সাক্ষাৎকারে সাইম আইয়ুব  

‘যে ধরে খেলতে পারে, সে মেরেও খেলতে পারবে’

পিএসএল দিয়ে সাইম আইয়ুবের আলোচনায় আসা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকও টি-টোয়েন্টি দিয়ে। কিন্তু তাঁকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ব্র্যাকেটে বন্দী করা যাবে না। কদিন আগেই অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট অভিষেকে প্রথম ইনিংসে শূন্য রানে আউট হলেও পরের ইনিংসে ৩৩ রানেই বুঝিয়ে দিয়েছেন নিজের সামর্থ্য। সাবেক ক্রিকেটাররা তাঁকে বলছেন বিশ্ব ক্রিকেটের ‘নেক্সট বিগ থিং’। এবারের বিপিএলে ২১ বছর বয়সী সেই সাইম খেলছেন দুর্দান্ত ঢাকার হয়ে। কাল দলটির টিম হোটেলে সাইম শোনালেন তাঁর ক্রিকেট-যাত্রার গল্প।

প্রথম আলো:

বিপিএল কেমন লাগছে?

সাইম আইয়ুব: খুব ভালো। গতবারও এসেছিলাম। খুব বেশি ম্যাচ খেলা হয়নি। এই বছর বেশ উপভোগ করছি। কোচ, ক্রিকেটার—দলের সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। দলের মধ্যে পরিবেশ ভালো থাকলে খেলে মজা পাওয়া যায়। মাঠের খেলায় শুরুতে হারলেও পরে জয়ের ধারায় ফেরা যায়। পরিবেশটা ভালো থাকলে ক্রিকেট খেলার আনন্দটা উপভোগ করা যায়।

প্রথম আলো:

কিন্তু দলের অবস্থা তো ভালো না।

সাইম: হ্যাঁ, এখনই আমাদের ছন্দে ফেরার সময়। কারণ চার ম্যাচ হয়ে গেছে। জয় এসেছে একটিতে। প্লে-অফে যেতে হবে, আমাদের জিততে হবে।

প্রথম আলো:

আপনার ক্যারিয়ারে আসি। ক্রিকেট খেলা শুরু হলো কীভাবে?

সাইম: আমার বাবার খেলার শখ ছিল। বড় ভাইও অ্যামেচার ক্রিকেট খেলেন দুবাইয়ে, ব্যাংকের হয়ে। আমার বয়সে থাকা অবস্থায় সে-ও ক্রিকেটার হতে চেয়েছিল। কিন্তু বাবা মানা করেন। তাঁকে পড়ায় মন দিতে বলেন।

সাবেক ক্রিকেটাররা সাইমকে বলছেন বিশ্ব ক্রিকেটের ‘নেক্সট বিগ থিং’
এএফপি
প্রথম আলো:

আপনাকে মানা করেননি?

সাইম: না, কেউ মানা করেননি। কারণ আমি সবচেয়ে ছোট।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

ছোটবেলায় ফ্ল্যাটের বন্ধুদের সঙ্গে অনেক ক্রিকেট খেলেছেন…

সাইম:হ্যাঁ। শুরুটা সেভাবেই। রাস্তায়, ফ্ল্যাট, পার্ক—সব জায়গায় টেপ বল ক্রিকেট খেলেছি। 

প্রথম আলো:

অনেক কিছু ভেঙেছেন নিশ্চয়ই।

সাইম: অনেক কিছু। মানুষজন আমার ওপর খুব বিরক্ত ছিল। বল মারতে থাকতাম, জানালায়, এসিতে। অনেকের ঘুম ভাঙিয়েছি বল মেরে। বাবা ও ভাই এসব দেখে আমাকে করাচির পিআইএ একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন।

প্রথম আলো:

আপনার বলতে হয়নি—তাঁরাই ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন?

