তুরস্কের যে কৌশলে ‘জিহাদি’ শারা হয়ে উঠলেন সিরিয়ার ‘আমির’

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারাফাইল ছবি: এএফপি

২০১৯ সালের বসন্ত। রুশ বিমানবাহিনীর সহায়তায় সিরিয়ার সরকারি বাহিনী ইদলিবের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। তৈরি হয় জরুরি পরিস্থিতি।

হায়াত তাহরির আল–শামের (এইচটিএস) নেতা আবু মোহাম্মদ আল–জোলানি (আহমেদ আল–শারা নামে বেশি পরিচিত) তখন ইদলিবের কেন্দ্রস্থলে একটি নিরাপদ বাড়িতে তাঁর সহযোগী ও কয়েকজন বিদেশি অতিথির সঙ্গে বসেছিলেন। অতিথিদের মধ্যে তুর্কিও ছিল।

রাত বেড়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে আল–শারা মন খুলে নিজের ব্যক্তিগত কিছু গল্প বলতে শুরু করলেন। ‘আমি ছোটবেলায় একবার স্বপ্ন দেখেছিলাম’, ধীরে, গভীর মনোযোগ নিয়ে বলতে থাকেন তিনি। ‘স্বপ্নে দেখেছিলাম, আমি দামেস্কের আমির হয়েছি।’

আশ–শারা বলেছিলেন, সেই স্বপ্ন ছিল শুভ ইঙ্গিত, নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্রষ্টার একধরনের বার্তা। তাঁর বিশ্বাস ছিল, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট স্বৈরশাসক বাশার আল–আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা কঠিন হবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জেতা সম্ভব। তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা, যাঁদের মধ্যে সালাফি পটভূমির লোকও ছিলেন। বলেছিলেন, সেই স্বপ্ন সত্যি তিনি বিশ্বাস করতেন।

ওই গল্প বলার প্রায় পাঁচ বছর পর আহমেদ আল–শারা তাঁর বিদ্রোহী খেতাব কাটিয়ে সিরিয়ান আরব রিপাবলিকের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট, অর্থাৎ সেই ‘আমির’ হন, যার স্বপ্ন তিনি একসময় দেখেছিলেন।

রাত বেড়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে আল-শারা মন খুলে নিজের ব্যক্তিগত কিছু গল্প বলতে শুরু করলেন। ‘আমি ছোটবেলায় একবার স্বপ্ন দেখেছিলাম’, ধীরে, গভীর মনোযোগ নিয়ে বলতে থাকেন তিনি। ‘স্বপ্নে দেখেছিলাম, আমি দামেস্কের আমির হয়েছি।’

এখন জোলানি নিজের জন্মনাম আহমেদ আল–শারা নামে পরিচিত। ৪৩ বছরের শারা খুব দ্রুতই নিজের পরিচয় পাল্টে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। একসময়ের ‘জিহাদি সন্ত্রাসী’ (যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কথায়) থেকে এখন রাষ্ট্রনেতা তিনি। ইরাক থেকে সিরিয়া। দীর্ঘ সময় আল–কায়েদা ঘরানার বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীতে সক্রিয় থাকার পর এমন পরিবর্তন বিস্ময়করই বলা যায়।

আসাদ পরিবারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর শারা এখন সেসব বিশ্বনেতার সঙ্গেও মিশছেন, যাঁদের তিনি একসময় এড়িয়ে চলতেন। তিনি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে জনসমক্ষে উপস্থিত হন, শ্মশ্রু ছোট করেছেন, পাগড়ি ও থোব (ঐতিহ্যবাহী দীর্ঘ ঢিলেঢালা পোশাক) ছেড়ে স্যুট–টাই পরছেন। সব মিলিয়ে এমন একটি নতুন রাষ্ট্র গড়ার চেষ্টা করছেন, যেখানে স্পষ্ট ইসলামি প্রভাব নেই।

কিন্তু এ রূপান্তর কীভাবে সম্ভব হলো

তুরস্কসহ আঞ্চলিক কর্মকর্তারা, সিরীয় সূত্র, বিশেষজ্ঞ, এমনকি সিরিয়ার সরকারি শাসনব্যবস্থার ভেতরের লোকেরাও মনে করেন, ইদলিবে শারার শাসনামলেই ধীরে ধীরে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ভূমিকার এ পাল্টে যাওয়া শুরু হয়। ইদলিব মূলত একধরনের অনানুষ্ঠানিক ‘ক্ষুদ্র রাষ্ট্র’ হয়ে উঠেছিল, যা শারার ভাবমূর্তিকে পুনর্গঠনে বড় ভূমিকা রেখেছে।

