয়সভিত্তিক পর্যায়ে যেমন অনূর্ধ্ব-২১ ফুটবলে দেশের হয়ে খেলতে গিয়ে চোট পাওয়া খেলোয়াড়ের ক্লাবকে ক্ষতিপূরণ দেয় না ফিফা।
ফিফার ক্লাব উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কি এটি আলাদা
হ্যাঁ, আলাদা। এ প্রকল্প ছেলেদের বিশ্বকাপের জন্য, যে ক্লাবগুলো ফুটবলের সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্টে অংশ নিতে খেলোয়াড়দের পাঠায়। তবে শুধু সেই ক্লাবগুলোই নয়, যারা খেলোয়াড়দের সরাসরি বিশ্বকাপে পাঠায়, এর পাশাপাশি যারা খেলোয়াড়ের সাম্প্রতিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে, তারা-ও এই সুবিধার ভাগ পায়।
সর্বশেষ ২০২২ বিশ্বকাপে ক্লাব থেকে দূরে থাকার জন্য ফিফা প্রতিটি খেলোয়াড়ের প্রতিদিনের খরচ হিসেবে প্রায় ১০ হাজার ডলার বরাদ্দ করেছিল। ফাইনালে (আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স) ওঠা খেলোয়াড়েরা, সেটা মাঠে নামুক বা না নামুক—সে জন্য ৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার পেয়েছে ক্লাবগুলো।
ফাইনালে খেলোয়াড়দের খেলাতে মোট ২০ কোটি ৯০ লাখ ডলারের তহবিল খরচ করে ফিফা। ফিফার ৫১টি সদস্য সংস্থার ৪৪০টি ক্লাব এই অর্থের ভাগ পায়।