সাইম: হ্যাঁ। বাবা বলেছেন, তোমার যেহেতু খেলার শখ, তোমাকে একাডেমিতে দিয়ে দিচ্ছি। সেটা শখেরবশেই। পরে শখ ধাপে ধাপে পেশায় পরিণত হয়েছে। একাডেমি থেকে শেখা শুরু। এরপর শিখতে শিখতে ক্লাব ক্রিকেট খেলেছি। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট, এরপর পিএসএল। এখন জাতীয় দল। আমি পাকিস্তান ক্রিকেটের সব ধাপেই খেলে জাতীয় দলে এসেছি।

'মানুষজন আমার ওপর খুব বিরক্ত ছিল'
দুর্দান্ত ঢাকা
প্রথম আলো:

বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই সবাই আপনাকে বলা হয় পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ তারকা। এত অল্প বয়সে এত বড় কথা শুনতে কেমন লাগে?

সাইম: খুব ভালো। আমি ২০১৮ সালে অনূর্ধ্ব-১৬ দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়া সফরে সবচেয়ে বেশি রান করেছিলাম। তখনই সবাই আমার প্রশংসা করছিল। এটা আমাকে আরও পরিশ্রম করার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। কারণ আমাকে পরের বছরই অনূর্ধ্ব-১৯ খেলতে হতো। আমি সেখানেও সবচেয়ে বেশি রান করেছি। সেখান থেকে পিএসএল। কিন্তু পিএসএলের শুরুটা আমার ভালো হয়নি। ওই ব্যর্থতাটা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। ব্যর্থতা না এলে আপনি তরতরিয়ে ওপরের দিকে যেতে থাকবেন, কিন্তু নিজের খুঁত চোখে পড়বে না। মাঝেমধ্যে ব্যর্থতাও সাহায্য করে।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

কীভাবে?

সাইম:খুব দ্রুতই বুঝতে পেরেছি যে পেশাদার ক্রিকেট কেমন হতে পারে। সাফল্য এলে বেশি ওড়া যাবে না। কারণ হুট করেই নিচে নেমে এলে আপনি মানসিকভাবে হয়তো সামলাতে পারবেন না। তাই ভালো-খারাপ—সব সময়ই একরকম থাকতে হবে।

প্রথম আলো:

অনূর্ধ্ব-১৬ দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়া সফর আর এবারের অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট অভিষেকের পার্থক্যটা বলুন।

সাইম: অনূর্ধ্ব-১৬ দলের সিরিজে বড় কোনো স্টেডিয়ামে খেলার সুযোগ হয়নি। ক্লাবের মাঠে খেলেছি। সেই সফরে এক বিশ্রামের দিন আমাদের এমসিজিতে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়। সবচেয়ে উঁচু স্ট্যান্ড থেকে মাঠ দেখানো হয়। পাঁচ বছর পর এবার যখন এমসিজির মাঠে ঢোকার পর সবার আগে আমার ওই স্ট্যান্ডের দিকে চোখ গিয়েছে। প্রথমবার মনে হয়েছিল, কে জানে, কবে আমি এখানে খেলতে পারব। এবার সেখানেই দাঁড়িয়ে সেই স্মৃতি মনে পড়ছিল। ওই মুহূর্তটা খুব ভালো লেগেছিল।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

দেশের হয়ে টেস্ট, টি-টোয়েন্টি খেলে ফেলেছেন। ওয়ানডেটা বাকি। নিশ্চয়ই তিন সংস্করণের খেলোয়াড় হতে চাইবেন?

সাইম: তিন সংস্করণেই আমার সমান আগ্রহ। কদিন আগেই তো ওয়ানডে বিশ্বকাপ শেষ হলো। এখন আমাদের কোনো ওয়ানডে ম্যাচ নেই। যখন আসবে, তখন হয়তো নির্বাচকেরা চিন্তা করবেন। তবে আমার আগ্রহ তো তিন সংস্করণেই।

তিন সংস্করণেই সমান আগ্রহ সাইমের
পিসিবি
প্রথম আলো:

নিজেকে কীভাবে তিন সংস্করণের জন্য তৈরি করছেন?

