বাংলাদেশের শুটিংয়ে এক উজ্জ্বল নাম শারমিন আক্তার রত্না। কমনওয়েলথ শুটিং ও এসএ গেমসে সোনা জিতেছেন, ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কিন্তু গৌরবের বাইরের গল্পটা ভিন্ন—বিবাহবিচ্ছেদ, বাবাকে হারানো আর জীবনের নানা টানাপোড়েন। এখন দুই শিশুকন্যাকে নিয়ে নতুন করে জীবনসংগ্রামে লড়ছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ আলম।
সম্প্রতি আপনার বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে, দুই সন্তানকে নিয়ে একা লড়ছেন। জীবন কেমন চলছে?
রত্না: জীবন সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং। ১৮ বছরের অভ্যাস হঠাৎ ভেঙে গেছে, ছোট দুই সন্তান নিয়ে ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে। মাহ্-নুর কাওনাঈন রূপের বয়স ৯ বছর। আফিরা কাওনাঈন রায়ার বয়স ২ বছর ৯ মাস। তবে পরিবারের সাপোর্ট আমাকে শক্ত রেখেছে। কিন্তু বাবাকে হারানোটাই আমাকে সবচেয়ে কষ্ট দেয়।
প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছিল কীভাবে?
রত্না: সে আমার আপন খালার সৎছেলে। আগে থেকেই পরিচিত ছিলাম। ক্লাস টেনে পড়ার সময় প্রথমে মোবাইলে কিছুদিন কথা হয়েছিল, ভালো লেগেছিল। পরে বিষয়টি পরিবার জেনে যায়, বিয়ে হয় আমাদের। আমার কাছে ভালোবাসা মোহমায়ার মতো মনে হয়েছিল, যা সে অন্য কোথাও খুঁজে পেয়েছে এত বছর পর।
এখন সংসার কীভাবে চলছে?
রত্না: প্রথমে আর্থিক সমস্যা ছিল, এখনো আছে। বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়, আমাদের বিবাহ বিচ্ছেদের এক বছর পর গত বছর ২৪শে আগস্ট তিনি মারা যান। বাবা রফিকুল ইসলাম সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হিসেবে ২০০৮ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে গিয়েছিলেন। তিনি সাভারে ছয়তলা একটি বাড়ি করেছেন। সেখানেই আমি থাকি।
সন্তানদের খরচ কে দেন?
রত্না: বিবাহবিচ্ছেদের পর বাচ্চার স্কুলে ভর্তি ফিও আমার কাছে ছিল না। তাদের টুকটাক খরচ, নিজের খরচ বাবার একার পক্ষে দেওয়াটাও বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। বাচ্চাদের বাবা কোনো খরচ দিচ্ছে না বা দেয়নি।
ডিভোর্সের ঘটনাপ্রবাহের শুরুর দিকে, আমার ছোট বাচ্চাটার বয়স তখন মাত্র ছয় মাস, আমি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। দুই বাচ্চার জন্য একটা ডিম পর্যন্ত কেনার টাকা ছিল না! আমি একেবারেই কপর্দকশূন্য, ভয়াবহ অসহায়। যদিও আমার বাবা ও শ্বশুর সাহায্য করেছেন অনেক।
তাহলে আপনি টিকে আছেন কীভাবে?
রত্না: ২০১০ সলে দিল্লিতে কমনওয়েলথ শুটিংয়ে ব্যক্তিগত ও দলীয় সোনা জয়ের পর তখনকার বাংলাদেশ শুটিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবলু চাচা আমাকে একটি রাইফেল উপহার দিয়েছিলেন, যেটি দিয়ে আমি ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে অংশ নিই। কিন্তু বিচ্ছেদের পর সন্তানদের স্কুল ফি ও নিজের খরচ চালানোর জন্য আমি সেটি আমি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বিক্রি করে দিই। দাম পেয়েছিলাম ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। সন্তানদের জন্য প্রিয় রাইফেলটাও ছাড়তে হয়েছে।
এখন যদিও সবকিছু আম্মা সামলাচ্ছেন। আমার ও আমার বাচ্চাদের দায়িত্ব পুরোপুরি আমার মা ও বোনেরা সামলাচ্ছে। মেজ বোন রাফিয়া আক্তার জনতা ব্যাংকে ক্যাশ অফিসার। সেজ বোন আয়েশা সিদ্দিকা কংকা বিবিএ কমপ্লিট করে চাকরির প্রিপারেশন নিচ্ছে। ছোট বোন আমিনা সিদ্দিকা রজনী সিটি ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশে অনার্স করছে। আমি সবার বড়। আমার নিজস্ব কোনো আয় নেই এখন।
অবশ্যই বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার একটু দুশ্চিন্তা আছে। তারপরও আল্লাহর ওপর ভরসা রাখছি।
জীবনের সবচেয়ে কষ্টের স্মৃতি?