‘তাঁর (আল–শারা) রূপান্তরে তুরস্ক খুবই বাস্তব ভূমিকা রেখেছে’, এইচটিএসের নেতা থাকাকালীন শারার সঙ্গে দেখা করা একজন তুর্কি কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে বলেন।

তুরস্কের সঙ্গে প্রথম বড় যোগাযোগ

তুর্কি কর্মকর্তার মতে, শারার নিজেরও বদলে যাওয়ার কারণ ছিল। সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের মধ্যে টিকে থাকতে হতো, আর তুরস্কই ছিল তাঁর একমাত্র ভরসা। কারণ, তিনি এমন এক এলাকায় আটকে ছিলেন, যেখানে আঙ্কারা ছিল তাঁর জীবনসঞ্চারণী রেখার মতো।

সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে, ১৪ মে ২০২৫
ছবি: হোয়াইট হাউস প্রেস সেক্রেটারির এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে

তুরস্কের সঙ্গে শারার প্রথম বড় যোগাযোগ শুরু হয় ২০১৭ সালে। তখন তাঁর দল ‘জাবহাত ফাতেহ আল–শাম’ ইদলিবের বাব আল–হাওয়া সীমান্তচৌকি দখল করে। এটি জাতিসংঘের মানবিক সহায়তার গুরুত্বপূর্ণ পথ। তুরস্ক এ সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে শারা পথটি নিয়ন্ত্রণে সেখানে একটি বেসামরিক প্রশাসন গঠন করেন।

যতই শারা নিজের দলে উগ্রপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন, ততই তাঁর বাস্তববাদী দিক প্রকাশের সুযোগ বেড়েছে। তিনি ইসলামি চিন্তায় বিশ্বাসী, কিন্তু তাঁর কোনো সুস্পষ্ট আদর্শ নেই। তিনি তত্ত্বের চেয়ে কাজে বিশ্বাসী।
জেরোম দ্রেভন, সিরিয়াবিষয়ক গবেষক

যদিও তুরস্ক তখনো শারার প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী আহরার আল–শাম ও নুরেদ্দিন জেঙ্গিকে সমর্থন দিচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত শারাই ইদলিবে প্রধান শক্তি হয়ে ওঠেন এবং আঙ্কারাকে অবস্থান বদলাতে বাধ্য করেন।

শারা ক্ষমতা সুদৃঢ় করতে থাকলে সিরিয়ার বিষয় দেখভাল করা তুর্কি নিরাপত্তা দলের পুরোনো সদস্য ও শারাবিরোধীদের ধীরে ধীরে সরিয়ে নেওয়া হয়।

তুরস্কেরও শারার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কারণ ছিল। ‘আস্তানাপ্রক্রিয়া’র অংশ হিসেবে ইদলিব ঘিরে তুরস্ককে নজরদারি চৌকি স্থাপন করতে হয়েছিল। এটি এইচটিএসের সঙ্গে কাজের সম্পর্ক ছাড়া সম্ভব ছিল না।

একজন তুর্কি নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, তুরস্ক বার্তা দিয়েছিল যে একক কোনো গোষ্ঠীর আধিপত্যে ইদলিবে সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। শারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও এটি মেনে নেন। সেভাবেই হায়াত তাহরির আল–শামের (এইচটিএস) জন্ম।

২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এইচটিএস আগের কয়েকটি প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীকেও যুক্ত করে ‘আরও বেশি সিরীয়’ পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে। গঠন করে একটি পরিষদ। এটি গোষ্ঠীটিকে তুরস্কের সঙ্গে কাজ করা বা বিরোধিতার ক্ষেত্রে আরও নমনীয়তা ও বৈধতা দেয়। শিগগিরই গঠিত হয় সালভেশন গভর্নমেন্ট বা ইদলিবের বেসামরিক প্রশাসন।

তুরস্ক মনে করেছিল, এমন বেসামরিক ও শাসনভিত্তিক কাঠামো ইদলিবে বৈধতার সংকট কমাবে। সে সময় একটি বৈঠকে একজন তুর্কি কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘এভাবে বেসামরিক প্রশাসন গঠন করা হলে আমরা এটিকে সিরীয় বিপ্লবের ধারাবাহিকতা, আত্মরক্ষামূলক সংগ্রাম ও সাধারণ মানুষের সুরক্ষা হিসেবে তুলে ধরতে পারব।’