সাইম: দেখুন, টেস্ট ক্রিকেটে যদি মানিয়ে নিতে পারেন, তাহলে আপনার সাদা বলের ক্রিকেট এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। আপনি ব্যাটসম্যান, বোলার কিংবা ফিল্ডার হন, সবার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। আমাদের মতো তরুণ যাঁরা আছেন, তাঁদের লাল বলের খেলাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তাতে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিও সহজ হয়ে যায়। আপনি যদি টেস্ট ক্রিকেট খেলেন, তাহলে অন্য দুই সংস্করণে আপনাকে অতটা সময় দিতে হবে না। কিন্তু টেস্ট না খেলে শুধু সাদা বলের ক্রিকেট যতই খেলেন, আপনাকে টেস্ট ক্রিকেটকে প্রতিবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে।

'আপনাকে যদি সুপারস্টার বা লেজেন্ড হতে হয়, তাহলে আপনাকে টেস্ট ক্রিকেট খেলতে হবে।'
প্রথম আলো
প্রথম আলো:

বিরাট কোহলি, বাবর আজমরাও তারকা হয়েছেন তিন সংস্করণের ক্রিকেট দিয়ে। আপনার ভাবনাও অনেকটা তাঁদের মতো।

সাইম: আপনি ক্রিকেট-বিশ্বে তাকিয়ে দেখুন…যাঁরা সুপারস্টার, লেজেন্ড, তাঁরা সবাই তিন সংস্করণের খেলোয়াড়। তাঁরা কখনো টেস্ট ক্রিকেট মিস করেননি। আপনাকে যদি সুপারস্টার বা লেজেন্ড হতে হয়, তাহলে আপনাকে টেস্ট ক্রিকেট খেলতে হবে। 

প্রথম আলো:

আপনার ব্যাটিংয়ের সঙ্গে সাঈদ আনোয়ারের অনেক মিল। দুজনই বাঁহাতি, দুজনই আক্রমণাত্মক।

সাইম: সাঈদ আনোয়ার পাকিস্তানের কিংবদন্তি। সাঈদ আনোয়ার একজনই। অন্য কেউ তাঁর মতো হবেন না। মানুষ বলে, আমি তাঁর মতো খেলি। আমি যদিও এভাবে কখনো চিন্তা করিনি। শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু আমি শুধু সাইম আইয়ুবই হতে পারব, সাঈদ আনোয়ার নয়। উনি যখন আমার বয়সী ছিলেন, তখনো তাঁকে কেউ চিনত না। এরপর তিনি নিজের নাম বানিয়েছেন। আমিও ধীরে ধীরে নিজের নাম বানাতে চাই। তাঁর মতো কিংবদন্তি হতে চাই।

প্রথম আলো:

লেগের দিকে উড়িয়ে মারা শটটা নিয়ে জিজ্ঞেস করতে চাই। এই শটটা নিয়ে নিশ্চয়ই আপনাকে অনেকবার প্রশ্ন করা হয়েছে।

সাইম: ভাই, লোকজন এ নিয়ে এত কথা বলে ফেলেছে যে এখন বোলাররা আমাকে ওই জায়গায় বলই দেয় না (হাসি)। অনেকবার এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। অনেকেই এটা নিয়ে কথা বলে। তবে আমি ওই শট নিয়ে একদমই চিন্তা করি না। এটা হয়ে যায়। আর এই শটটা খেলা যায়, বোলার যখন বাজে বল করে। আর বাজে বল খুব বেশি আসবে না, এটাই স্বাভাবিক। তবে আমি অনুশীলনে নিয়মিত এই শট খেলি। ম্যাচে এমনিতেই হয়ে যায়। 

প্রথম আলো:

এই শট নিয়ে যত আলোচনা, ততটা কিন্তু আপনার ডিফেন্সিভ টেকনিক নিয়ে হয় না। আপনার ডিফেন্সও তো যথেষ্ট ভালো।

সাইম: একটু আগে যেমন বললাম, লাল বলের ক্রিকেট খেললে আপনার ডিফেন্স ও বেসিক ভালো হবে। তখন বাকি সব সহজ হয়ে যায়। যে ধরে খেলতে পারে, সে মেরেও খেলতে পারবে। সে জন্য শুধু কিছুটা শক্তি দরকার, যা আমার নেই (হাসি)।