বিবিসির সেই উপস্থাপকের যৌন কেলেঙ্কারি নিয়ে যা জানা গেল

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিবিসিকে বেশ কয়েকটি গুরুতর কেলেঙ্কারি মোকাবিলা করতে হয়েছে
প্রতীকী ছবি: এএফপি

হিউ এডওয়ার্ডস বিবিসির একজন জ্যেষ্ঠ উপস্থাপক। দুই দশক ধরে সংবাদমাধ্যমটির সাড়াজাগানো অনুষ্ঠান ‘নিউজ অ্যাট টেন’ উপস্থাপনা করছেন তিনি। লাখ লাখ মানুষ নিয়মিত এ অনুষ্ঠান দেখেন।

সেই সঙ্গে ইতিহাসের অন্যতম সাড়াজাগানো কিছু অনুষ্ঠান উপস্থাপনার রেকর্ড রয়েছে এডওয়ার্ডসের ঝুঁলিতে। ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রয়াণের পর ১০ দিনের শোকের আয়োজন তাঁর মাধ্যমে জেনেছিলেন বিবিসির দর্শকেরা। রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক, রাজকীয় কোনো বিয়ের আয়োজন, সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল—গুরুত্বপূর্ণ নানা উপস্থাপনায় বিবিসির অতিপরিচিত মুখ এডওয়ার্ডস।

বিবিসির আলোচিত উপস্থাপক হিউ এডওয়ার্ডস এখন নিজেই খবরের শিরোনাম হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, যৌনতাপূর্ণ ছবি পাঠানোর জন্য এক অপ্রাপ্তবয়স্ককে অর্থ দিয়েছেন তিনি। তদন্ত চলছে এডওয়ার্ডসের বিরুদ্ধে। তবে গত শুক্রবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে এ অভিযোগ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলেও ৬১ বছর বয়সী এডওয়ার্ডসের নাম প্রকাশ করা হয়নি।

ভুক্তভোগীর মা অভিযোগ করেন, এখন তাঁর সন্তানের বয়স ২০ বছর। তিন বছর আগে থেকে তাঁর সন্তানকে যৌনতাপূর্ণ ছবি পাঠানোর জন্য অর্থ দিয়ে আসছেন বিবিসির এক পুরুষ উপস্থাপক। তিনি মোট ৩৫ হাজার পাউন্ড দিয়েছেন। যে সময় প্রথম অর্থ দেওয়া শুরু হয়েছিল, তখন তাঁর সন্তানের বয়স ছিল ১৭ বছর।
বিবিসির জ্যেষ্ঠ উপস্থাপক হিউ এডওয়ার্ডস
ছবি: রয়টার্স

এর পাঁচ দিন পর গতকাল বুধবার বিবৃতি দিয়ে এডওয়ার্ডসের নাম প্রকাশ করেছেন তাঁর স্ত্রী ভিকি ফ্লিন্ড। বলেছেন, তাঁর স্বামী কয়েক বছর ধরে মানসিক অবসাদসংক্রান্ত জটিলতায় ভুগছেন। চিকিৎসাও করিয়েছেন। এমনকি অভিযোগ ওঠার পর তাঁর স্বামীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

এ ঘটনায় বিবিসির মহাপরিচালক টিম ডেভি কর্মীদের উদ্দেশে এক চিঠিতে লিখেছেন, গত কয়েক দিনে অভিজ্ঞতা এটাই বলে যে ব্যক্তিগত জীবন জনসমক্ষে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। এর কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ ও পরিবার।

যে অভিযোগ উঠেছে

যুক্তরাজ্যের দ্য সান পত্রিকা গত শুক্রবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে প্রথমবারের মতো বিবিসির একজন উপস্থাপকের কেলেঙ্কারির কথা জানা যায়। প্রতিবেদনে ভুক্তভোগীর মা অভিযোগ করেন, এখন তাঁর সন্তানের বয়স ২০ বছর। তিন বছর আগে থেকে তাঁর সন্তানকে যৌনতাপূর্ণ ছবি পাঠানোর জন্য অর্থ দিয়ে আসছেন বিবিসির একজন পুরুষ উপস্থাপক। তিনি মোট ৩৫ হাজার পাউন্ড দিয়েছেন। যে সময় প্রথম অর্থ দেওয়া শুরু হয়েছিল, তখন তাঁর সন্তানের বয়স ছিল ১৭ বছর।

হিউ এডওয়ার্ডস অসুস্থ। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। সুস্থ হওয়ার পর তিনি নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে সবাইকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবেন।
ভিকি ফ্লিন্ড, বিবিসির উপস্থাপক হিউ এডওয়ার্ডসের স্ত্রী

ওই নারী আরও জানান, তাঁর সন্তান কোকেনে আসক্ত। বিবিসির উপস্থাপকের দেওয়া অর্থে তাঁর সন্তান নেশা করে। এ ঘটনায় ওই পরিবার গত ১৯ মে বিবিসির কাছে অভিযোগ করে। কিন্তু এরপরও অভিযুক্ত উপস্থাপককে দায়িত্ব থেকে সরায়নি বিবিসি কর্তৃপক্ষ। সান পত্রিকায় খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর দেশে–বিদেশে এ নিয়ে তুমুল সমালোচনা হয়।

