অধিনায়ক লিটন যা করতে চেয়েছেন, যা করতে পেরেছেন

টি–টোয়েন্টি অধিনায়ক হিসেবে এক বছর পার করেছেন লিটন দাস। বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে জিতেছেন ৫টি সিরিজ। এ সময়ে দল চালানোর অভিজ্ঞতা, খেলার ধরন, বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগসহ নেতৃত্বের নানা দিক নিয়ে কাল কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহমুদুল হাসান

প্রথম আলো:

 টি–টোয়েন্টি অধিনায়ক হিসেবে এক বছর পার করে দিলেন। নিজের প্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পেরেছেন?

 লিটন: প্রত্যাশার তো শেষ থাকে না। যত ভালোই করেন, সব সময়ই মনে হবে, আরেকটু যদি ভালো হতো। কিন্তু সব মিলিয়ে যদি দেখেন, আমরা ৩০ ম্যাচের ১৫টিতে জিতেছি, পাঁচটি সিরিজ জিতেছি এই এক বছরে; মানুষ তখনই জেতে, যখন কোনো কিছুতে তার উন্নতি হয়।

প্রথম আলো:

 টি–টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ কখনোই তেমন ভালো দল ছিল না। যখন অধিনায়কত্ব নিলেন, একটু কি ভয়ও কাজ করছিল যে কী হবে?

লিটন: অধিনায়কত্ব আমার কাছে কখনোই কঠিন মনে হয় না, এ জন্য ভয়ও ছিল না। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আসল জিনিস হচ্ছে, আপনার কাছে কেমন অস্ত্র আছে। এদিক থেকে নিজেকে সৌভাগ্যবানই মনে করি—যাদের আমি অস্ত্র হিসেবে পেয়েছি, তারা টি–টোয়েন্টিতে খুবই ভালো। আপনি যদি ১ থেকে ৮ নম্বর পর্যন্ত ব্যাটসম্যানদের দেখেন, তারা সবাই আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করে। আমার হাতে এমন দুই-তিনজন স্পিনার আছে, যারা টি-টোয়েন্টি সংস্করণে অনেক দিন ধরে সফল। পেস বোলিংয়ের কথা তো আলাদা করে কিছু বলার নেই, তারা সব সময়ই ভালো করছে। হ্যাঁ, দু–একটা জায়গায় নতুন করে তৈরি করতে হয়েছে, ওসব জায়গায় কিছুটা ঘাটতি ছিল। সেগুলোও আস্তে আস্তে পূরণ হয়েছে।

হাত থেকে গ্লাভস খুলে মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাচ্ছেন লিটন দাস। সঙ্গে আছেন সতীর্থরাও
প্রথম আলো
প্রথম আলো:

 ঘাটতিগুলো কেমন?

লিটন: অলরাউন্ডারের জায়গায় একটা ঘাটতি ছিল। সেই জায়গাটাতে আমরা তানজিমকে তৈরি করার চেষ্টা করেছি। আপনি যদি তার শুরুর দিকের ব্যাটিং দেখেন, আর এখনকার দেখেন; পার্থক্য খুঁজে পাবেন। এখন সে নিজেকে একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে ভাবা শুরু করেছে, বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে ব্যাটিং করতে পারে।

প্রথম আলো:

  এই জায়গায় তো আপনাকেও একটা কৃতিত্ব দেওয়া হয়। কেউ ব্যর্থ হলেও হুটহাট দলে পরিবর্তন আনেননি বলে।

লিটন: আমি খুব ভালোভাবেই জানি, একটা খেলোয়াড়ের যখন খারাপ সময় যায়, তখন কেমন লাগে। কারণ, আমি নিজেও অনেক খারাপ সময় পার করেছি। সেই অভিজ্ঞতাটাকে এখন অধিনায়ক হিসেবে কাজে লাগাই। আমি জানি কোনো খেলোয়াড় যখন খারাপ সময় কাটায়, তখন তার কতটুকু সাপোর্ট বা মেন্টাল বুস্টআপ দরকার হয়। সেই জায়গা থেকেই খারাপ সময় কাটানো খেলোয়াড়টাকে সাহায্য করার চেষ্টা করি।