রত্না: বাবা তখন ইউএন মিশনে অ্যাঙ্গোলাতে। দেশে বেতন আসত ফুফুর নামে। আমরা মাগুরায় থাকতাম, ফুফু ঢাকায়। ওই একটা বছর বেশ কষ্টে কেটেছে। নানাবাড়ি থেকে চাল আসত।
একদিন ঘরে চাল শেষ হয়ে গেল। তখন আমরা দুজন আর মা তিনজনই থাকি আমাদের বাড়িতে। এক রাতে না খেয়ে ছিলাম, কারণ ঘরে চাল ছিল না। মায়ের কাছে টাকাও ছিল না। এমনকি নানাবাড়ি গিয়ে আম্মা যে চাল নিয়ে আসবে, সেই যাওয়ার টাকাটাও ছিল না। জীবনে একবারই এক বেলা না খেয়ে থাকতে হয়েছে খাবারের অভাবে।
আপনার জীবনটা এমন হওয়ার কথা ছিল?
রত্না: হয়তো না। আমার জীবনটা সোনায় মোড়ানো না। ছোটবেলার একটা স্বপ্নের কথা বলি। জুতা সাধারণত এক জোড়া থাকত। বাবার আয় ছিল কম। তিনি ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে। বিশাল এক পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে। সরকারি রেশন পেতেন, আমরা সরকারি স্কুলে পড়েছি বলে আমাদের পেছনে খুব একটা খরচ করতে হয়নি। তবে এমনও বছর গেছে যে বাইরে পরে যাওয়ার জুতা নেই। শুধু স্কুলের এক জোড়া জুতা।
এমনও বছর গেছে, ঘুরতে গেলেও স্কুলের জুতা পরেছি বা কোনো বছর বাইরে পরে যাওয়ার জুতা স্কুলে পরে গিয়েছি। ছোটবেলায় একটা স্বপ্ন ছিল—বড় হয়ে আয় করব আর অনেক জুতা কিনব।
সেই স্বপ্ন তো আপনার পূরণ হয়েছে...
রত্না: তা হয়েছে। জানেন, আমার চার বছর বয়সে আব্বুর খাগড়াছড়ি বদলি হয়। সেখানে আমরা দু–তিন বছর ছিলাম। ওই সময় পাশের বাসায় টিভি দেখতে যেতাম। একদিন ওই বাসার আন্টি বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বের করে দেন, কাঁদতে কাঁদতে ঘরে আসি। বাবা পরদিনই টিভি কিনে নিয়ে আসেন। কীভাবে টাকা ম্যানেজ করেছিলেন, জানি না। তবে আমার কান্না দেখে বাবা ঠিকই টিভি কিনে আনেন।
রত্না খুব রাগী, অভিযোগটা কি সত্যি?
রত্না: শর্ট টেম্পারড বলতে পারেন। আমি প্রচণ্ড রাগী। তবে মা হওয়ার পর আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে শিখেছি অনেকটা।
অনেকেই বলে ‘রত্না কঠিন মানুষ’, আপনি কী বলবেন?
রত্না: ওপরে কঠিন! তবে আমি শুটিং পরিবারকে অনেক ভালোবাসি। আর যাদের ভালোবাসি, তারা আমার সঙ্গে যা-ই করুক না কেন, এসে যদি একটু ভালোভাবে কথা বলে, আমি ভুলে যাই সবকিছু।
খেলোয়াড় হিসেবে এখনো কোন ভুলের জন্য আফসোস করেন?
রত্না: অনুশীলনে খুব কম সময় দিয়েছি। দ্রুত মানিয়ে নিতে পারায় প্র্যাকটিসও দ্রুত শেষ হয়ে যেত। এখন মনে হয়, সময়টাকে আরও কাজে লাগানো উচিত ছিল। যদি আরও নিবেদিত হতাম, অনেক দূর যাওয়া সম্ভব ছিল।
আপনি তো ক্রিকেট পছন্দ করেন না, কেন?
রত্না: আমি ক্রিকেট পছন্দ করি, কিন্তু শুধু এক খেলাকে কেন্দ্র করে যে উচ্ছ্বাস ও বৈষম্য দেখি, তা আমার ভালো লাগে না। খেলাধুলার মূল উদ্দেশ্য জাতিকে সুস্থ, কর্মঠ ও ভ্রাতৃত্ববোধপূর্ণ রাখা। ক্রিকেটারদের অতিরিক্ত মূল্যায়নের কারণে তারা সেরাটা দিতে ব্যর্থ হয় এবং অন্য খেলোয়াড়দের অবমূল্যায়ন করা হয়। এই বৈষম্যই আমাকে ক্রিকেট থেকে দূরে রেখেছে।
খেলাধুলায় সবচেয়ে বিরক্তিকর প্রশ্ন, যা আপনাকে বারবার শুনতে হয়?
রত্না: নারী হয়ে খেলাধুলায় কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়—এ প্রশ্ন আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর। সবাই জানে সমস্যা আছে, তবে সেগুলো দূর কেন হয় না? বারবার সমস্যার কথা জিজ্ঞাসা করা বিরক্তিকর ছাড়া আর কী!
