প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১০ হাজার রান হয়ে গেল। ক্যারিয়ারের শুরুতে কি ভেবেছিলেন এত রান করবেন?
মার্শাল আইয়ুব: না। আমি যখন খেলা শুরু করি, বাংলাদেশ তখন মাত্র কয়েক বছর হলো টেস্ট ক্রিকেট খেলছে। এ রকম কোনো লক্ষ্য ঠিক করার বাস্তবতাও ছিল না। তখন জাতীয় দলে খেলাটাই ছিল স্বপ্ন। পরে যখন ৬-৭ হাজার রান হলো, মনে হলো কাছাকাছি যেহেতু চলে এসেছি, তাহলে চেষ্টা করা যাক।
২০০৫ সালের ডিসেম্বরে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট অভিষেক। ২০ বছর লম্বা ক্যারিয়ার হবে, সেটা কি ভেবেছিলেন?
মার্শাল: অনূর্ধ্ব-১৭–তে থাকতেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা শুরু করি। তখন দেশে এত ক্রিকেটার ছিল না। আমাদের ব্যাচের কয়েকজনকে তাই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২০ বছর হয়ে গেছে ভাবলে একটু অবাকই লাগে। তবে ফিটনেসটা সব সময় ভালো রেখেছি, না হলে বড় বড় ইনিংস খেলা কঠিন।
এত বছর ক্রিকেট চালিয়ে যেতে অনেক শারীরিক আর মানসিক শক্তির প্রয়োজন হয়। কোনো একটা অনুপ্রেরণাও লাগে...
মার্শাল: আমাদের দেশে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের মূল্য অনেক কম। টেস্ট যারা খেলে, তাদেরই মূল্য নেই। অন্য দেশগুলোতে দর্শক থেকে শুরু করে সবাই-ই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের অনেক সম্মান করে। দেশের বাইরের ক্রিকেটারদের দেখতাম, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অনেক রান আছে। তখন মনে হতো, যেহেতু জাতীয় দলের আশপাশেও এখন আর রাখে না—প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এমন কিছু অর্জন করি, যেটা পরের প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
মাত্র তিনটি টেস্টেই থেমে আছে আপনার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। জাতীয় দলে ক্যারিয়ার লম্বা হলো না কেন?
মার্শাল: আমি ঘরোয়া ক্রিকেট খেলি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে, জাতীয় দলে আমাকে নামিয়ে দিয়েছিল ৩ নম্বরে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই জায়গায় টিকে থাকা কঠিন। টেস্ট ক্রিকেট এমনিতেই অনেক চ্যালেঞ্জিং—নামই তো ‘টেস্ট’! কখনো আপনাকে দ্রুত রান করতে হবে, কখনো ডট খেলতে হবে, কখনো শুধু সময় পার করে দিতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জ আমি সব সময় মিডল অর্ডার হিসেবেই নিয়েছি। জাতীয় দলে আমাকে ৩ নম্বরে নেমে একদম নতুন বল তো খেলতে হয়েছে।
আপনার কি মনে হয় আপনি সুযোগও একটু কম পেয়েছেন?
মার্শাল: দুই মৌসুম ১ হাজারের ওপরে রান করে আমি জাতীয় দলে ঢুকি। আমার কথা যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বলবে, সুযোগ কম পেয়েছি। এই আক্ষেপ তাই আছে। তবে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ভুলটা আমারই। যদি পারফর্ম করতে পারতাম, তাহলে হয়তো আরও টেস্ট খেলতে পারতাম।
মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমাকে একেবারে ছুড়ে না ফেলে দিলেও পারত। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পরও জাতীয় লিগ, বিসিএলে সর্বোচ্চ রান করেছি। তবু আমাকে কোথাও ডাকা হয়নি। তখনকার নির্বাচকদের হয়তো মনে হয়েছে, আমাকে দিয়ে হবে না।মার্শাল আইয়ুব
এখন তাহলে আফসোস নেই?