ক্রিকেটে কেউ প্রতিদিন ভালো খেলবে না, প্রতিদিন খারাপও করবে না। জীবনের মতো এখানেও একটা ভারসাম্য আছে। যে ভালো খেলছে, তাকে তো আর খুব বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যে খারাপ খেলছে, তাকে নিয়ে আমার আলাদা করে ভাবতে হয়, সাপোর্ট দিতে হয়, বোঝাতে হয় এটাই একটা ক্রিকেটারের জীবন। আপনি একজনকে যত সমর্থন দেবেন, ততই ওই খেলোয়াড়টা খারাপ সময় থেকে বেরিয়ে আসবে।

আরও পড়ুন
স্ত্রী দেবশ্রী বিশ্বাসের সঙ্গে লিটন দাস। গতকাল উত্তরায়
প্রথম আলো
প্রথম আলো:

  এ কারণেই কি আয়ারল্যান্ড সিরিজের পর ট্রফিটা মাহিদুলের হাতে দিলেন?

লিটন: যে নতুন দলে আসবে, তার প্রতি আলাদা একটা দায়িত্ব থাকে। যেহেতু অনেক দিন ধরেই আমরা ১৭–১৮ জন খেলোয়াড় খেলছিলাম, অঙ্কন (মাহিদুল) সেখানে নতুন ছিল। এ জন্য মনে হয়েছে, ট্রফিটা ওরই সবচেয়ে বেশি প্রাপ্য। কারণ, ও হঠাৎ এই সিরিজে আছে, ট্রফিটা ওর হাতে গেলে আমার মনে হয় মানসিকভাবে অন্তত সে মনে করবে, আমি এই দলেরই অংশ। ভবিষ্যতের জন্যও অনুপ্রেরণা পাবে।

প্রথম আলো:

 আপনার এমন সমর্থনের কারণে যে ক্রিকেটাররা স্বাধীনতা নিয়ে খেলছে, তা–ও তো অনেকটা স্পষ্ট। এ বছর বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা ছক্কা মারার রেকর্ড গড়েছে…

 লিটন: ছক্কা মারাটা আসলে নির্ভর করে ওই খেলোয়াড়টা কেমন। আপনাকে আগেও যেটা বললাম, আমি দল হিসেবে এতজন ক্রিকেটার একসঙ্গে পেয়েছি, যারা অনেক ছক্কা মারতে পারে। কেউ যদি ছক্কা মারতে পারে, গো ফর ইট, ভয়ের কিছু নেই। এটা কখনো বন্ধ হওয়া উচিত না, অধিনায়ক হিসেবে আমি তা করবও না। আপনি দেখবেন, যারাই যখন বড় ইনিংস খেলে, তারা ছক্কা মারে। এই কৃতিত্বটা কোচিং স্টাফের সবাইকেও দিতে হবে, তারাও অনেক মেহনত করেছে। নেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাটসম্যানদের নিয়ে কাটিয়েছে, খারাপ সময়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। আপনি অনুশীলনে যত বেশি বল খেলবেন, আপনার তত উন্নতি হবে।

প্রধান কোচ ফিল সিমন্স, সিনিয়র সহকারী কোচ মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন ও অধিনায়ক লিটন দাস
প্রথম আলো
আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

 এ বছর আপনি ২৫ ম্যাচে ৬৩৫ রান করেছেন, ২৩টি ছক্কাও মেরেছেন। টি–টোয়েন্টি দলে ব্যাটসম্যান হিসেবে আপনার ভূমিকাটা কেমন?

লিটন: যখন আমি টি–টোয়েন্টি অধিনায়ক হই, তখনই আমার মাথায় ছিল এই দলের সবাই আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করে। আমারও তাদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে, ব্যাটসম্যান হিসেবেও একটা জায়গায় যেতে হবে। অধিনায়ক হওয়ার আগে আমিও খুব একটা ভালো খেলছিলাম না টি–টোয়েন্টিতে। আমার চেষ্টা ছিল আমি তাদের সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে নিয়ে ক্রিকেটটা খেলতে পারি। উন্নতির তো শেষ নেই। তবে চেষ্টা করেছি, পাওয়ার হিটিংয়েও কীভাবে আরও উন্নতি করা যায়।

প্রথম আলো:

 কিন্তু বছরের সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্টে এশিয়া কাপেই আপনি চোটে পড়ে গেলেন…

