‘আজ আমাদের সবার সামনে তুলে ধরেছেন, দুদিন পর যেন খোঁজ থাকে আমাদের’

এশিয়ান ইনডোরে পদক জেতা জহির রায়হান ও মাহফুজুর রহমানসংগৃহীত

বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসে এমন দিন আগে কখনো আসেনি। আগের রাতে তেহরান থেকে ফিরে আজ বিকেলে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আসেন জহির রায়হান ও মাহফুজুর রহমান। এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিকসে ৪০০ মিটারে জেতা রুপার পদক জহিরের গলায়, মাহফুজুরের গলায় হাই জাম্পে জেতা ব্রোঞ্জ পদক। পদকের সঙ্গে ফুলের মালাও। হাতে ফুলের তোড়া, ক্রেস্ট।

বাংলাদেশের অবহেলিত অ্যাথলেটরা দেশে ফিরলে এমন ফুলেল শুভেচ্ছা খুব কমই পেয়েছেন। সেই শুভেচ্ছা জানিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন। ইভেন্টটি কাভার করতে সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। জহির-মাহফুজুর দুজনই একের পর এক সাক্ষাৎকার দিয়ে গেলেন। দুই তরুণ অ্যাথলেটের জন্য যা নতুন অভিজ্ঞতাই। দুজনের কথার মূল সূর, সুযোগ–সুবিধা পেলে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে (এসএ গেমস) সোনা জেতা সম্ভব তাঁদের পক্ষে। এখন তাঁরা সেই স্বপ্নই দেখছেন।

এসএ গেমসে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকসে সর্বশেষ সোনা জিতেছিল ২০০৬ সালে, কলম্বোতে। ১১০ মিটার হার্ডলসে সোনা জিতেছিলেন মাহফুজুর রহমান মিঠু। ২০১৯ সালে সর্বশেষ কাঠমান্ডু এসএ গেমসে জিতেছিল একটি রুপা ও তিনটি ব্রোঞ্জ। রুপাটা জিতেছিলেন এবারের এশিয়ান ইনডোরে ব্রোঞ্জজয়ী মাহফুজুর রহমানই। এবার অবশ্য এসএ গেমসের চেয়ে কম উচ্চতায় লাফিয়ে। এসএ গেমসে পেরিয়েছিলেন ২.১৬ মিটার, এশিয়ান ইনডোরে ২.১৫।

এশিয়ান ইনডোর আর এসএ গেমসের একটা তুলনা তাই চলেই আসে। যে প্রশ্ন করায় মাহফুজুর বললেন, ‘এসএ গেমসে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ ৭টি দেশ থাকে। আর এশিয়ান ইনডোরে জাপান, চীন, কোরিয়া, মালয়েশিয়ার মতো অনেক দেশের অ্যাথলেট খেলেছে। এসব দেশের সেরারাই খেলেছে। ফলে লড়াইটা কঠিনই হয়েছে। হাই জাম্পে প্রথম হওয়া জাপানের অ্যাথলেট ২.১৯ মিটার লাফিয়েছে।’

আরও পড়ুন

গত এসএ গেমসে হাই জাম্পে রেকর্ড ২.২১ মিটার লাফিয়ে সোনা জিতেছিলেন ভারতের সারভেস অনিল কুশারে। তাহলে কি এসএ গেমসটাই বেশি কঠিন? মাহফুজুরের উত্তর,‌ ‘দুটির সঙ্গে তুলনা করলে হবে না। তেহরানে তাপমাত্রা ছিল মাইনাস। আমার ইভেন্টের সময় ৩ ডিগ্রি। এই আবহাওয়া আমার জন্য নতুন। তা ছাড়া আমি ও জহির প্রথমবার খেলেছি এই প্রতিযোগিতায়। আর প্রথমবার খেলেই পদক জিতেছি। এটা দারুণ সাফল্য আমাদের জন্য।’

বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রকিব এমনও বলছিলেন, আরও দু–একটি ইভেন্টে অ্যাথলেট পাঠাতে পারলে আরও পদক আসত, ‘এশিয়ান ইনডোরে মাঝারি মানের দেশগুলোর জন্য পাঁচ অ্যাথলেট আর একজন কর্মকর্তার কোটা থাকে। এর বাইরে পাঠাতে চাইলে নিজ খরচে পাঠাতে হবে। আমাদের টাকা থাকলে আরও অ্যাথলেট পাঠাতে পারতাম, তাতে আরও পদক আসতে পারত।’

পদকজয়ীদের গলায় মালা পরিয়ে দেন বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রকিব
সংগৃহীত

এবার দুটি পদক আসাও বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসে বিশাল অর্জনই। কিন্তু এসএ গেমসে কেন পারছেন না বাংলাদেশের অ্যাথলেটরা? এসএ গেমস আর এশিয়ান ইনডোরের পাথর্ক্য কী? জহির রায়হান নিজের উপলব্ধির কথাটা বললেন, ‘এশিয়ার শীর্ষস্তরের প্রতিযোগিতার মর্যাদাই আলাদা। এখানে লড়াইটাও কঠিন। ২০১৯ কাঠমান্ডু সাফ গেমসে আমি ৪০০ মিটারে দৌড়েছি। কিন্তু তখন আমার সেরা টাইমিং ছিল না। মাত্র ১৯ বছরের উঠতি খেলোয়াড় আমি তখন। সেবার কিছুটা অসুস্থও ছিলাম। এসএ গেমসে আমি পারব না, এমন নয়।’

