জান্তার ভয়াবহ হামলা আর ভোট নিয়ে আতঙ্কের কথা জানালেন মিয়ানমারের এক নারী
গত মাসে এক গভীর রাতে ইয়াং জা কিম তাঁর পাশের গ্রামে একটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। এর পরপরই তাঁর মাথার ওপর দিয়ে যুদ্ধবিমান উড়ে যায়। দূরে ধোঁয়া দেখে তিনি ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসেন।
ইয়াং জা কিম বলেন, ‘আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম, জান্তা সরকারের যুদ্ধবিমানগুলো আমাদের ওপরও বোমা ফেলবে। তাই আমরা কিছু খাবার, জামাকাপড়সহ হাতের কাছে যা পেলাম, তা নিয়ে গ্রামের পাশের জঙ্গলে দৌড়ে পালাই।’
মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় চিন প্রদেশে নিজ গ্রাম কে-হাইমুয়ালে বিবিসির সঙ্গে কথা বলেন এই নারী। গত ২৬ নভেম্বর ঘটে যাওয়া ওই দুর্বিষহ ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার সময় ইয়াং জা কিমের চোখেমুখে উৎকণ্ঠার ছাপ দেখা যাচ্ছিল।
মিয়ানমারের সাধারণ মানুষদের সঙ্গে প্রাণখুলে কথা বলা সহজ নয়। সামরিক সরকার বিদেশি সাংবাদিকদের দেশটিতে অবাধে প্রবেশের অনুমতি দেয় না। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে, অর্থাৎ গত নির্বাচনের পরপরই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারা ক্ষমতা দখল করে। এর পর থেকেই নিজেদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ দমনে নির্বিচারে সাধারণ মানুষের ওপর আগ্রাসন চালাচ্ছে।
২৮ ডিসেম্বর থেকে মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শুরু হতে যাচ্ছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক দমন–পীড়ন শুরু করেছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলো নতুন করে নিজেদের দখলে নিতে ব্যাপক বিমান হামলা ও স্থল অভিযান চালাচ্ছে সেনাবাহিনী। এ কারণে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় আক্রান্ত এলাকার কয়েক হাজার সাধারণ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁদেরই একজন ইয়াং জা কিম।
কিম যখন বিবিসির কাছে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর পাশে মাদুর পেতে বসে ছিলেন আরও চার নারী। এ সময় তাঁরাও কাঁদতে শুরু করেন। সে রাতে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছাতে গিয়ে তাঁদের যে দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তার ছাপ তাঁদের চোখেমুখে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
বিমান হামলার পরপরই বাড়ি ছেড়ে পালানো কিম আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিতে চান না।
এই নারী বলেন, ‘যদি আমরা ধরা পড়ি এবং ভোট দিতে রাজি না হই, তবে তারা আমাদের জেলে ঢোকাবে এবং নির্যাতন করবে। আমাদের যাতে ভোট দিতে না হয়, সে জন্যই আমরা পালিয়ে এসেছি।’
জান্তা বাহিনী সর্বশেষ গত সপ্তাহে চিন রাজ্যের দক্ষিণে রাখাইন রাজ্যের একটি হাসপাতালে হামলা চালায়। রাখাইনের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো বলছে, এতে অন্তত ৩০ জন নিহত ও ৭০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
মিয়ানমারের চিন প্রদেশের কেউ কেউ জান্তা সরকারের সর্বশেষ এই হামলা ও দমন–পীড়নকে গত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বলে বর্ণনা করেছেন।
বাড়িঘর ছেড়ে পালানো মানুষদের অনেকে প্রদেশের অন্যান্য অংশে আশ্রয় নিয়েছেন। আর ইয়াং জা কিমসহ কিছু মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের মিজোরাম রাজ্যে প্রবেশ করেছেন। তাঁরা সেখানকার ভাফাই গ্রামের ব্যাডমিন্টন খেলার পরিত্যক্ত একটি মাঠে আশ্রয় নিয়েছেন। সঙ্গে করে সামান্য যেসব জিনিস আনতে পেরেছেন, তা প্লাস্টিকের বস্তায় রেখে দিয়েছেন। ওই গ্রামের বাসিন্দারা তাঁদের খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে সাহায্য করছেন।
৮০ বছর বয়সী রাল উক থাংকেও এই বয়সে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছানোর আগপর্যন্ত দিনের পর দিন জঙ্গলে তাঁবু টাঙিয়ে থেকেছেন তিনি।
রাল উক থাং বলেন, ‘আমরা আমাদের এই সরকারকে ভয় পাই। তারা অত্যন্ত নিষ্ঠুর। তাদের সেনাবাহিনী অতীতে আমাদের ও অন্যান্য গ্রামে ঢুকে মানুষকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করেছে এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে।’
