ইয়ামালের আঁকানো–বাঁকানো পথের শেষে মেসি–ম্যারাডোনার বসতবাড়ি

ড্রিবল করে বের হয়ে যাচ্ছেন ইয়ামাল। তাঁকে ঠেকাতে না পেরে হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা আলাভেসের খেলোয়াড়েরএএফপি

মুভটি দেখার পর কী মনে হয়েছে? কেউ কেউ হয়তো অস্ফুটে বলে ফেলেছেন, এখন আর এমনটা তেমন দেখা যায় না!

দেখা যাবে কী করে? ফুটবলাররা পায়ে বেশিক্ষণ বল রাখতে পারবেন না—ইউরোপিয়ান ফুটবলে ব্যাপারটি বেশ আগে থেকেই অলিখিত নিয়ম। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে বেশির ভাগ দলের খেলায় ছাপটা দেখা যায়। আর্লিং হলান্ড কিংবা মোহাম্মদ সালাহর মতো তারকারাও সাধারণ পরিস্থিতিতে পায়ে কয়েক সেকেন্ডের বেশি বল রাখতে পারেন না।

স্প্যানিশ লা লিগায়ও তা–ই। বল আসবে, বাকিদের পজিশনের অবস্থা দেখে পাস দাও, কিংবা দুই পা এগিয়ে তারপর পাস দাও, নইলে একটু পিছিয়ে; তবু পাসই খেলো। তা না হলে বাতাসে ভাসানো দূরপাল্লার ফুটবল। তবু পায়ে বেশিক্ষণ বল রাখা যাবে না। কোচের এই মানসিকতার পেছনে যুক্তিও আছে। ফলনির্ভর ফুটবলে ব্যক্তিগত ঝলক দেখানোর জায়গা খুব সামান্যই। বল হারালে ঝুঁকিও কম নয়।

আরও পড়ুন

তবু মাঝেমধ্যে চোখে মায়াঞ্জনমাখা ওসব আঁকিবুঁকির ‘ছবি’ দেখা যায়। আশি–নব্বইয়ের দশকে যেসব ‘ছবি’ একটু বেশিই আঁকা হতো মাঠে। বিশ্লেষকেরা বলেন, তখন মাঠে তারকাদের স্বাধীনতা একটু বেশিই ছিল। তবে সময়ের পালাবদলে পরিস্থিতি পাল্টেছে।

লিওনেল মেসি কিংবা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো না হলে ‘লাইসেন্স টু ড্রিবল’–এর স্বাধীনতা নেই। প্রশ্ন হলো, মেসি–রোনালদোরা তো পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত খেলবেন না? বয়সের ভারে এখন তাঁদের কাছ থেকে ওসব ছবিও কম দেখা যায়, যেমনটা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিংবা রিয়াল মাদ্রিদে ছিলেন রোনালদো, বার্সেলোনায় মেসি। ঠিক এই জায়গাটাতেই প্রকৃতির একটি দারুণ বিষয়ের সঙ্গে ফুটবলও মিলে যায়।

খুব অল্প জায়গার মধ্যেও ড্রিবল করে বের হয়ে যেতে পারেন ইয়ামাল। যেটা মেসি–ম্যারাডোনার পায়েও দেখা গেছে
এএফপি

প্রকৃতি কখনো শূন্যস্থান রাখে না। ফুটবলও নয়। কেউ চলে গেলে কিংবা বয়স হয়ে গেলে, ঠিক তাঁর মতো না হোক, খেলার চলনে–বলনে তাঁর ছাপটা মাঝেমধ্যে ফুটে ওঠেই। আমরা সেসব দেখেই বলে ফেলি, অমুকের খেলা তাঁর মতো কিংবা তমুকের ওটা ওঁর মতো। যেমন ধরুন, লা লিগায় পরশু রাতে আলাভেসের বিপক্ষে ম্যাচের চতুর্থ মিনিটে লামিন ইয়ামালের অবিশ্বাস্য সুন্দর মুভটি। যেটা দেখে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যমে তোলপাড়; বলা হচ্ছে, আরে, এই ছেলেটা তো মেসি–ম্যারাডোনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে!

আরও পড়ুন

ইয়ামাল ‘পরবর্তী মেসি’—এ আলোচনা অনেক দিনের। অতএব তাতে অবাক হওয়ার বিশেষ কিছু নেই। ম্যারাডোনার নাম তাঁর ক্ষেত্রে উঠে আসে খুব খুব কম। যদিও ইয়ামালকে দেখে ম্যারাডোনাকে মনে পড়ে একজনের। মানুষটি সে কথা বলে রেখেছেন গত বছর সেপ্টেম্বরেই। ‘দারুণ খেলেছ ছেলে, তোমাকে দেখে আমার গ্রেট ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে মনে পড়ে’—ইয়ামালকে নিয়ে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছিলেন তাঁর বাবা মুনির নাসরাউয়ি।

পরশু রাতেও নিশ্চয়ই মনে পড়েছে বাবার? বরং আরেক ধাপ এগিয়ে বলা যায়, ইয়ামালের কাল রাতের এক মুভেই মেসি–ম্যারাডোনার খেলার সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গাটি ধারণ করা যায়। কী? ড্রিবলিং!