তারপরই দিলেন একটা চ্যালেঞ্জ, ‘এসএ গেমসকে আপনারা বড় করে দেখেন। এসএ গেমসে জিতলে সংবধর্নাও বেশি। কিন্তু এশিয়ান ইনডোরে এশিয়ার সেরারা খেলে। আমার এখন যে টাইমিং, তাতে সুযোগ–সুবিধা পেলে বলতে পারি, এসএ গেমসে আমার কাছে সোনার আশা রাখতে পারেন।’

আরও পড়ুন

এ জন্য করণীয় কী, সেটাও বলে দিলেন, ‘আমরা যদি সঠিক অনুশীলন চালিয়ে যেতে পারি, তাহলে আগামী দিনে আরও ভালো করতে পারব। অ্যাথলেটদের সুযোগ-সুবিধার যে ঘাটতিগুলো রয়েছে, এগুলো যদি পুরোপুরি দূর করা যায়, তাহলে আশা করা যায় শুধু এশিয়ান লেভেলে নয়, অলিম্পিক লেভেলেও আমরা পারব। এটা আমাদের দ্বারা সম্ভব।’

২০১৭ সালে নাইরোবিতে বিশ্ব জুনিয়রে ৪০০ মিটারে সেমিফাইনালে উঠেছিলেন জহির। সেটা উল্লেখ করে তাঁর আক্ষেপ, ‘তখনকার চেয়ে আমার এখনকার এই অবস্থা কেন? দায়ী কে? আপনারা না আমরা? ভালো সুযোগ–সুবিধা কে দেবে? তখন থেকে আমি বিদেশে প্রশিক্ষণ পেলে আজ ইমরান ভাইয়ের মতো ভালো কিছু করতে পারতাম।’

জহির–মাহফুজদের অ্যাথলেটিকস–ক্যারিয়ারে এমন সময় কমই এসেছে
সংগৃহীত

এই আক্ষেপের মধ্যেই উঠে আসে আসল কথাটা। জহির বলতে থাকেন, ‘যদি আমাদের ভালো সুযোগ–সুবিধা না দেন, তাহলে আমরা সামনে এগোতে পারব না। আজ আমাদের সবার সামনে তুলে ধরেছেন, দুদিন পর যেন খোঁজ থাকে আমাদের। আপনাদের কাছে এটাই আমার আশা।’

এশিয়ান ইনডোরে পদকের আশা আগে ছিল কি না, প্রশ্নে তাঁর উত্তর,‌ ‘কিছুদিন আগে আমার একটা জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ ছিল, তখনই একটা টার্গেট নির্ধারণ করেছিলাম। এশিয়ান ইনডোরে যদি যাওয়া হয়, তাহলে আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব একটা ভালো কিছু করার। আমি ওইভাবেই নিজেকে তৈরি করেছিলাম। যাঁরা আমার সঙ্গে কাজ করেছেন, আমার সংস্থা নৌবাহিনী, ফেডারেশন, বিওএ সবাইকে ধন্যবাদ। এ ছাড়া আমি ট্রেনিং করেছি বিকেএসপিতে। সবার সহযোগিতায় আজকে আমি এই অর্জন আনতে পেরেছি।’

আরও পড়ুন

গত বছর এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিকসে ৬০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জিতে ইতিহাস গড়েছিলেন ইমরানুর রহমান। সেই সাফল্যের পথ ধরেই এবার দুটি পদক এল। কিন্তু ইমরান এবার পদক জিততে পারেননি। তবে ইমরানকে অভিনন্দন জানাতে চান জহির, ‘ওনাকে দেখে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। তাঁকে দেখে আমাদের মনের মধ্যে একটা ভালো জেদ কাজ করেছে যে না, উনি পারছেন, আমরাও পারব।’

বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন গত কিছুদিনে শুধু ১০০ মিটারে ইমরানুরকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু অন্য ইভেন্টেও যে ভালো করা যায়, সেটা দেখা গেল তেহরানে। এ নিয়ে জহির বলেন,‘আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কাকে দেখুন। তারা কিন্তু শুধু ১০০ মিটার নিয়ে পড়ে নেই। যে ইভেন্টগুলো ভালো করবে, বিশ্বমঞ্চে আলো ছড়াবে, সেই ইভেন্টগুলো নিয়ে এখন কাজ করছে বাংলাদেশে অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনও। থ্রো ইভেন্টগুলো একসময় ভালো ছিল না, এখন কিন্তু এই ইভেন্টগুলো ভালো করছে। লং জাম্পেও ভালো করছি আমরা। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের এখন অন্য রকমভাবে যত্ন নেওয়া হচ্ছে। আশা করা যায়, শুধু ১০০ মিটার নয়, যে ইভেন্টগুলো ভালো করবে, এদের যদি সুন্দরভাবে অনুশীলন এবং যত্ন করা হয়, আমরাও বিশ্বদরবারে ভালো করব।’

একই আশার কথা শোনা গেল মাহফুজুরের মুখেও। সঙ্গে জানিয়েছেন নিজের চাওয়াও, ‘আমার চাওয়া হলো, যদি দীর্ঘমেয়াদি অনুশীলন করতে পারি, তাহলে দেশের জন্য আরও ভালো কিছু বয়ে আনতে পারব। দেশের বাইরে যদি অনুশীলন করতে পাঠানো হয়, তাহলে ভালো হবে।’ ফুলেল শুভেচ্ছায় আত্মবিশ্বাসী দেখায় দেশে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ১৩ বার হাই জাম্পে সোনাজয়ী কুষ্টিয়ার কুমারখালীর তরুণকে।

আরও পড়ুন