মিয়ানমারের সাধারণ মানুষদের সঙ্গে প্রাণখুলে কথা বলা সহজ নয়। সামরিক সরকার বিদেশি সাংবাদিকদের দেশটিতে অবাধে প্রবেশের অনুমতি দেয় না। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অর্থাৎ গত নির্বাচনের পরপরই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারা ক্ষমতা দখল করে। এর পর থেকেই নিজেদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ দমনে নির্বিচারে সাধারণ মানুষের ওপর আগ্রাসন চালাচ্ছে।
জান্তা বাহিনী সর্বশেষ গত সপ্তাহে চিন রাজ্যের দক্ষিণে রাখাইন রাজ্যের একটি হাসপাতালে হামলা চালায়। রাখাইনের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো বলছে, এতে অন্তত ৩০ জন নিহত ও ৭০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
চিন হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশন বলেছে, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে এ পর্যন্ত চিন রাজ্যের অন্তত তিনটি স্কুল ও ছয়টি গির্জাকে বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তু করেছে জান্তা। এতে ৬ শিশুসহ ১২ জন নিহত হয়েছেন।
বিবিসি গত ১৩ অক্টোবর ভানহা গ্রামের একটি স্কুলে বোমা হামলার ঘটনাটি স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করেছে। হামলার সময় সেখানে পাঠদান চলছিল। হামলায় জোহান ফুন লিয়ান চুং (৭) ও জিং সের মাউই (১২) নামের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। তা ছাড়া এক ডজনের বেশি শিক্ষার্থী আহত হয়েছে।
মিয়ানমারে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কয়েকটি ধাপে অনুষ্ঠিত হবে এবং জানুয়ারির শেষ নাগাদ ফলাফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো নির্বাচনের আয়োজনকে একটি ‘সাজানো নাটক’ বলে আখ্যা দিয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বিবিসির প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়নি মিয়ানমারের সামরিক সরকার।
এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বাস্তুচ্যুত হয়েছেন বাউয়ি নেই লিয়ান। স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান নিয়ে ছোট পরিবার তাঁর। ২০২১ সালে অভ্যুত্থানের ঠিক পরেই ফালাম শহরে তাঁদের বাড়িটি বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এরপর তাঁরা কে-হাইমুয়াল গ্রামে নতুন করে জীবন সাজিয়েছিলেন। এবার সেখানে হামলার পর তাঁরা আবারও গৃহহীন হয়ে পড়েছেন।
লিয়ান বলেন, ‘এটা কত যন্ত্রণাদায়ক ও কঠিন এবং দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া কত বড় কষ্টের ছিল, তা বর্ণনা করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। শুধু বেঁচে থাকার জন্যই আমাদের এটা করতে হয়েছে।’
লিয়ান আরও বলেন, ‘আমি বিশ্বকে জানাতে চাই, আসন্ন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে সামরিক বাহিনী যে দাবি করছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। যেখানে প্রধান রাজনৈতিক দলকেই নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হচ্ছে না, সেখানে প্রকৃত গণতন্ত্র কীভাবে থাকতে পারে?’
মিয়ানমারের সাবেক নেত্রী অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) অভ্যুত্থানের আগের দুটি নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছিল। তবে এই নির্বাচনে তারা লড়ছে না। কারণ, সু চিসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের অধিকাংশ এখন কারাগারে।
বাস্তুচ্যুত রাল উক থাং বলেন, ‘আমরা এই নির্বাচন চাই না। কারণ, সামরিক বাহিনী দেশ চালাতে জানে না। তারা শুধু উচ্চপদস্থ নেতাদের স্বার্থে কাজ করে। যখন অং সান সু চির দল ক্ষমতায় ছিল, আমরা কিছুটা গণতন্ত্রের স্বাদ পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমরা শুধু চোখের পানি ফেলছি।’
ইয়াং জা কিমের আশঙ্কা, এই নির্বাচনে কারচুপি হবে। তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা, সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জোটবদ্ধ নয়—এমন কোনো দলকে ভোট দিলে তারা আমাদের ভোট চুরি করবে। পরে দাবি করবে, আমরা তাদেরই ভোট দিয়েছি।’
এই নির্বাচন কয়েকটি ধাপে অনুষ্ঠিত হবে এবং জানুয়ারির শেষ নাগাদ ফলাফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো নির্বাচনের আয়োজনকে ‘ধোঁকাবাজি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।