দুই পা অচল, তবু সফল ফ্রিল্যান্সিংয়ে

জন্ম থেকেই অচল দুই পা। তবু দমে যাননি অনিক। ফ্রিল্যান্সিং করে মাসে আয় করেন দুই লাখ টাকার বেশি।

অনিক মাহমুদের মাসিক আয় ২ লাখ ১৮ হাজার টাকা
ছবি: প্রথম আলো

জন্ম থেকেই অনিক মাহমুদের দুই পা বাঁকা। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই পা আরও বাঁকা ও সরু হয়ে যেতে থাকে। নিজে হাঁটতে পারেন না, হুইলচেয়ারই তাঁর সঙ্গী। তবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করেছেন তিনি।

২৫ বছর বয়সী অনিক হুইলচেয়ারে বসে অনলাইনে কাজ করেন একজন মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে। কাজের ক্ষেত্র তথ্যপ্রযুক্তি। বিদেশি গ্রাহক বা প্রতিষ্ঠান বাইরে থেকে যেসব কাজ করিয়ে থাকে (আউটসোর্স), সেগুলো করে দেন তিনি। এভাবে অনিক মাহমুদের মাসিক আয় দুই হাজার ডলারের বেশি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ লাখ ১৮ হাজার টাকার বেশি।

আরও পড়ুন

গত মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় ফ্রিল্যান্সার সম্মেলনে দেখা হয় অনিক মাহমুদের সঙ্গে। হুইলচেয়ারে থাকায় দূর থেকেই নজরে পড়েন তিনি। জাতীয় ফ্রিল্যান্সার সম্মেলনে সফল ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। থাকেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার পোড়াদহে নিজের বাড়িতে।

আরেকটা বিষয় ভেবেছিলাম আমি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে নিজে হয়তো ইউরোপে যেতে পারব না, কিন্তু আমার নকশা করা টি-শার্ট ইউরোপের মানুষ পরবে। আমার ডিজাইন যাবে ইউরোপে
অনিক মাহমুদ
জাতীয় ফ্রিল্যান্সার সম্মেলনে সম্মাননা গ্রহণ করছেন অনিক মাহমুদ
প্রথম আলো

জানলেন ও শিখলেন

২০১২ সালের কথা। তখন স্থানীয় স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র তিনি। পোড়াদহ নতুন বাজারে তাঁদের পারিবারিক বইয়ের দোকান ছিল। সে সময়ে পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে অনিককে বইয়ের দোকানে বসতে হতো প্রতিদিন। একদিন ফেসবুকে তিনি দেখেন একটা প্রতিষ্ঠান অনলাইনে গ্রাফিক ডিজাইন শেখাচ্ছে। আগ্রহ থাকায় তিনি সেই কোর্সে ভর্তি হন। কোর্সের বিষয়গুলো ছিল একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের। লোগো, ভিজিটিং কার্ড, ব্রশিউরের নকশা ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা পান। তবে কোনোটাই পুরোপুরি শিখতে পারেননি।

আরও পড়ুন

ওই অনলাইন প্রশিক্ষণ কোর্সে একটা ক্লাস ছিল টি-শার্টের নকশার বিষয়ে। অনিক সিদ্ধান্ত নেন এটি শিখবেন। তিনি ভেবে দেখেন, একটা প্রতিষ্ঠান সাধারণত একবারই লোগোর নকশা করায়। এমনকি কোনো কোম্পানির কর্মীদের ভিজিটিং কার্ডও একবারই করা হয়। নতুন কর্মীর ক্ষেত্রে শুধু নাম আর পদবি বদলে দেওয়া হয়। কিন্তু টি-শার্ট সে রকম নয়। মানুষ নিত্যনতুন ডিজাইনের টি-শার্ট পরতে ভালোবাসে। অনেক অনুষ্ঠান–আয়োজনেও টি-শার্টের প্রয়োজন পড়ে। ফলে এই কাজের চাহিদা বেশি থাকার কথা। সব দিক ভেবে অনিক টি-শার্ট ডিজাইন করার সিদ্ধান্ত নেন।

এরই মধ্যে ২০১৪ সালে স্থানীয় স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। এরপর উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হলেও শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কারণে কলেজে গিয়ে ক্লাস করতে পারেননি। ফলে তাঁর পড়াশোনা আর এগোয়নি।

আরও পড়ুন

কাজ যাবে ইউরোপে

অনিক মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আরেকটা বিষয় ভেবেছিলাম আমি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে নিজে হয়তো ইউরোপে যেতে পারব না, কিন্তু আমার নকশা করা টি-শার্ট ইউরোপের মানুষ পরবে। আমার ডিজাইন যাবে ইউরোপে।’

ইউটিউব দেখে এবং অনলাইনে অর্থের বিনিময়ে নানা কোর্স করে অনিক টি-শার্টের নকশা করার কাজ শিখে ফেলেন ধীরে ধীরে। ২০১৭ সালে নিজের একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেওয়া–নেওয়ার ওয়েবসাইট বা মার্কেটপ্লেস আপওয়ার্ক ডটকমে। ২০১৮ সালে ২৫ মার্কিন ডলারের প্রথম কাজ পান। সময়মতো কাজটি করেন তিনি। গ্রাহক খুশি হয়ে আরও ১০ ডলার বেশি পারিশ্রমিক দেন, সেই সঙ্গে পাঁচ তারকা রেটিং দেন। প্রথম গ্রাহকের কাছ থেকে উৎসাহ পান তিনি।

আরও পড়ুন

সেই শুরু ফ্রিল্যান্সার হিসেবে অনিক মাহমুদের যাত্রা। অনিকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বেশিসংখ্যক দক্ষ ফ্রিল্যান্সার তৈরি করা।

অনিক মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যদি ভাবতাম সরকারি চাকরি করব, তাহলে হয়তো প্রতিবন্ধী কোটায় একটি ভালো চাকরি হতো। কিন্তু আজ আমি চাকরি করছি না, সেই জায়গায় অন্য একজন চাকরি করছেন। এককথায় আমার জায়গা ফাঁকা থাকার কারণে অন্য একজন মানুষের চাকরি হয়ে গেছে।’

অনিক মাহমুদ
প্রথম আলো

স্বাবলম্বী করতে চান প্রতিবন্ধীদের

২০২০ সালের ১৭ জুলাই অনিকের বাবা অধ্যাপক মোজাহার আলী করোনায় মারা যান। তিনি কুষ্টিয়ার হালসা আদর্শ ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। মা শিরিন আক্তার গৃহিণী, দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট অনিক। ২০১৭ সালে পাপিয়া সুলতানাকে বিয়ে করেন অনিক। এই দম্পতির একমাত্র মেয়ে আফরাসা মাহমুদের বয়স এখন আট মাস।

অনিকের ভাবনা, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে যদি ফ্রিল্যান্সিং শিখিয়ে এই পেশায় আনা যায়, তাহলে দেশের ভালো হবে। সমাজে নিজেদের একটি অবস্থানও তৈরি করতে পারবেন তাঁরা।

আরও পড়ুন

অনিক মাহমুদ ২০২১ সালে বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। ২০২২ সালে রাইজিং ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন তিনি।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সশরীর গিয়ে চাকরি করা সব সময় সুবিধাজনক হয় না। অনিক মাহমুদ চান তাঁরা ফ্রিল্যান্সিং পেশায় আসুক। এই খাতে নিজের সুবিধামতো সময়ে ও জায়গায় কাজ করার সুযোগটা কাজে লাগাতে পারবেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা।

আরও পড়ুন