গত বছর এপ্রিলে আপনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন। দেড় বছর হয়ে গেল, এ সময়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
মুশতাক: যখন আমি দায়িত্ব নিয়েছি, তখনই জানতাম ভালো একটা অভিজ্ঞতা হবে এটা। রিশাদকে দেখলে বুঝতে পারবেন, এ সময়ে সে কতটা উন্নতি করেছে। তিন সংস্করণেই আমাদের স্পিনাররা ভালো করছে। আমি তাদের বেসিক কিছু টেকনিক্যাল ও টেকটিক্যাল বিষয় নিয়ে কাজ করেছি। পিচটাকে পড়তে পারা, ফিল্ড পজিশন কেমন হওয়া উচিত, তা বোঝা, প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে বুঝতে পারা, ম্যাচের পরিস্থিতি জানা—এসব আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
টি–টোয়েন্টিতে যে আমরা পাঁচটি সিরিজ জিতলাম—এটাতে স্পিনারদের ভূমিকা অনেক। সাদা বলের ক্রিকেটে মাঝের ওভারগুলোয় উইকেট নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, স্পিনাররা উইকেট নিলে আপনার ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। পাওয়ার প্লের সময়ও আমাদের স্পিনাররা বল করতে ভয় পায় না, উইকেট নেয়। আমার কাজ হচ্ছে ওদের ওপর থেকে চাপ কমিয়ে তাদের টেকনিক্যাল ও টেকটিক্যাল জিনিসগুলো বোঝানো, তারাও দ্রুতই এসব শিখছে।
বাংলাদেশের স্পিনারদের তো বল তেমন ঘোরাতে দেখা যায় না। এটা নিয়ে কি কাজ করেছেন?
মুশতাক: স্পিনার হলে বল ঘোরাতেই হবে। বাংলাদেশের পিচ স্পিনারদের জন্য কখনো কখনো এতই সহজ হয়ে যায়, বল ঘোরাতে খুব বেশি মনোযোগের দরকার হয় না। বল ঘোরানো ও টার্ন করানোর মধ্যে তফাত আছে। টার্নটা আপনি পিচ থেকে পেয়ে যাবেন আর বলটা নিজেকে ঘোরাতে হয় বাতাসে। ভালো স্পিনাররা এশিয়া বা বাইরে—সব জায়গাতেই সুবিধা করতে পারে।
এমনকি তাইজুলের মতো অভিজ্ঞ, যার টেস্টে আড়াই শ উইকেট আছে—তাকেও আমি কয়েকটা টেস্ট ধরে বলছি ভিন্ন ভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে বল স্পিন করানোর চেষ্টা করতে। আপনি যদি অস্ট্রেলিয়ায় যান, ওখানে আপনাকে বল ঘোরাতে জানতে হবে টার্ন করানোর জন্য। আমার প্রথম কাজ হচ্ছে ওদের এটা বোঝানো—বল ঘোরানোর জন্য কোনো কন্ডিশন বা উইকেটের দরকার নেই। আঙুল আর রিস্ট পজিশনটা ভালো হলেই চলবে।
আপনি দেড় বছরে উন্নতির কথা বলছিলেন। এ সময় রিশাদের উত্থানটাই তো সবচেয়ে নজরকাড়া...
মুশতাক: এটার পুরো কৃতিত্বই রিশাদের। এক বছর ধরে সে অনেক পরিশ্রম করেছে। সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে অ্যাকশন নিয়ে। আগে সে একই অ্যাকশনে টানা বল করতে পারত না। এখন সে তার অ্যাকশনটা ভালো বুঝতে পারছে। আগে হয়তো একটা ভালো বল করত, কিন্তু একটা ভালো ওভার করতে পারত না—এখন তা পারছে। এই জিনিসটা ঠিক হওয়ার পর এখন বল আরও বেশি ঘোরানো আর গুগলি নিয়ে কাজ করছে। দেখেছেনই তো, গুগলিতে উইকেটও পাচ্ছে। তিন সংস্করণের অধিনায়ক ও কোচরাই তার কাছে উইকেট চায়। আমি যখন খেলোয়াড় ছিলাম, তখন আমার কাছেও ইমরান খানের এমন চাওয়া ছিল। এ জন্য আমি জানি, ও হয়তো কিছু রান দিয়ে দেবে, কিন্তু ম্যাচটা জেতানোর ক্ষমতাও তার আছে। শুরুতে আমরা অ্যাকশন ও বেসিকগুলো নিয়েই কাজ করেছি। ব্যাটসম্যানকে পড়তে পারা, পিচ বোঝা, কেমন গতিতে বল করতে হবে—এগুলোও সে এখন ভালো বুঝতে পারছে।
আপনি গুগলির কথাও বললেন। খুব বেশি দিন ধরে রিশাদ গুগলি করছেন না। গুগলি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কীভাবে কাজ করলেন?
