‘দুই ভাইয়ের’ লড়াই: পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্ক কোন দিকে

পাকিস্তান থেকে বহিষ্কৃত একটি আফগান শরণার্থী পরিবার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আফগানিস্তানের জালালাবাদের দিকে রওনা হয়েছে। ১২ নভেম্বর পাকিস্তানের তোরখাম সীমান্তেছবি: এএফপি

আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে গত সপ্তাহে বিমান হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে বেড়ে চলা উত্তেজনার মধ্যে এই হামলায় তাদের সম্পর্কে এক নতুন অনিশ্চয়তার বীজ বপন হলো বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি অনুযায়ী, নিষিদ্ধঘোষিত তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানসহ (পাকিস্তান তালেবান বা টিটিপি) সশস্ত্র বিভিন্ন গোষ্ঠীর আস্তানা ছিল গত সপ্তাহের ওই হামলার লক্ষ্য। তবে আফগান কর্মকর্তারা বলছেন, হামলায় যে আটজন নিহত হন, তাঁদের মধ্যে পাঁচজনই নারী ও তিনটি শিশু।

প্রতিবেশী এ দুই দেশের আচরণ চাচাতো ভাইয়ের মতো। তারা একে অন্যকে ছেড়ে যেতে পারে না, আবার নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক করার কোনো পথও খুঁজে পায় না। তাদের (পাকিস্তান-আফগানিস্তান) মধ্যকার লড়াই নিজেদের জনগণের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে।
সামি ইউসাফজাই, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক

ইসলামাবাদের সরকারি ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই “সন্ত্রাসীরা” দেশের (পাকিস্তান) জন্য বড় হুমকি। তারা পাকিস্তানের ভেতর আক্রমণ পরিচালনায় অব্যাহতভাবে আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করছে।’

টিটিপির মতো ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো’ আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সম্মিলিত হুমকি উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, টিটিপির হুমকি মোকাবিলায় আফগান কর্তৃপক্ষের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে আমরা পুরোপুরি অবগত। আর তাই, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার যৌথ সমাধান খুঁজে বের করতে ও আফগানিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালানো থেকে যেকোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে বিরত রাখতে পাকিস্তান কাজ করে যাবে।

আফগান সীমান্তবর্তী পাকিস্তানের উত্তর ওয়াজিরিস্তানে এক সামরিক তল্লাশিচৌকিতে আত্মঘাতী বোমারুদের একটি দল হামলা চালানোর দুই দিন পর আফগানিস্তানের ভেতর ওই বিমান হামলা পরিচালনা করে ইসলামাবাদ। আত্মঘাতী হামলায় অন্তত সাত পাকিস্তানি সেনা নিহত হন।

টিটিপির মতো ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো’ আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সম্মিলিত হুমকি উল্লেখ করে পাকিস্তান বলেছে, হুমকি মোকাবিলায় আফগান কর্তৃপক্ষের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে আমরা পুরোপুরি অবগত। তাই সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার যৌথ সমাধান বের করতে ও আফগানিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালানো থেকে যেকোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে বিরত রাখতে পাকিস্তান কাজ করে যাবে।

আফগানিস্তানে ২০২১ সালের আগস্টে পশ্চিমা–মদদপুষ্ট আশরাফ গনি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় আসা তালেবান শাসকেরা দ্রুতই পাকিস্তানের হামলায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এই হামলাকে ‘বেপরোয়া’ বলে আখ্যায়িত করেছেন তাঁরা।

এ হামলার কয়েক ঘণ্টা পর আফগানিস্তানের সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর কাছে সে দেশের বিভিন্ন সামরিক অবস্থান লক্ষ্য করে মর্টারের গোলা ছোড়ে। এতে বেসামরিক চার নাগরিক ও তিন সেনা আহত হন।

তালেবান সরকারের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বিদেশি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে তাঁর দেশের মাটি থেকে তৎপরতা চালাতে দেওয়ার অভিযোগ নাকচ করে দেন। তবে তিনি স্বীকার করেন, পাকিস্তান–আফগানিস্তান সীমান্তের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করাটা কঠিন।

পাকিস্তানের হামলার প্রতিক্রিয়ায় মুজাহিদ বলেন, ‘এ বিষয়ে (সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা) আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে একটি বিষয় আমাদের অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের অনেক দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। সেখানে আছে পর্বত, বনসহ বিভিন্ন দুর্গম এলাকা। এসব স্থান আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে যেতে পারে।’

সামি ইউসাফজাই একজন সাংবাদিক ও পাকিস্তান–আফগানিস্তান সম্পর্কের ওপর দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষক। তিনি দুই দেশের এ বিবাদকে ‘দুই ভাইয়ের’ লড়াই বলে আখ্যায়িত করেছেন।

আল–জাজিরাকে সামি ইউসাফজাই বলেন, ‘প্রতিবেশী এ দুই দেশের আচরণ চাচাতো ভাইয়ের মতো। তারা একে অন্যকে ছেড়ে যেতে পারে না, আবার নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক করার কোনো পথও খুঁজে পায় না। তাদের (পাকিস্তান–আফগানিস্তান) মধ্যকার লড়াই নিজেদের জনগণের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে।’

