গাজাবাসীর অন্তহীন দুর্দশা গায়ে মাখছে না বিশ্ব

নিজেদের বিধ্বস্ত বাড়ি থেকে নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র সংগ্রহ করছে দুই ফিলিস্তিনি শিশু। সম্প্রতি গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে যায় তাদের বাড়িটি। রাফা, গাজা উপত্যকা, ৮ আগস্ট
ছবি: এএফপি

গত সপ্তাহে ‘ট্রুথফুল ডোন’ (সত্য ভোর) নামে ফিলিস্তিনের গাজায় ঠান্ডা মাথায় আরেকবার বোমাবর্ষণ করল ইসরায়েলের শাসকগোষ্ঠী। তিন দিনের এ বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৪৪ ফিলিস্তিনি। এর মধ্যে শিশু ১৫টি। আর আহত হয়েছেন কয়েক শ।

গাজার ওপর ১৫ বছর ধরে চাপিয়ে রাখা অবরোধ ইসরায়েলের কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি। তাই তো বছরের পর বছর এ উপত্যকা ক্রমাগত তাদের আতঙ্কজনক অভিযানের নিশানা হয়ে আসছে। এসব অভিযানে হাজারো বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন। আহত আরও হাজার হাজার। হামলা চালিয়ে পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অপরিহার্য বহু অবকাঠামো।

গাজাবাসীর অন্তহীন দুর্দশা, মানসিক আঘাত নিয়ে সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এমনই নানা তথ্য তুলে ধরেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা।

এক দশক আগে ২০১২ সালে জাতিসংঘ অনুমান করে বলেছিল, ২০২০ সালের মধ্যে গাজা বসবাসের অনুপযোগী শহরে পরিণত হবে। অনেক দিক থেকে এই অনুমান সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে।

এখন থেকে এক দশক আগে ২০১২ সালে জাতিসংঘ অনুমান করে বলেছিল, ২০২০ সালের মধ্যে গাজা বসবাসের অনুপযোগী শহরে পরিণত হবে। অনেক দিক থেকে এই অনুমান সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেই সেখানে বসবাস করছেন ২০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি। তাঁদের বেশির ভাগ যে শহরটিতে স্বেচ্ছায় থাকছেন, তা নয়। সাম্প্রতিক কিছু জরিপে দেখা গেছে, এখানকার প্রায় ৪০ ভাগ বাসিন্দা সুযোগ পেলে তাঁদের ঘরবাড়ি, ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবেন।

এটি বিস্ময়ের নয় যে গাজার বাসিন্দাদের অনেকে নিজেদের কোনো ভবিষ্যৎ দেখেন না।

ফিলিস্তিনের গাজায় বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল
ফাইল ছবি: এএফপি

গাজায় ফিলিস্তিনিদের জীবনধারণ করাটা সহজ নয় অনেক বছর ধরেই। কিন্তু ইসরায়েলি নেতাদের চাপিয়ে দেওয়া প্রতিটি ‘যুদ্ধ’, প্রতিটি ‘অভিযান’ ও প্রতিটি হামলা এই পরিস্থিতি জটিল থেকে আরও জটিল করছে।

উদাহরণ হিসেবে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ধারণাকে তুলে ধরা যায়। মন্ত্রণালয়ের ধারণা, অবরোধের শিকার হয়ে দীর্ঘকাল ধরে ধুঁকতে থাকা এখানকার স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা শিগগিরই মুখ থুবড়ে পড়বে। এর অন্যতম কারণ, বিদ্যুৎ–সংকট এবং জেনারেটর সচল রাখার জ্বালানি ফুরিয়ে আসতে থাকা। এর বাইরে সাম্প্রতিকতম বোমাবর্ষণ চালানোকালে গাজা অভিমুখী সব ক্রসিং বন্ধ করে রাখে ইসরায়েল। এতে শহরটিতে জ্বালানি ও অপরিহার্য পণ্যসামগ্রী প্রবেশে বাধার সৃষ্টি হয়।

যে আতঙ্কের শেষ নেই

গাজায় ৫ আগস্ট ইসরায়েলের সাম্প্রতিকতম বিমান হামলা শুরুর দুই দিন পর ৭ আগস্ট সন্ধ্যায় গাজাবাসীর ওপর বোমা ফেলা বন্ধ করে ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসলামিক জিহাদের মধ্যে মিসরের মধ্যস্থতায় হওয়া ‘যুদ্ধবিরতির’ আওতায় হামলায় আপাত ক্ষান্ত দিয়েছে দেশটি। তবে ইতিপূর্বে অন্যান্য ইসরায়েলি হামলার মতোই এই হামলার প্রতিক্রিয়াও ফিলিস্তিনিদের টানতে হবে অনেক দিন।