আরেকটি নিরাপত্তা সূত্র বলেছে, সালভেশন গভর্নমেন্টকে তুরস্ক একটি মডেল হিসেবে সমর্থন করে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
ফাইল ছবি: রয়টার্স

নতুন কৌশল

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা দারিন খলিফা বলেন, শারা যখন নিজেকে উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তুরস্কও তাঁর নেতৃত্বাধীন সংগঠন এইচটিএসের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াল। এ দুটি বিষয় একই সময় ঘটেছিল। দুই পক্ষই নতুন কৌশলের খোঁজে ছিল।

আসাদ পরিবারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর শারা এখন সেসব বিশ্বনেতার সঙ্গেও মিশছেন, যাঁদের তিনি একসময় এড়িয়ে চলতেন। তিনি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে জনসমক্ষে উপস্থিত হন, শ্মশ্রু ছোট করেছেন, পাগড়ি ও থোব (ঐতিহ্যবাহী দীর্ঘ ঢিলেঢালা পোশাক) ছেড়ে স্যুট-টাই পরছেন। সব মিলিয়ে এমন একটি নতুন রাষ্ট্র গড়ার চেষ্টা করছেন, যেখানে স্পষ্ট ইসলামি প্রভাব নেই।

খলিফা বলেন, (ইদলিবে) তুরস্কের সেনা মোতায়েন বিষয়ে শারা নিজের ভাষা নরম করলেন। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, তিনি তুরস্কের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন। কারণ, তাঁর তাদের সহায়তা দরকার ছিল।

খলিফা আরও বলেন, শারা বুঝতে পেরেছিলেন, তুরস্ক তার অবস্থান পাল্টাচ্ছে (শারার বিরোধিতা করা থেকে সরছে) এবং সিরিয়ায় আঙ্কারা ও মস্কোর ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি টেকার সম্ভাবনা কম।

সিরিয়াবিষয়ক গবেষক জেরোম দ্রেভন বলেন, তুর্কি সামরিক বাহিনীর মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সব সময় এইচটিএসকে অপছন্দ করত। তারা একে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে মনে করত। গ্রেপ্তার করত এর সদস্যদের। শুধু গোয়েন্দা শাখা বাস্তববাদীভাবে তাদের সঙ্গে কাজ করত।

‘ট্রান্সফর্মড বাই দ্য পিপল: হায়াত তাহরির আল–শাম’স রোড টু পাওয়ার ইন সিরিয়া’ গ্রন্থের এই সহরচয়িতা বলেন, দুই পক্ষই বুঝেছিল, তাদের স্বার্থ একটি জায়গায় মেলে।

তুরস্ক চাইত ইদলিব বিরোধীদের দখলে থাক, যাতে নতুন করে লাখ লাখ শরণার্থী তার সীমান্তে না আসেন। প্রায় ১৯ লাখ মানুষ সেখানে ছিলেন। তাঁরা তুরস্ককে অস্থিতিশীল করতে পারতেন। বিদেশি সেনাদের হুমকি ঠেকাতেও আগ্রহী ছিল তুরস্ক। ‘সেখানেই একধরনের সমঝোতা তৈরি হয়’, বলেন দ্রেভন।

২০২০ সালের শুরুর দিকে আসাদ বাহিনী, ইরান-ঘনিষ্ঠ মিলিশিয়া ও রুশ বিমানবাহিনীর সহায়তায় নতুন অভিযান শুরু করলে তুরস্ক সরাসরি হস্তক্ষেপে বাধ্য হয়। কারণ, নতুন শরণার্থী ঢলের ঝুঁকি ছিল।

তুরস্ক সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর শত শত লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায় এবং প্রদেশজুড়ে ১২ হাজারের বেশি সেনা মোতায়েন করে। এভাবেই এইচটিএসের সঙ্গে ‘বাস্তবিক সম্পর্ক’ তৈরি হয়। এ যোগাযোগ ধীরে ধীরে এইচটিএসের চরিত্র বদলে দেয়।

দ্রেভন বলেন, ‘(এইচটিএসের ওপর) তুরস্কের প্রভাব সরাসরি না থাকলেও খুব শক্তিশালী ছিল। রাশিয়া সব সময়ই নতুন দাবি তুলত, যেমন ইদলিব থেকে ভারী অস্ত্র সরানো বা সেখানে যৌথ টহল—এইচটিএসকে সেটা মানতেই হতো।’