মার্শাল: নাহ্, আমাকে তো তা–ও সুযোগ দিয়েছে। অনেক খেলোয়াড় তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলতেই পারেনি। তবে মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমাকে একেবারে ছুড়ে না ফেলে দিলেও পারত। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পরও জাতীয় লিগ, বিসিএলে সর্বোচ্চ রান করেছি। তবু আমাকে কোথাও ডাকা হয়নি। তখনকার নির্বাচকদের হয়তো মনে হয়েছে, আমাকে দিয়ে হবে না। কিন্তু প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আমি পারফর্ম করে গেছি। তাঁরা তবু আমাকে কোথাও ডাকেননি। এই মৌসুমেও যে দুইটা সেঞ্চুরি করলাম, ১০ হাজার রান হলো—ক্রিকেট বোর্ডের ফেসবুক পেজেও আমাদের ছবি নেই। আমি পেজগুলো ফলো করি, দেখি আমাদের কোনো ছবি-টবি আসে না। কালকে (পরশু) আমার কাছে কিছু ছবি চেয়েছে। আমার কাছ থেকে ছবি নিয়ে তারপর তারা দিয়েছে যে ১০ হাজার রান করেছি। চিন্তা করেন, আমরা কোথায় আছি! তরুণ ক্রিকেটারদের জন্যও এটা খারাপ উদাহরণ। সে দেখছে যে জাতীয় দলে খেলতে না পারলে কোনো মূল্য নেই। আমাদের এখানে এমনিতেই একটা প্রথা চালু হয়ে গেছে, ৩০–এর পর কেউ খেলতে পারে না। কিন্তু অভিজ্ঞদের যে দীর্ঘ সংস্করণের ক্রিকেট খেলাটা ভালো, এটা বোঝে না। আমাদের দেশে অনূর্ধ্ব-১৯–এর পর যে মূল্যটা দেওয়া হয়, ২৫–এর পর পরিণত হয়ে গেলে তা দেওয়া হয় না।
২০ বছরে বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কী পরিবর্তন দেখেছেন?
মার্শাল: আমরা যখন শুরু করি, তখন এসজি বলে খেলা হতো। উইকেটগুলো এখন ভালো হয়েছে। কিন্তু ব্যাটসম্যানরা গত পাঁচ-ছয় বছর বড় ইনিংস খুব কম খেলছে। আমার মনে হয়, ডিউক বলের মানটা ভালো না তেমন। ডিউক বল সুইং করবে তা ঠিক আছে, কিন্তু মারলেও যায় না। বল অনেক ভারী। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে মানের বল দিয়ে খেলা হয়, ঘরোয়াতে হয়তো তা দেওয়া হয় না। তবে অনেক কিছুতে উন্নতি হয়েছে, যেমন আগে গাড়িতে যাওয়া-আসা করতাম, ক্রিকেটারদের আন্দোলনের পর এখন ফ্লাইটে যাই। আপনি যদি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কাছাকাছি নিতে চান, তাহলে ভালো উইকেট খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট শুরুর আগে যে ধরনের প্রস্তুতি নেন, সেটা কি যথেষ্ট হয়?
মার্শাল: যারা এইচপি বা ‘এ’ দলে থাকে না, তাদের জন্য অনেক কঠিন। আমি ঢাকায় খেলি, কিন্তু অনুশীলন করার জায়গা নেই। প্রতিটা বিভাগের এমন একটা মাঠ থাকা উচিত, যেখানে খেলোয়াড়েরা সারা বছর অনুশীলন করতে পারবে। আন্তর্জাতিক ম্যাচের সময় মিরপুরের জিমও ব্যবহার করতে পারি না। ইনডোরে যে বোলিং মেশিন ছিল, এটা গত বছর পর্যন্তও আমরা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটাররা ব্যবহার করতে পারতাম না। টুর্নামেন্টের আগে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সবাই প্রস্তুতি নিই।
টেস্ট খেলার ধরনও এখন অনেক বদলে গেছে। সে তুলনায় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আপনারা কতটা বদলাতে পারলেন?
মার্শাল: অনেকে আছে যারা আধুনিক ক্রিকেট খেলে। তাদের সঙ্গে আমরাও পাল্লা দিই। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পর্যায়ে পৌঁছাতে হলে উইকেট ভালো করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ম্যাচও অনেক কম খেলি। দুই বছর ধরে বিসিএল হচ্ছে না। এখন আমরা এনসিএলে সাত ম্যাচ খেলি। অথচ আমার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে দুই রাউন্ডে ম্যাচ খেলতাম ১০ ম্যাচ। বুলবুল ভাই (বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম) আসার পর অনেক কিছু বদলাচ্ছে, আশা করি এদিকেও নজর দেবেন।
২০ বছর আর ১০ হাজার রানের ক্যারিয়ার। কোথায় থামতে চান?
মার্শাল: এখনো ক্রিকেটটা উপভোগ করছি। আমার পরিবারও চায় আরও কিছুদিন খেলি। বাচ্চারা ছোট, ওরা মাঠে এসে বাবার খেলা দেখতে চায়। কিন্তু সিনিয়ররা একটু খারাপ খেললেই তো প্রশ্নচিহ্ন বসে যায়! পরের মৌসুম খারাপ খেললে তার পরের মৌসুমে হয়তো অবসর নিয়ে নেব। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলে তো এত টাকাও পাই না। চার দিনের একটা ম্যাচ খেলে পাই ৭০ হাজার টাকা আর একটা টি-টোয়েন্টি খেললে দেয় ৫০ হাজার টাকা। ব্যবধানটা একটু বেশি না? তবু প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলি; কারণ, লাল বলে খেলতে ভালোবাসি। চার দিনের ক্রিকেটে আরও ৩০-৪০ শতাংশ টাকা বাড়িয়ে অন্তত বাসায় নিয়ে যাওয়ার মতো টাকা দেওয়া দরকার।