গাজার বাসিন্দারা যখন আগের বোমা হামলার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেন, ঠিক তখনই পরবর্তী হামলার আতঙ্কে ভুগতে থাকেন। ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও তাঁরা শারীরিক ও মানসিকভাবে যে আঘাতের শিকার হন, তা থেকে পরিত্রাণের পথ পান না। এ যেন এক অন্তহীন দুর্দশার সঙ্গেই বসবাস তাঁদের।

জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠন (এনজিও) গাজার অধিবাসীদের স্থায়ী মানসিক স্বাস্থ্যসংকট নথিভুক্ত করার চেষ্টা করছে, এটা নিশ্চিত। তবে এ ক্ষেত্রে তারা যেসব পদ্ধতি ও তত্ত্ব কাজে লাগাচ্ছে, সেসবের অনেকগুলো এখন পর্যন্ত পুরোপুরি অপর্যাপ্ত। যেমনটা বলছিলেন ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ড. সামাহ জাবের।

গাজা উপত্যকায় বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের বাহিনী। উদ্ধারকর্মী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন।
ছবি : এএফপি

সামাহ জাবের সম্প্রতি বলেন, এসব পদ্ধতি ও তত্ত্ব পুরোপুরি অপর্যাপ্ত হওয়ার কারণ, সংস্থা বা সংগঠনগুলো গাজাবাসীর সংকটকে পশ্চিমা ধারণায় বোঝার ও তুলে ধরার চেষ্টা করছে। অথচ এগুলো গাজার বাস্তবতায় খাটানো সম্ভব নয়। উদাহরণ হিসেবে, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) ধারণা ফিলিস্তিনিদের অভিজ্ঞতা বোঝার ক্ষেত্রে যথার্থ নয়। কেননা অবৈধ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী–ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় ফিলিস্তিনিদের অর্জিত অভিজ্ঞতা হলো পুনরাবৃত্তির। তাঁদের এ অভিজ্ঞতা অর্জন করে চলার বিষয়টি চলমান ও অবিচ্ছিন্ন ঘটনা।

গাজার বাসিন্দাদের অব্যাহত এই চাপ ও মানসিক আঘাত ছড়িয়ে পড়ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। বৃহত্তর পরিসরে তা ছড়িয়ে পড়ছে ফিলিস্তিনজুড়ে।

‘আমরা জানি আমরা ইউক্রেন না’

ফিলিস্তিনিদের এই মানসিক আঘাত, আতঙ্কের মধ্যেই গত সপ্তাহে ইসরায়েলের হামলার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আবার সেই আগের সুরেই কথা বলেছে। তারা ইসরায়েলকে এই হামলার জন্য পুরোপুরি দায়মুক্তি দিয়েছে।

ইসরায়েলের এই হামলা ঘিরে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন বহু রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিক। একই সঙ্গে ‘উত্তেজনা কমানোর’ ও ‘শান্তি’ ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে তাঁরা ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার জন্য ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করার বিষয়টা সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে গেছেন, যেন ইসরায়েলের হামলা নয়, বরং ৫ বছর বয়সী আলা কাদোউম ও ১১ বছর বয়সী দুই ভাই আহমেদ ও মোমেন আল নাইরাবের মৃত্যু হয়েছে সাধারণ ঘটনায়, যেন ইসরায়েলি শাসকেরা কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিদের হত্যা করেনি এবং আতঙ্কের মধ্যেও রাখেনি।

আরও পড়ুন

এমনকি ইসরায়েলের এই সহিংসতাকে শর্তহীন সমর্থন জানাতে ভুল করেনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বাকিরা। উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাসকে। ট্রুথফুল ডোন হামলা শুরুর পরপরই তিনি ইসরায়েলি সরকারের সমর্থনে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। সেখানে হামলায় ফিলিস্তিনিদের নিহত হওয়ার বিষয়টির কোনো উল্লেখ করেননি তিনি। তবে ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাজ্যের এই সমর্থন নতুন ঘটনা নয়।

ফিলিস্তিনিদের কথা, আমরা জানি, আমরা ইউক্রেন না। আমরা জানি, আমরা ইউক্রেনীয়দের মতো বিপুল সমর্থন পাব না। দখলদার শক্তিকে ঠেকানোর আমাদের যে অধিকার, তা কেউ রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে না। আমাদের শহীদদের নিয়ে কোনো ছবি প্রকাশ করবে না আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। পপ তারকা, হলিউড অভিনেতা, আর প্রধানমন্ত্রীরা গাজার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আমাদের পরিবারগুলোকে দেখতে আসবে না।

বাস্তবতা হলো, বিশ্বের রাজনৈতিক চিত্রপটে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন না এলে, ইসরায়েলের সরকার দায়মুক্তির সুবিধা পেয়ে বোমা হামলা চালিয়ে যাবে ও ফিলিস্তিনিদের হত্যা করবে।

আরও পড়ুন