এইচটিএসের ভেতর কেউ কেউ এসব ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না। তাঁদের সরিয়ে দেন শারা। দ্রেভন বলেন, এইচটিএসকে বদলাতে ও যাঁরা আপসের বিরোধী, তাঁদের সরাতে হতো। তুরস্কের সম্পৃক্ততা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে।

কট্টরপন্থী সংগঠনের বিরুদ্ধে শারার অভিযান

গত বছরের ডিসেম্বর মাসে আসাদ সরকারের পতনের পর একজন তুর্কি কর্মকর্তা বলেন, তাঁরা ‘যোগাযোগ বজায় রেখে’ এইচটিএসকে প্রভাবিত করতে পেরেছেন।

আটলান্টিক কাউন্সিলের ফেলো ও দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়া পর্যবেক্ষণকারী ওমর ওজকিজিলচিক মিডল ইস্ট আইকে বলেন, ‘এটাই যোগাযোগের মাধ্যমে পরিবর্তনের কৌশল।’ তিনি বলেন, ইতিহাসে প্রথমবার একটি ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন এভাবে বৈধ সত্তায় পরিণত হলো।

সবচেয়ে বড় মোড় আসে যখন এইচটিএস ‘হুররাস আল-দিন’-এর বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। সংগঠনটি আল-কায়েদার প্রতি অনুগত ছিল।

ওজকিজিলচিক বলেন, হুররাস আল-দিনের বিরুদ্ধে যাওয়ার পর শারা তুরস্কের প্রতি আরও সাড়াদাতা হয়ে ওঠেন। এতে প্রমাণিত হয়, এইচটিএস সত্যিই আল-কায়েদা থেকে আলাদা হয়েছে।

তুরস্ক এ বিভাজন বোঝে এবং ইদলিবে ‘কট্টরপন্থী’ বনাম ‘বাস্তববাদী’ গোষ্ঠীকে আলাদা করার নীতি গ্রহণ করে। ধীরে ধীরে শারার ঘনিষ্ঠ সহযোগী শায়বানি তুরস্কে যাতায়াতের অনুমতি পান এবং দেশটির নীরব সমর্থনে বিদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সেখানে দেখা করেন।

তুর্কি কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, তাঁরা হুররাস আল-দিন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রকে গোয়েন্দা তথ্য দিয়েছিলেন, যার ভিত্তিতে দেশটি ওই গোষ্ঠীর নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করে। যদিও দ্রেভন এ দাবির সঙ্গে একমত নন।

ক্রাইসিস গ্রুপের দারিন খলিফা বলেন, এইচটিএস কীভাবে নিজেদের জনসমক্ষে উপস্থাপন করছে, শারার সেই ভাবমূর্তিতেও তুরস্ক প্রভাব রেখেছে। তিনি বলেন, তুরস্কের প্রভাব অন্য যে কারও তুলনায় বেশি ছিল। আঙ্কারার জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এইচটিএস সংখ্যালঘু, যেমন খ্রিষ্টানদের সঙ্গে যেন ভালো সম্পর্ক রাখে ও কঠোর ইসলামি শাসন চাপিয়ে না দেয়। তুরস্ক চাইছিল না যে তারা কোনো সমস্যাসৃষ্টিকারী দলকে রক্ষা করছে, এমনটা দেখা যায়।

বহু বছর ধরে শারাকে পর্যবেক্ষণ করেছে, সিরিয়ার এমন একটি সূত্র বলেছে, এটা বোঝার পর, শারা তুরস্কের সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখার ব্যাপারে নমনীয় হন। এমনকি ইদলিবে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি কঠোর থাকলেও সালভেশন গভর্নমেন্টের মাধ্যমে তিন-চার বছর ধরে তুরস্ককে দিয়ে পশ্চিমাদের কাছে ইতিবাচক বার্তা পাঠান।

পশ্চিমাদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা

২০২০ সাল নাগাদ শারা নিজেকে কঠোর নিয়মানুবর্তী ‘যোদ্ধা’ হিসেবে তুলে ধরেন। দাবি করতেন, তিনি সালভেশন গভর্নমেন্টের ‘একজন সেবক’ মাত্র।