ডান প্রান্তে নিজেদের অর্ধে বল পেয়েছিলেন ইয়ামাল। পেছনে আঠার মতো সেঁটে ছিলেন আলাভেসের দুই ডিফেন্ডার। ইউটার্ন নিয়ে দুই ডিফেন্ডারকে পেছনে ফেলে ইয়ামাল যখন মাঝমাঠে ততক্ষণে তাঁর একটু পেছনে ডানে–বাঁয়ে দুজন, সামনেও আরেকজন। ইয়ামাল সামনের জনকে আউটসাইড ডজে এড়ালেও চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছিলেন মোট পাঁচজন। সামনে আলাভেসের যে খেলোয়াড়টি ছিলেন, সেই বেচারাকে ইনসাইড ডজে ফেলে দেওয়ার পর কাটালেন আরও একজনকে।

ইয়ামাল ততক্ষণে তিনি মাঠের ডান দিকে একটু সরে গেছেন। সামনেই আলাভেসের বক্স। ঠিক ওই পরিস্থিতিতে পাস দেওয়ার জন্য ইয়ামালের আশপাশে তাঁর তিন বার্সা সতীর্থ ছিলেন। কিন্তু সেটা তো কোচদের ফলনির্ভর খেলার কৌশল, সেটাই যদি হবে তাহলে তাঁকে মেসি–ম্যারাডোনার সঙ্গে তুলনা করা হবে কেন!

ইয়ামাল ভেবে রেখেছিলেন অন্য কিছু। আলাভেসের তিন খেলোয়াড় সামনে থাকতে বাঁ পায়ের টাচে বলটা একটু বাঁ দিকে সরানোর মুহূর্তের সামনের প্রতিপক্ষ ডজ খেয়েছেন। তাতে তিন প্রতিপক্ষের মধ্য দিয়ে বলটা পাস দেওয়ার জন্য সরু করিডরও পেয়ে যান। বুটের বাঁ পাশের অগ্রভাগ দিয়ে ‘ট্রিভেল্লা’র মতো পাস দেন সতীর্থ রাফিনিয়াকে। ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার পাসটি পেয়ে গোল করার নেশায় যে শটটি নিয়েছেন, সেটা ইয়ামালের ১০–১৫ সেকেন্ডের ম্যাজিকের সঙ্গে একদমই বেমানান।

ইয়ামালের খেলায় ফুটে উঠছে মেসি–ম্যারাডোনার সৌন্দর্য
এএফপি

অন্তত দর্শক তাই বলবেন। পোলাও–গোশত খাওয়ার পর মুখ মিষ্টি করতে কেউ নিশ্চয়ই বাতাসা খেতে চাইবে না!

কেমন ‘পোলাও–গোশত’, সেটা আরেকটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। সাত খেলোয়াড়কে কাটিয়েছেন ইয়ামাল। সেটাও ইনসাইড–আউটসাইড ডজে—আর্জেন্টাইন ফুটবলে যেটা ‘ট্রেডমার্ক’ কৌশল। মেসি থেকে ম্যারাডোনা বুটের অগ্রভাগ ও সাইড দিয়ে বলকে সাপের মতো এদিক–সেদিক করে প্রতিপক্ষের পর প্রতিপক্ষকে কাটিয়ে এগিয়ে গেছেন। স্প্যানিশ ইয়ামালের পায়েও ফুটেছে সেই সৌন্দর্য।

আরও পড়ুন

শুধু কি তাই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইয়ামালের বল পায়ে দৌড়টা দেখলে মেসির চেয়ে ম্যারাডোনাকে বেশি মনে পড়তে পারে। ’৮৬ বিশ্বকাপ কিংবদন্তির বল পায়ে সেই আত্মবিশ্বাসী দৌড়, লাখ দেওয়া দৌড়ের ওপরই এবং নিজে ফিনিশ না করে তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে দাঁড়ানো সতীর্থকে পাস দেওয়া—এটুকু পড়ে আপনার মনে হতে পারে, ম্যারাডোনার সেসব অমূল্য পাসের বেশির ভাগই তো গোলে রূপান্তরিত করতে পারেননি তাঁর সতীর্থ বুরুচাগা–ভালদানোরা। বুরুচাগা–ভালদানোর জায়গায় আপনি রাফিনিয়াকে বসিয়ে নিতে পারেন।

