রুপাজয়ী খই খই গেমস খেলে পাওয়া টাকায় মা–বাবাকে ঘর বানিয়ে দেবেন
রাঙামাটির রাজস্থলীর পাহাড়ি গ্রামের ছোট মেয়েটি আজ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। নাম তাঁর খই খই সাই মারমা। বয়স মাত্র ১৮ বছর। ১৮ বছর বয়সী খই খইয়ের হাতেই বাংলাদেশ টেবিল টেনিসের ইতিহাসে রচিত হয়ে গেল এক নতুন অধ্যায়।
সৌদি আরবের রিয়াদে ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে জাবেদ আহমেদের সঙ্গে জুটি বেঁধে মিশ্র দ্বৈতে রুপা জিতে গতকাল দেশে ফিরেছেন খই খই। এই অর্জন বাংলাদেশের টেবিল টেনিস তথা ক্রীড়াঙ্গনেই অনেকটা অপ্রত্যাশিত। কারণ, এই পর্যায়ে বাংলাদেশ অংশ নেয় মূলত যতটা সম্ভব ভালো খেলার প্রত্যাশা নিয়ে।
দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে কোনো প্রতিযোগিতায় এটাই বাংলাদেশের প্রথম টেবিল টেনিস পদক। গত ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে নারী এককে সাদিয়া রহমান মৌ খেলেছিলেন কোয়ার্টার ফাইনালে।
সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন জাবেদ অনেক দিনের পরিচিত মুখ হলেও খই খইয়ের টেবিল টেনিসে উঠে আসার গল্পটা খুব বেশি দিনের নয়। এখনো তিনি জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হননি। তবে গত জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অনূর্ধ্ব-১৯ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন, সিনিয়রে খেলেছেন কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত।
কদিন আগে উডেন ফ্লোর জিমনেশিয়ামে ফেডারেশন কাপে জিতেছেন শিরোপা। যা তাঁর দ্রুত উন্নতির স্পষ্ট বার্তা। বাংলাদেশে মেয়েদের র্যাঙ্কিংয়ে খই খই এখন দ্বিতীয়, শীর্ষে সাদিয়া রহমান।
গত বছর জানুয়ারিতে টিটি ফেডারেশন আয়োজিত প্রাইজমানি র্যাঙ্কিং প্রতিযোগিতায় দ্বিমুকুট জেতেন খই খই। বালিকা অনূর্ধ্ব-১৯ একক ও মেয়েদের সিনিয়র এককে জেতেন শিরোপা। একই বছর জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথমবার জুনিয়রে সেরা হন।
কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা খই খইয়ের চলার পথটা অবশ্য মোটেই সহজ ছিল না। বাবা ক্যহ্লাখই মারমা কৃষক, মা মোহ্লাচিং মারমাও কৃষিকাজ করেন। একমাত্র বড় বোন খেলাধুলায় নেই, এলাকায় সাধারণ জীবন যাপন করেন। খই খই অনেক কষ্ট পেরিয়ে এসে এখন বিকেএসপির উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।
খই খইয়ের যাত্রা শুরু বান্দরবানের লামায় কোয়ান্টাম স্কুলে। যে স্কুল থেকে উঠে এসেছেন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন রামহিম লিয়ান বমও। অবৈতনিক হওয়ায় বাড়ি থেকে অনেক দূরে হলেও পরিবার তাঁকে ওখানে পাঠায়। সেখানেই কোচদের বাছাইয়ে টেবিল টেনিসে তাঁর হাতেখড়ি।
খই খই বলেন, ‘কোয়ান্টামে ভর্তি হই ২০১৫ সালে। আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকার কারণেই ছোটবেলায় কোয়ান্টামে পাঠানো হয় আমাকে। ওখানে বাছাই হতো কে কোন খেলায় যাবে। কোচরা আমাকে টিটিতে দেন। প্রথমে মজা করে খেলতাম। পরে খেলাটা ভালো লেগে যায়। খুব গুরুত্ব দিয়ে খেলা শুরু করি ২০১৭–১৮ সালে।’
এরপর আর পেছন ফেরা নয়। নিজেই বলেন, ‘কোয়ান্টাম থেকে হাসান মুনীর সুমন স্যার আমাকে, রেশমীকে, ঐশীকে ও রামহিম ভাইকে তিন বছরের জন্য ফেডারেশনে এনে খেলা, থাকা–খাওয়া, এমনকি বিকেএসপিতে ভর্তি করিয়ে পড়াশোনার ব্যবস্থাও করে দেন। এখান থেকেই আমার খেলার উন্নতি শুরু।’
রিয়াদ থেকে ফিরেই প্রথম আলোকে বললেন তাঁর স্বপ্নের কথা, ‘দুই বছর পর এসএ গেমসে ভালো করতে চাই। কমনওয়েলথ গেমসে টিটিতে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে বাংলাদেশের পুরুষ দল। সামনে লক্ষ্য থাকবে আরও ভালো করা। সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে চাই।’
পরিবারের স্বপ্ন নিয়েও বললেন খই খই, ‘গ্রামে আমাদের বাড়ির অবস্থা ভালো নয়। সলিডারিটি গেমসে খেলে যে টাকা পাব, তা দিয়ে মা-বাবার জন্য সুন্দর একটা বাসা (ঘর) বানিয়ে দিতে চাই।’ নিজের সাফল্যের পেছনে কৃতিত্ব দিলেন সব কোচ ও সংগঠককে, ‘আমার এই সাফল্যের জন্য আমি আমার সব কোচ, টেবিল টেনিস ফেডারেশন, বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিকেএসপি—সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।’
রাঙামাটির পাহাড় থেকে শুরু হওয়া পথটি এখন অনেক দীর্ঘ হওয়ার অপেক্ষায়। খই খই সাই মারমা সত্যিই যেতে চান অনেক দূর।