সেই বছর শেষ হওয়ার আগে তুরস্কের মাধ্যমে শারার সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর পরোক্ষ যোগাযোগ তৈরি হয়। ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় কর্মকর্তারা মানবিক সহায়তার মতো বিষয়ে তাঁর বা তাঁর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করতে শুরু করেন। তুর্কি এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মুখ্য বিষয় হলো এখন তাঁরা (শারা ও পশ্চিমারা) কথা বলতে পারেন।’

এসব যোগাযোগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গবেষকেরা ইদলিব ও আসাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকার শাসনব্যবস্থার তুলনামূলক বিশ্লেষণ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি শুরু করেন। গবেষকেরা তুরস্কের মাধ্যমে ইদলিবে যান। আন্তর্জাতিকভাবে এইচটিএসকে নিয়ে আলোচনা বাড়ে।

২০২১ সালে শারা তখনো ‘জোলানি’ নামে পরিচিত। ওই সময় ‘পিবিএস ফ্রন্টলাইন’কে সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তাঁকে প্রথমবার সিভিল পোশাকে দেখা যায়।

দ্রেভন বলেন, তুরস্ক সরাসরি এসব বৈঠক বা সাক্ষাৎকার আয়োজন করেনি। তবে এগুলো হতে দিয়েছে। ফলে এইচটিএস সম্পর্কে দীর্ঘদিনের ‘আল-কায়েদা ঘনিষ্ঠ সন্ত্রাসী’ ধারণাটি দুর্বল হয়।

২০১৯ সালে প্রথম দিকের বিশেষজ্ঞ হিসেবে খলিফা ইদলিবে প্রবেশের অনুমতি পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, তুরস্কের কেউ তাঁর খবর সংগ্রহে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেননি।

তুর্কি কর্মকর্তারা পরে বলেন, তাঁদের প্রভাবেই শারা ‘জিহাদি নেতা’ থেকে ‘বিপ্লবী’ চরিত্রে পরিণত হতে পেরেছেন। যাঁর লক্ষ্য ছিল, ইদলিবের সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা।

ওজকিজিলচিক বলেন, ইদলিব স্থিতিশীল হওয়ার পর এইচটিএস সেখানে এক ধরনের ছোট রাষ্ট্র গঠন শুরু করে, প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোকে শহরাঞ্চল থেকে সরিয়ে দেয়, পুলিশ বাহিনী গঠন করে, কর সংগ্রহ করে, ব্যবসায় সহায়তা দেয়। তিনি বলেন, মৌলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পর এ প্রদেশে বাইরে থেকে অর্থ ঢুকতে শুরু করে, যা ছিল রূপান্তরের বড় পদক্ষেপ।

এক আঞ্চলিক কর্মকর্তা স্মরণ করেন, এক তুর্কি দূত শারাকে বলেছিলেন, ‘তুমি দেখতে সুন্দর। মরতে চাইলে তোমাকে সুদর্শন শহীদ বলা হবে। কিন্তু বাঁচতে চাইলে তুমি সিরিয়ার শাসক হতে পারতে।’

দ্রেভন বলেন, যতই শারা নিজের দলে উগ্রপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন, ততই তাঁর বাস্তববাদী দিক প্রকাশের সুযোগ বেড়েছে। তিনি বলেন, শারা ইসলামি চিন্তায় বিশ্বাসী, কিন্তু তাঁর কোনো সুস্পষ্ট আদর্শ নেই। তিনি তত্ত্বের চেয়ে কাজে বিশ্বাসী।

আরও পড়ুন

মনোযোগ সরিয়ে নেয় রাশিয়া

২০২২ সালের মধ্যে তুরস্ক ও শারা—উভয়েই নতুন এক মোড়ে এসে দাঁড়ায়। ইউক্রেন-যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়া সিরিয়া থেকে সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে দেয়। এতে পুরো পরিস্থিতি বদলে যায়।

বছর শেষে এক কথোপকথনের সময় শারা নাকি বলেছিলেন, ‘সব জট খোলার আর খুব অল্প সময় বাকি। বিপ্লব আবার ২০১৫-এর আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।’

ঘটনাও তেমনই এগোতে থাকে। তুরস্ক আগেই এইচটিএসের নিয়ন্ত্রণে ইদলিবে গড়া একটি সামরিক একাডেমিতে বিনিয়োগ করেছিল। বই অনুবাদ করা হয়েছিল, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি তৈরি হয়েছিল, পূর্ণাঙ্গ পাঠক্রম ঠিক করা হয়েছিল।