মুশতাক: আমার মনে হয়, রিশাদ এখন তার রিস্ট পজিশনটা বুঝতে পারছে। যখন আপনি গুগলি করতে যাবেন, তখন বডির শেপ হারিয়ে ফেলবেন, মাথা একদিকে হেলে যাবে—এটাকে আমি সহজ করার চেষ্টা করেছি। ওকে বলেছি, শুধু রিস্ট পজিশনটা বদলালেই হবে, এমনকি গ্রিপও বদলানোর প্রয়োজন নেই। সে এই কথা মাথায় রেখে অনেক অনুশীলন করেছে, একইভাবে বারবার বল করেছে, এভাবেই গুগলি শিখেছে। গুগলিতেও লেগ ব্রেকের মতোই বলটা একই অ্যাঙ্গেল থেকে আসবে, শুধু রিস্ট পজিশনটা বদলাতে হবে, লেগ স্পিনের চেয়ে উল্টোভাবে। বলটা একটু বেশি তালু থেকে বেরোবে, লেগ স্পিনের ক্ষেত্রে যেটা আঙুল থেকে বেরোয়।
আপনার মতে, রিশাদের সবচেয়ে শক্তির জায়গা কোনটা?
মুশতাক: লেগ স্পিনার হিসেবে সাহসটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি যখন অন্য কোচ বা অধিনায়কদের নিয়েও ওর সঙ্গে বসি, আমাদের সবারই তাকে নিয়ে ভাবনা একই রকম। লেগ স্পিনার হিসেবে সে খরুচে হতে পারে, কিন্তু আমরা বলে দিয়েছি—যদি তুমি ৪ ওভারে ৫০ রানও দাও, কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু আমাদের ৩–৪ উইকেট এনে দিতে হবে। উইকেটই আপনাকে ম্যাচ জেতাবে, কম রান নয়। ড্রেসিংরুমের সবাইও ওকে এই বিষয়ে সমর্থন জোগাচ্ছে। আমরা জানি, তার খারাপ দিন যেতে পারে। এখনো আরও উন্নতির জায়গা আছে। আমার মনে হয়, ৩০–৪০ শতাংশ কাজ এখনো বাকি। অ্যাঙ্গেলের ক্ষেত্রে, অ্যারাউন্ড দ্য উইকেট বোলিংয়ে উন্নতি করতে হবে।
ভালো মোটিভেটর হিসেবেও আপনার একটা খ্যাতি আছে। মানসিক দিক থেকে তাঁকে নিয়ে কী ধরনের কাজ করেছেন?
