‘আর্জেন্টিনার জন্য ১৯৮৬ ছিল সহজ এক বিশ্বকাপ’

১৯৮৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করেন হোর্হে ভালদানাফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ ফেসবুক পেজ

বিশ্বকাপ জেতার জন্য শুধু ভালো খেললেই হয় না, ভাগ্যের সহযোগিতাও লাগে। আর এ জন্যই বিশ্বকাপ জেতাটা এত কঠিন। আর এ জন্যই গত ১৯৩০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ৯২ বছরে ৮০টা দল বিশ্বকাপ খেললেও চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছে মাত্র ৮টা দল! যাদের অনেকেই হয়তো যে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, শক্তির বিচারে সেই বিশ্বকাপের সেরা দল ছিল না। কিন্তু কখনো ভাগ্য, কখনো কারও অতিমানবীয় পারফরম্যান্স তাদের চূড়ান্ত সাফল্য এনে দিয়েছে।

১৯৮৬ বিশ্বকাপের কথাই ধরুন। বলা হয়, ওটা ডিয়েগো ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ। প্রায় একক প্রচেষ্টায় যিনি আর্জেন্টিনাকে নিয়ে গেছেন ফাইনালে, জিতিয়েছেন শিরোপাও। হয়েছেন সেই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়। ম্যারাডোনা না থাকলে আর্জেন্টিনার ওই বিশ্বকাপ জেতা হয়তো সম্ভবই হতো না। সেই অর্থে, ১৯৮৬ বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনার জন্য খুব কঠিন ছিল, এটা বলাই যায়।

আরও পড়ুন

তবে সেই বিশ্বকাপ খেলা আর্জেন্টিনার আরেক কিংবদন্তি কিন্তু দাবি করেছেন, ওটা তাদের জন্য মোটেও কঠিন কোনো বিশ্বকাপ ছিল না। হোর্হে ভালদানো তাঁর নাম।

(আমাদের জন্য) ওটা ছিল সহজ এক বিশ্বকাপ। আমাদের একটা ম্যাচও টাইব্রেকারে যায়নি, কোনো ম্যাচে অতিরিক্ত সময়ও লাগেনি।
হোর্হে ভালদানো, আর্জেন্টিনার সাবেক

মেক্সিকোর আজতেকা স্টেডিয়ামে ৩৯ বছর আগের সেই ফাইনালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে ’৭৮ এর পর দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ জিতেছিল আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনার হয়ে সেই ফাইনালে গোল করেছিলেন হোসে ব্রাউন, হোর্হে ভালদানো ও হোর্হে বুরুচাগা। তাঁদের মধ্যে ভালদানো এত দিন পর স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম ‘মার্কা’র সঙ্গে আলাপচারিতায় ’৮৬ বিশ্বকাপ নিয়ে বলেছেন, ‘আর্জেন্টিনার জন্য ওটা ছিল সহজ এক বিশ্বকাপ।’

১৯৮৬ বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে ডিয়েগো ম্যারাডোনা
এএফপি

আর্জেন্টিনার হয়ে ২৩ ম্যাচে ৭ গোল করা সাবেক এ ফরোয়ার্ড ’৮৬ বিশ্বকাপে করেছিলেন ৪ গোল। তবে সেই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার স্কোয়াডে জায়গা পেতে সবার আগে কোচ কার্লোস বিলার্দোর আস্থা অর্জন করতে হয়েছিল ভালদানোকে। সে জন্য তাঁকে কী কী করতে হয়েছিল, সেসব বলেছেন রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে লা লিগা ও উয়েফা কাপ জেতা ভালদানো, ‘আমার ইচ্ছাশক্তি ছিল প্রবল। সহজাত যে প্রতিভাগুলো নিয়ে আমি জন্মাইনি, সেসব অর্জন করতে অনুশীলনের পরও অতিরিক্ত এক ঘণ্টা থাকতাম। যেমন বাঁ পা দিয়ে খেলা...শেষ পর্যন্ত আমি বাঁ উইংয়েই খেলেছি।’