বার্সায় মেসির সোনালি সময়ে তাঁর সঙ্গে ডেভিড ভিয়ার (২০১০–১৩) মতো স্ট্রাইকার ছিলেন। কিংবা তার আগে ছিলেন স্যামুয়েল ইতো। তখনো মেসির অবিশ্বাস্য সব মুভ থেকে দেওয়া নিঃস্বার্থ পাসের সব কটিই গোল হয়নি। সেটা সম্ভবও না। তবে ইয়ামালের ওই মুভটি দেখে মেসি–ইতোদের সময়টাও মনে পড়তে পারে। কেন—সেই প্রমাণ দিচ্ছে পরিসংখ্যান।

আলাভেসের বিপক্ষে ইয়ামাল ড্রিবলিংয়ের চেষ্টা করেছেন ২১ বার, লা লিগার এক ম্যাচে বার্সেলোনার কোনো খেলোয়াড়ের যেটা রেকর্ড। টপকে গেলেন কাকে? ২০০৭ সালে মায়োর্কার বিপক্ষে মেসির ২০ বার ড্রিবলিংয়ের চেষ্টাকে! এই ম্যাচেই সর্বোচ্চ ১০টি সফল ড্রিবলিং করেছিলেন মেসি, ইয়ামাল টপকে গেছেন সেটাও (১১)। শুধু তা–ই নয়, লা লিগার এই মৌসুমের সবচেয়ে সফল ড্রিবলারও কিন্তু ১৭ বছর বয়সী এই উইঙ্গার। ৭৩টি সফল ড্রিবলিং, যেখানে ৬৪টি সফল ড্রিবলিং নিয়ে দুইয়ে সেভিয়ার উইঙ্গার দোদি লুকেবাকিও, ৪৬টি সফল ড্রিবলিং নিয়ে তিনে রিয়াল মাদ্রিদের কিলিয়ান এমবাপ্পে।

তবে এসব বিশ্লেষণের বাইরে সবচেয়ে সরল সত্যটি একদমই সরল। সেটা দর্শক দেখতে পান খালি চোখেই। মিলিয়ে নিতে পারেন মনের মুকুরে জমাটি মরে বসা নায়কদের সঙ্গে। ইয়ামাল বল পায়ে যে মুভটি করেছেন, সেটা বার্সায় মেসির সোনালি দিনগুলোর প্রতিচ্ছবি, আর্জেন্টিনা কিংবা নাপোলির জার্সিতে ম্যারাডোনার রাজত্বের খণ্ডচিত্র। তিনজনই বাঁ পায়ের ফুটবলার। বল পায়ে এঁকেবেঁকে যখন ছোটেন, ছোট্ট ছোট্ট লাফ দেন দৌড়ের ওপর—তখন (জার্সি একই হলে) দূর থেকে আসলে আলাদা করে চেনাই কষ্টের।

ইয়ামালকে নিয়ে তাই ‘মার্কা’র শিরোনাম ‘ম্যারাডোনার মতো মুভ’। এল মুন্দো দেপোর্তিভো লিখেছে, ‘নিখাদ মেসির স্টাইল’। এএসের শিরোনাম, ‘লামিনে ইয়ামাল আট ডিফেন্ডারকে টপকে...’।

তবে একটি ভুল সংশোধন করা জরুরি।

মার্কার দাবি, ইয়ামাল ছয় ডিফেন্ডারকে কাটিয়েছেন। এএসের দাবি, আট ডিফেন্ডার। আর এমনিতে ওই মুভের ভিডিও রিপ্লে দেখে মনে হয়, সাতজনকে কাটিয়েছেন। মজাটা হলো, মেসি–ম্যারাডোনাদের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, ইয়ামালের ক্ষেত্রেও ঠিক তা–ই। দারুণ কোনো মুভে কজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়েছেন, সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়তে হয়, তর্কবিতর্ক জমে ওঠে। কারণটা আমরা সবাই জানি। বল পায়ে মুভ এত দ্রুত, এত আঁকানো–বাঁকানো যে—শিল্পী ঠিক কয়টি আঁচড়ে, কীভাবে ছবিটি আঁকলেন, তা নয়, শুধু ছবিটাই মনে থাকে। কে জানে, গ্রেটদের বিশেষত্ব হয়তো এখানেই!

নিশ্চিত থাকুন, ইয়ামালও আছেন সেই পথেই। তাঁর এই আঁকানো–বাঁকানো পথের শেষ ঠিকানায় মেসি–ম্যারাডোনার বসতবাড়ি।