এ একাডেমি আফগানিস্তান, মালি ও চেচনিয়ার যোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগায় এবং খুব সক্রিয় হয়ে ওঠে। অন্যদিকে উত্তর সিরিয়ায় তুরস্ক-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর তখনো কোনো সামরিক স্কুল ছিল না, যদিও ২০২৩ সালে তারা একটি গঠন করে।

তুর্কি এক কর্মকর্তা বলেন, তাঁরা কিছু ব্রিটিশ মধ্যস্থতাকারীকে শারার সঙ্গে যোগাযোগে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে জোনাথন পাওয়েল (সংঘাতের সমাধানবিষয়ক এনজিও ‘ইন্টার মিডিয়েট’-এর তখনকার চেয়ারম্যান ও বর্তমানে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা) এইচটিএসের পুনর্গঠনে সহায়তা করতে ২০২৩ সালে সিরিয়ায় সফর ও কর্মশালা আয়োজন করেন।

আরও পড়ুন

সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত রবার্ট ফোর্ডও গত বছর এক আলোচনায় এ যোগাযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

এইচটিএস ক্ষমতা বাড়ানো ও আরও এলাকা দখলে সক্ষম হওয়ায় শারা তুরস্ককে চাপ দিতে থাকেন, নতুন অভিযান চালানোর অনুমতির জন্য। কয়েক মাস ধরে তুরস্ক না বলেছিল। কারণ, এতে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া আসত ও মানবিক সংকট বাড়ত।

ওজকিজিলচিক বলেন, শেষ পর্যন্ত তুরস্ক তার ভেটো তুলে নেয়। কারণ, দামেস্কের সঙ্গে মিটমাটের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং রুশ কর্মকর্তাদের বক্তব্যও কঠোর হতে থাকে।

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১০ নভেম্বর ২০২৫
ছবি: এএফপি

২০২৪ সালের নভেম্বরে রাশিয়ার সিরিয়াবিষয়ক দূত আলেকসান্দার লাভরেন্তিয়েভ বলেছিলেন, তুরস্ককে সিরিয়ায় দখলদার শক্তির মতো আচরণ বন্ধ করতে হবে।

ওজকিজিলচিক বলেন, ‘তুরস্ক তার সেনাদের (ইদলিব থেকে) সরানোর বিষয়ে নিশ্চয়তা না দিলে আসাদের জন্য সংলাপে বসা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।’

এ নিয়ে আস্তানা বৈঠকেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। রাশিয়া ইদলিব থেকে তুর্কি সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা দাবি করে। ফলে আঙ্কারা নতুনভাবে ভাবতে শুরু করে।

ওজকিজিলচিক বলেন, এ অবস্থায় তুরস্কের মনোভাব ছিল, এইচটিএস পশ্চিমের আলেপ্পোর গ্রামাঞ্চল দখল করে শহরে পৌঁছে যাক। কিন্তু কেউই কল্পনা করেনি যে অভিযান এত দ্রুত হবে। একটির পর একটি শহর শারার বাহিনীর হাতে পড়তে থাকে।

আরও পড়ুন

শারা–ঘনিষ্ঠ এক সিরীয় সূত্র বলে, আলেপ্পো অভিযান যত এগোচ্ছিল, কাপ্তান আল-জাবাল ও আশপাশের গ্রামগুলো ততই একে একে দখল হচ্ছিল। এতে শারা অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন।

অপারেশন রুম থেকে শারা ওয়্যারলেসে ইউনিটগুলোর সঙ্গে কথা বলেন। তারা তখন আলেপ্পোর কেন্দ্র অভিমুখে এগোতে থাকে। আলেপ্পোর পতন ঘটে। শারা আনন্দিত হন। এরপর তাঁর যোদ্ধারা সিরিয়ার দক্ষিণে অভিযানে নামেন। হামা দখল হওয়ার পর তিনি প্রায় নিশ্চিত হয়ে যান, তাঁর এ বিপ্লব সফল হবে।

অপারেশন রুমে শারা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত তোলেন এবং আনন্দে চিৎকার করেন,‘দামেস্কের মানুষেরা! সাক্ষী থাকো! এখানেই ইতিহাস লেখা হচ্ছে!’

শারার আশপাশের লোকেরা পরে বলেন, এটাই ছিল প্রথম কোনো দৃশ্য, যখন তাঁকে এত আবেগপ্রবণ দেখা গেছে।

আরও পড়ুন