শুটিং ছাড়া আপনার প্রিয় অন্য খেলা?
রত্না: ফুটবল! প্রিয় দল আর্জেন্টিনা, প্রিয় খেলোয়াড় মেসি।
প্রিয় খাবার?
রত্না: বাঙালি যেকোনো খাবার।
প্রিয় গান?
রত্না: কেটি পেরির ‘ফায়ারওয়ার্ক’।
প্রিয় সিনেমা?
রত্না: শার্লিজ থেরনের ‘টালি’।
প্রিয় ভ্রমণস্থান?
রত্না: নানাবাড়ি, মাগুরা।
আপনি বেশি সকালে ওঠা মানুষ, নাকি রাতজাগা মানুষ?
রত্না: প্রচুর রাত জাগি, অনেক সময় লুডু খেলি।
সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু বা সহখেলোয়াড়?
রত্না: আবদুল্লাহ হেল বাকি।
আপনার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত?
রত্না: দুবার মা হওয়া।
সবচেয়ে বড় আফসোস?
রত্না: মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিয়ে করা।
ভবিষ্যতে আবার বিয়ে করার ইচ্ছা আছে?
রত্না: ভালো মানুষ পেলে ইচ্ছা আছে। তবে এখন বাচ্চাদের সঠিকভাবে বড় করার চেষ্টায় আছি।
এক শব্দে ‘রত্না’কে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
রত্না: আনস্টপেবল।
পদক জেতার পর প্রথম যাঁকে মনে পড়ে?
রত্না: আমার মা। তিনি বলেছিলেন, খেলাধুলা করে আমি পুরো বিশ্ব জয় করে নিয়ে এলেও তিনি খুশি হবেন না। কারণ, আমি লেখাপড়া করে কোনো কিছু অর্জন করিনি।
সবচেয়ে ভালো লাগে কী করতে?
রত্না: সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটাতে, খেলতে। ওরা পাশে থাকলে মনে হয় সব সমস্যাই পেরোতে পারব। ওরা আমাকে আরও শক্ত করেছে।
যদি শুটার না হতেন—কী হতেন?
রত্না: লিডার, পলিটিক্যাল লিডারও হয়তো। নেতৃত্ব দিতে আমার ভালো লাগে।
জীবনের এমন কোনো কথা আছে, যা কখনো কাউকে বলেননি?
রত্না: যখন শিশু শ্রেণিতে পড়তাম, আমার স্কুলের ধর্ম শিক্ষকের কাছে অ্যাবিউজিংয়ের শিকার হয়েছিলাম। এ কথা এখনো কাউকে বলা হয়নি। আজ আপনাকে বললাম।
নিজেকে নিয়ে বই লিখলে নাম কী রাখবেন?
রত্না: রত্ন আভা! অনেক কষ্ট করে আলো ছড়িয়েছি, তাই এমন নাম।
কী ভালো লাগে, চা না কফি?
রত্না: চা।
ভাত না বিরিয়ানি?
রত্না: ভাত।
খেলা শেষে পুরস্কার হিসেবে ফুল না টাকা, কোনটা পেতে ভালো লাগে?
রত্না: টাকা। কারণ, টাকা দিয়ে ফুল কিনে নেওয়া যাবে।
বাসায় সবচেয়ে বেশি কে আপনাকে বকাঝকা করে?
রত্না: আমার মেজ বোন।
রাগ উঠলে কী করেন?
রত্না: চুপ থাকি এবং প্রচুর পানি পান করি।
যদি সিনেমায় অভিনয়ের ডাক পান—নায়িকা না ভিলেন, কোনটা করতে চান?
রত্না: ভিলেন! কারণ, ভিলেনের চরিত্রটা প্রায় একই থাকে। আমিও চরিত্র বদলাই না।
পদক জেতার পর প্রথম কী খেতে ইচ্ছা করে?
রত্না: এক বোতল ঠান্ডা পানি!
আড্ডায় গেলে গল্প বেশি করেন, না শুনে যান?
রত্না: আমি প্রচুর কথা বলি। তবে কোনো আড্ডায় গেলে আমি শুনি।
যদি একটা সুপারপাওয়ার পেতেন—কী চাইতেন?
রত্না: মানুষের মন বোঝার ক্ষমতা!
অবসরে কী করেন?
রত্না: গল্পের বই পড়ি।
জীবনের প্রথম প্রেম?
রত্না: শুটিং।
যদি শুটিং বাদে অন্য কোনো খেলা খেলতে বলা হয়, তাহলে কী খেলতেন?
রত্না: বাস্কেটবল।
বেড়ানোর প্রিয় জায়গা?
রত্না: পাহাড়ি এলাকা, খাগড়াছড়ি।
জীবনের সবচেয়ে বড় কমপ্লিমেন্ট?
রত্না: আমি নাকি অনেক সহজ-সরল।