লিটন: আমি থাকলে ফাইনাল খেলতাম কি না জানি না। কিন্তু পরপর দুইটা এশিয়া কাপে চোটে পড়লাম, কোনো খেলোয়াড়ের জন্যই এটা কাম্য না। কারও সঙ্গেই যেন এমন না হয়। কারণ, বড় মঞ্চে গিয়ে ভালো খেলার স্বপ্ন সবারই থাকে। তার ওপর আমি যেহেতু দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম, দলের অবস্থাও ভালো ছিল। ওখান থেকে না খেলতে পারাটা হতাশার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এর মধ্যেও একটা ভালো দিক খুঁজে বের করেছি, আমি দুইটা ম্যাচ খেলিনি, সেখানে একটা খেলোয়াড় বড় মঞ্চে ম্যাচ পেল।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

  টি–টোয়েন্টিতে ভালো বছরেও দুশ্চিন্তা বলতে তো মিডল অর্ডারটাই রয়ে গেছে। বিশ্বকাপের আগেও এ নিয়ে অনেক কথাও হচ্ছে…

লিটন: একটা মজার ব্যাপার কি খেয়াল করেছেন, বিশ্বকাপটা কিন্তু এ বছর না, আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে (হাসি)। এ বছর ওরা খারাপ খেলেছে, বিশ্বকাপে ভালো করবে। সমস্যা নাই।

বাংলাদেশ টি–টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক লিটন দাস
ইনস্টাগ্রাম
পরিবারের মধ্যে অনেক সময় মানুষের ঝগড়াঝাঁটি হয়, অনেক কথাবার্তা ওঠে। তাই বলে কি কেউ পরিবার ছেড়ে চলে যায়? উত্তর হলো, না।
লিটন দাস, অধিনায়ক, বাংলাদেশ টি–টোয়েন্টি দল
প্রথম আলো:

 শেষ সিরিজে আপনি দল নিয়ে অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন। অধিনায়ক হিসেবে বোর্ড–নির্বাচকদের সঙ্গে কি আপনার দূরত্ব আছে?

লিটন: আমার কাছে মনে হয় না খুব একটা ইস্যু ছিল। যদি তা থাকত, তাহলে তো অনেক কথাই জানতেন। পরিবারের মধ্যে অনেক সময় মানুষের ঝগড়াঝাঁটি হয়, অনেক কথাবার্তা ওঠে। তাই বলে কি কেউ পরিবার ছেড়ে চলে যায়? উত্তর হলো, না।

আমি যেহেতু একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও দায়িত্ববান মানুষ এবং একজন বাবাও—আমার ভেতরে ওই দায়িত্বজ্ঞানটুকু আছে যে নিজের দলকে এভাবে ছেড়ে যাওয়াটা আমার জন্য উচিত না। অনেক জিনিসই অনেক সময় মনের সঙ্গে মেলে না। কিন্তু আমার মনে হয় যে এরপর থেকে এই জিনিসগুলো নিয়ে আর কোনো ইস্যু হবে না।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

  আপনি সেদিন প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেনকে নিয়েই অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে কি পরে কথা হয়েছে?

 লিটন: হ্যাঁ, হয়েছে।

প্রথম আলো:

  বাংলাদেশের তিন সংস্করণে এখন আবার তিন অধিনায়ক। এটাকে ঠিক মনে করেন?

 লিটন: এটা নিয়ে আমি খুব একটা চিন্তাই করি না। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য যাকে দিয়ে ভালো হবে, বিসিবি তাকেই পছন্দ করবে। সেটা যদি তিন সংস্করণে তিনজন হয়, সেটাই ভালো। যদি একজন হয়, সেটাও ভালো। আমার কথা হচ্ছে যিনি হোক, তা যেন ভালোর জন্য হয়।

প্রথম আলো:

  এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?

 লিটন: প্রত্যাশা সহজ, ভালো ক্রিকেট খেলব। ভালো ক্রিকেট খেললে জিতব। যদি ভালো ক্রিকেট না খেলতে পারি, হেরে যাব। অধিনায়ক হিসেবে তো চাইবই প্রতিটি ম্যাচ জিততে। আমরা নির্দিষ্ট দিনে ভালো খেলছি কি না এটাই আসল, আমার মনে হওয়া দিয়ে কোনো কিছু হবে না।

আরও পড়ুন