মুশতাক: তাকে মানসিকভাবে শক্ত রাখাটাও আমার কাজেরই অংশ। আমি তাকে এটাই বলেছি, মানুষের কী বলল, তা নিয়ে ভাববে না। তোমাকে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে তুমিই সেরা। আর যদি সেরা হতে চাও, তাহলে পরিশ্রম করতে হবে, অ্যাকশন–ভেরিয়েশন, বোলিংয়ের সবকিছু নিয়েই কাজ করতে হবে।
মানসিকভাবে নিজেকে বুঝতে পারাটা গুরুত্বপূর্ণ—যদি নিজের প্রতি বিশ্বাস থাকে, তাহলে আল্লাহও তাকে সাহায্য করে। সে খুবই ধার্মিক ছেলে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে এবং এটা বিশ্বাস করে যে সবকিছুই আল্লাহর তরফ থেকে হচ্ছে। এটা তাকে সাহায্য করে। আমি লেগ স্পিনার ছিলাম বলে আরও ভালোভাবে জানি, মানসিকভাবে আপনাকে শক্তিশালী হতে হবে—যদি কেউ ছক্কা মেরে দেয়, পরের বলটা গুরুত্বপূর্ণ। উইকেটও পেয়ে গেলে পরের বলটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভালো–খারাপ যেমন দিনই কাটুক, পরের দিন আপনাকে আবার লড়াইয়ে নামতে হবে এবং নিজের সেরাটা দিতে হবে।
এখন তো তাঁর অনেক তারকাখ্যাতিও বাড়ছে। বাংলাদেশে তারকাদের নিয়ে অনেক আগ্রহ থাকে। কাউকে কাউকে খ্যাতি ভুল পথেও নিয়ে যায়…
মুশতাক: আমি মনে করি, রিশাদ ও বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য এই খ্যাতিটা গুরুত্বপূর্ণ। যখন ক্লাবের অথবা স্কুলের কোনো ক্রিকেটার দেখবে, একজন লেগ স্পিনার অনেক উইকেট পাচ্ছে, তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। তখন সে রোল মডেল হয়ে উঠবেই। রিশাদের ক্ষেত্রে একটা ভালো ব্যাপার হচ্ছে সে খুবই ভদ্র ছেলে। এখন শুধু তার আশপাশে ভালো মানুষ দরকার।
এটা আমাদের দায়িত্ব রিশাদকে বোঝানো যে তুমি তারকা হতে পারো, কিন্তু সেটা পারফরম্যান্সের কারণেই হয়েছ, তোমার আচরণের কারণে না। অনেক তরুণেরই খ্যাতি পেলে আচরণ বদলে যায়। ভাবে সবকিছু অর্জন করে ফেলেছে। কিন্তু তাদের বুঝতে হবে যে এটা মাত্রই শুরু।
রিশাদকে ধারাবাহিক হতে হবে—নিজের পারফরম্যান্সকে মূল্য দিতে হবে। পারফরম্যান্সটাই তার তারকাখ্যাতি। যদি পারফর্ম করতে থাকে, তাহলে নাম অনেক অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। সে যেন পা মাটিতে রাখে, এটা দেখা আমাদের দায়িত্ব। আপনি ভালো ক্রিকেটার হতে পারেন, কিন্তু একই সঙ্গে ভালো মানুষ হওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ।
রিশাদ তো বিগ ব্যাশে খেলতে গেছেন। অস্ট্রেলিয়ায় খেলাটা তাঁকে কীভাবে সাহায্য করতে পারে?
মুশতাক: আমারও অস্ট্রেলিয়ায় ভালো রেকর্ড আছে, ওখানের উইকেট লেগ স্পিনারদের সঙ্গে মানানসই। কারণ, বাউন্সটা একটু বেশি থাকে। আমি রিশাদকে বলেছি কেমন গতিতে বলতে করতে হবে। ওখানে একটু আস্তে বল করতে হয়, কারণ উইকেটই গতিময় হয়। এশিয়ায় হয়তো ৮০ থেকে ৯০–৯৫ কিলোমিটার গতিতে বল করে, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় করতে হবে ৮০–এর আশপাশে। আর অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানরা সামনের দিকে খুব ভালো খেলে, এ জন্য কিছুটা আস্তে বল করতে হবে আর বলও একটু আগে ফেলতে হবে। আমি আশা করি, সে খুব সফল হবে ওখানে।
সাদা বলের ক্রিকেটে তো রিশাদ একরকম প্রতিষ্ঠিতই হয়ে গেছেন। তাঁর টেস্ট খেলতে আর কত দিন লাগবে বলে মনে হয়?
মুশতাক: সবাই–ই এ বিষয়ে আগ্রহী। নির্বাচকেরা তাকে লাল বলের ক্রিকেটে খেলতে পাঠিয়েছে, তাকে এটা বুঝতে হবে কীভাবে দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটে বল করতে হয়। আগেও যেটা বললাম, সে টেকনিক্যালি ভালো হচ্ছে আরও। রিশাদের যে ধরনের স্কিল আছে, আমার মনে হয় তাকে তিন সংস্করণেই দরকার। টেস্টে বিশেষত শেষ চারজন ব্যাটসম্যান লেগ স্পিনারের রং’আন মানে ভালো গুগলি বুঝে উঠতে পারে না। বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রায়ই দেখা যায় টেলএন্ডাররা রান করে ফেলে। রিশাদ ভালো ফিল্ডার, ব্যাটও করতে পারে। আজ হোক বা কাল, সে টেস্ট খেলবেই।