আরও পড়ুন

এই পরিশ্রমই তাঁকে বানিয়েছিল আর্জেন্টিনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত খেলেছিলেন প্রতিটি ম্যাচে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর বিশ্লেষণ, ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচটা ছাড়া সেই বিশ্বকাপে কোনো ম্যাচ জিততেই আর্জেন্টিনার খুব একটা কষ্ট হয়নি। ভালদানোর কথা, ‘(আমাদের জন্য) ওটা ছিল সহজ এক বিশ্বকাপ। আমাদের একটা ম্যাচও টাইব্রেকারে যায়নি, কোনো ম্যাচে অতিরিক্ত সময়ও লাগেনি।’

আর্জেন্টিনার সেই দলের শক্তির জায়গাগুলো ভালদানো ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, ‘দলে ছিল অনেক অভিজ্ঞ খেলোয়াড়, সবাই পরিণত। আর ছিল এক জিনিয়াস। এত এত পরিণত খেলোয়াড় থাকার কারণে সেই জিনিয়াসের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা সহজ হয়েছিল। আমরা জানতাম, ম্যারাডোনার মতো অনন্য একজনকে কীভাবে আলাদা করে তুলে ধরতে হয়।’ ’৮৬ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন ম্যারাডোনা।

রিয়াল মাদ্রিদেও খেলেছেন ভালদানো। ছবিটি ২০১০ সালে তোলা
রয়টার্স

মেক্সিকোতে শিরোপা জয়ের পর অবশ্য ভাগ্য ভালদানোর প্রতি সদয় ছিল না। ১৯৮৭ সালে রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড় থাকা অবস্থায় তাঁর হেপাটাইটিস ‘বি’ ধরা পড়ে। বাধ্য হয়ে তুলে রাখেন বুটজোড়া। কিন্তু কোচ বিলার্দোর অনুরোধে তাঁকে ফিরতে হয়েছিল। ইতালিতে ১৯৯০ বিশ্বকাপ সামনে রেখে ভালদানোকে ফিরিয়েছিলেন বিলার্দো। শুনুন ভালদানোর মুখেই, ‘ওই প্রস্তাব গ্রহণ করাটা একটু অদ্ভুতই ছিল। আমি তিন বছর ধরে ফুটবলের বাইরে, হেপাটাইটিসের চিকিৎসা নিচ্ছি। শরীরও ভালো ছিল না। তবু বিলার্দো বললেন, ছয় মাস কষ্ট করো, বিশ্বকাপের জন্য...আমি রাজি হয়ে গেলাম।’

আরও পড়ুন

কিন্তু ভালদানো ১৯৯০ বিশ্বকাপে খেলেননি। ১৯৯০ সালের মার্চে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচটা আর্জেন্টিনার জার্সিতে ভালদানোর শেষ ম্যাচ। ’৯০ বিশ্বকাপে খেলতে না পারা নিয়ে ভালদানো বলেছেন, ‘আর্জেন্টিনায় ফিরে গিয়ে কঠিন অনুশীলন শুরু করলাম। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল। মাঝেমধ্যে পেশির সমস্যা হচ্ছিল। তবু চালিয়ে গেছি। কিন্তু রোমে পৌঁছানোর পর, বিশ্বকাপ শুরু হতে যখন বাকি মাত্র এক সপ্তাহ, বিলার্দো বললেন, তিনি আমাকে দলে দেখছেন না। কিন্তু আমি ইতালিতে থেকে গেলাম। বিশ্বকাপে ছিলাম,  তবে খেলোয়াড় হিসেবে নয়, কাদেনা সের-এর ধারাভাষ্যকার হিসেবে।’

বিলার্দোর সেই সিদ্ধান্তে দুজনের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হলেও ভালদানোর মনের ভেতর কোচের জন্য ভালোবাসাটা ছিল আগের মতোই, ‘সত্যি বলতে, বিলার্দোর সঙ্গে এরপর আর আমার কথা হয়নি। কিন্তু ১৯৮৬ সালের সেই সম্পর্কটা এতটাই মজবুত ছিল যে আমি তাকে ভালো না বেসে পারি না।’