আফগানিস্তানে তালেবান প্রথম ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। অনেক বছর ধরেই পাকিস্তানকে আফগান তালেবানের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দেখা হচ্ছিল। মনে করা হতো, সংগঠনটির নেতৃত্বের ওপর পাকিস্তানের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। কেননা, তারা সংগঠনটিকে আশ্রয় দিয়েছিল, অর্থায়ন করেছিল ও কূটনৈতিকভাবে রক্ষাও করেছিল।

আরও পড়ুন

এরই মধ্যে আফগানিস্তানে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা। তখন পাকিস্তান তালেবানের (টিটিপি) উদ্ভব হয় ও তারা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। আদর্শগতভাবে আফগান তালেবানের সঙ্গে মিল রয়েছে টিটিপির।

পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করার পর দেশটির সেনাবাহিনী টিটিপিকে নির্মূলে বেশ কয়েকটি বড় অভিযান চালায়। সংগঠনটির কয়েকজন নেতাকে আফগানিস্তানে ঠেলে পাঠাতেও সক্ষম হয় তারা। ২০২১ সালে আফগান তালেবান কাবুলের ক্ষমতায় ফিরলে টিটিপিকে দমাতে পাকিস্তান নতুন আফগান শাসকদের ওপর তার ঐতিহাসিক প্রভাব খাটানোর প্রত্যাশা শুরু করে।

কিন্তু পাকিস্তানের ভেতরে হামলা আরও বেড়ে গেছে। দেশটির সাম্প্রতিক ইতিহাসে ২০২৩ সাল ছিল সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী বছরগুলোর একটি। বছরটিতে দেশজুড়ে ৬৫০টির বেশি হামলা হয়েছে। নিহত হয়েছেন প্রায় এক হাজার মানুষ। তাঁদের অধিকাংশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সেনাবাহিনীর সদস্য। হামলাগুলোর বেশির ভাগের দায় স্বীকার করেছে ‘পাকিস্তান তালেবান’। তুলনামূলক স্বল্প পরিচিত কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠীও কিছু কিছু হামলার দায় স্বীকার করেছে।

আরও পড়ুন

গত কয়েক বছর ধরেই পাকিস্তান তার ভূখণ্ডে বেশ কয়েকটি হামলার জন্য পাকিস্তান তালেবানকে দায়ী করে আসছে। এসব হামলায় নিহত হন কয়েক হাজার মানুষ। এর মধ্যে ২০১৪ সালে পেশোয়ারের আর্মি পাবলিক স্কুলে এক ভয়ানক হামলায় ১৩০ জনের বেশি শিক্ষার্থী প্রাণ হারায়।

গত বছরের হামলাগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি সংঘটিত হয় পাকিস্তানের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলীয় খাইবার পাখতুনখাওয়া ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলীয় বেলুচিস্তানে। উভয় প্রদেশের অবস্থান আফগানিস্তান সীমান্তে।

খাইবার পাখতুনখাওয়ার সাবেক পুলিশপ্রধান সাইয়েদ আখতার আলী শাহ বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর এ রকম নিয়মিত হামলা বাহিনীর সদস্যদের মনোবলের ওপর প্রভাব ফেলছে। তাই পাকিস্তানের সামনে প্রতিশোধ নেওয়া ছাড়া বিকল্প পথ কমই রয়েছে।

শাহ আরও উল্লেখ করেন, আফগানিস্তানের মতো ইরানের সঙ্গেও আন্তঃসীমান্ত লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা হয়েছে পাকিস্তানের। চলতি বছরের শুরুতে ওই লড়াই আফগানিস্তানের ভেতরে হামলা চালাতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে উৎসাহিত করে থাকতে পারে।

আরও পড়ুন

গত জানুয়ারিতে পাকিস্তান–ইরান পাল্টাপাল্টি হামলার পর দুই দেশ নিজেদের মধ্যকার উত্তেজনা কমাতে সক্ষম হয়। ওই মাসেই পাকিস্তান সফরে যান ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

সাবেক পুলিশপ্রধান শাহ মনে করেন, ওই ঘটনায় পাকিস্তান একটা শিক্ষা গ্রহণ করে থাকতে পারে ও শক্তি প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে এ নিয়ে কিছু সতর্কতাও উচ্চারণ করেন তিনি।

‘আপনি যখন শক্তি প্রদর্শনের মতো আগ্রাসী অবস্থান নেবেন, তখন তা সংলাপে একটি শক্তিশালী অবস্থানে থাকতে আপনাকে সহায়তা করবে। কিন্তু এটি হতে পারে পাল্টা গুলি খাওয়ার মতো এবং পাকিস্তানকে ফেলতে পারে উভয়সংকটে। কেননা, আফগান সরকারও প্রতিশোধ নিতে পারে’, বলেন শাহ।

আরও পড়ুন

এদিকে পর্যবেক্ষক সামি ইউসাফজাই বলেন, ‘আফগানিস্তানে শক্তিশালী পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব রয়েছে। একই অবস্থা অন্য পক্ষেও এবং এসব কিছুই দীর্ঘ মেয়াদে উভয়ের কাউকেই সাহায্য করবে না।’

আরও পড়ুন