গত রোববার বিবিসির পক্ষ থেকে তাদের একজন জ্যেষ্ঠ উপস্থাপকের বিরুদ্ধে এই কেলেঙ্কারির অভিযোগ পাওয়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়। পরে বরখাস্ত করা হয় ওই উপস্থাপককে। এর পরদিন সোমবার ভুক্তভোগীর আইনজীবী সান পত্রিকার ওই প্রতিবেদনকে ‘আবর্জনা’ বলে মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, পুরো ঘটনায় অপরাধমূলক কিছুই ঘটেনি।

এরপর গত বুধবার মেট্রোপলিটন পুলিশ জানায়, প্রাথমিক তদন্তে পুলিশও বিবিসির উপস্থাপকের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের কোনো আলামত পায়নি। তবে বিবিসি জানিয়েছে, অভ্যন্তরীণ করপোরেট তদন্ত চালিয়ে যাওয়া হবে।

যে কারণে গোপনীয়তা

অভিযোগ ওঠার পাঁচ দিন পর্যন্ত এডওয়ার্ডসের নাম অপ্রকাশিত ছিল। সংবাদমাধ্যম, ভুক্তভোগীর পরিবার, পুলিশ— কেউই অভিযুক্তের নাম প্রকাশ করেনি। এ নিয়ে জল্পনাকল্পনা ডালপালা মেলে। এমনকি বিবিসির বেশ কয়েকজন উপস্থাপক জানান, তাঁরা এ ঘটনায় জড়িত নন। কেননা, অনলাইন–অফলাইনে অনেকে তাঁদের সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন। পরে তাঁরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন।

পরবর্তীকাল এডওয়ার্ডসের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযুক্ত হিসেবে তাঁর নাম প্রকাশ করা হয়। যুক্তরাজ্যের আইনে বলা আছে, আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আগে কোনো অভিযুক্তের নাম প্রকাশ করা যাবে না। দেশটির সুপ্রিম কোর্ট গত বছর এ–সংক্রান্ত একটি নির্দেশ দিয়েছে। এ নির্দেশ অনুযায়ী, অভিযোগ গঠন না হওয়া এবং আদালতে না তোলায় পুলিশের পক্ষ থেকে এডওয়ার্ডসের নাম–পরিচয় গোপন রাখা হয়েছিল।

যেহেতু মেট্রোপলিটন পুলিশ জানিয়েছে, তারা এডওয়ার্ডসের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক তদন্ত করেনি, তাই তাঁর নাম প্রকাশের বাধ্যবাধকতা পুলিশের নেই। সংবাদমাধ্যম আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এডওয়ার্ডসের নাম প্রকাশ করেনি। ভুক্তভোগীর আইনজীবীর পক্ষ থেকে অপরাধের কথা অস্বীকার করায় এডওয়ার্ডসের নাম প্রকাশ করা নিয়ে নীতিগত বাধা ছিল।

আরও পড়ুন

কেন এত যাচাই–বাছাই

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিবিসিকে বেশ কয়েকটি গুরুতর কেলেঙ্কারি মোকাবিলা করতে হয়েছে। ২০১৮ সালে তারকা শিল্পী স্যার ক্লিফ রিচার্ডের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সামাল দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে বিবিসি।

গত শতকের ৯০–এর দশকে বিবিসির পক্ষ থেকে প্রিন্সেস ডায়ানার সাক্ষাৎকার নেওয়ার ঘটনায় তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। এত বছর পর অভিযোগ ওঠে, ডায়ানার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য জিমি অপেশাদার উপায় বেছে নিয়েছিলেন। দেশে–বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে বিবিসি।

যুক্তরাজ্যের বাইরে বিবিসির আয়ের বড় উৎস বিজ্ঞাপন। কিন্তু যুক্তরাজ্যে পরিস্থিতি ভিন্ন। দেশটিতে সরাসরি জনগণের কাছ থেকে লাইসেন্স ফি বাবদ সংগ্রহ করা অর্থে বিবিসির খরচ মেটানো হয়। এ কারণে বিবিসি ও বিবিসির কর্মীদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। এ দায়বদ্ধতা থেকে অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্তে নেমেছে সংবাদমাধ্যমটি।

আরও পড়ুন

এরপর কী হবে

ভিকি ফ্লিন্ড বলেছেন, তাঁর স্বামী এডওয়ার্ডস অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। সুস্থ হওয়ার পর নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে সবাইকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবেন এডওয়ার্ডস।

অন্যদিকে পুলিশ তদন্ত না করলেও বিবিসি অভ্যন্তরীণ তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে। তবে প্রশ্ন রয়ে যায়, এ অভিযোগের বিষয়ে সংবাদমাধ্যমটি কবে থেকে জানত, কী কী জানত? অভিযোগ জানার পর বিবিসি কী করেছে, সেটাও জানা যায়নি। এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি।

সান পত্রিকা বিবিসির তদন্তে সহায়তা করার কথা ঘোষণা করেছে। জানিয়েছে, এডওয়ার্ডসের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে আর কোনো প্রতিবেদন প্রকাশের পরিকল্পনা তাদের নেই। বিবিসির প্রধান টিম ডেভি বলেছেন, ‘পুরো ঘটনাটি নিয়ে আমরা খুবই জটিল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি।’