গ্রেসি ম্যানশন: জোহরান মামদানির নতুন ‘রাজপ্রাসাদে’ কী আছে

নিউইয়র্কের মেয়রের সরকারি বাসভবন ‘গ্রেসি ম্যানশন’ছবি: গ্রেসি ম্যানশনের ওয়েবসাইট থেকে

গ্রেসি ম্যানশন—যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নগরের একটি বাড়ি। নিছক বাড়ি বললে ভুল হবে; বরং মেগাসিটি নিউইয়র্কের সামাজিক–রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। নিউইয়র্কের মেয়রের সরকারি আবাস এটি। অর্থাৎ যিনি এ নগরের মেয়র হন, তিনি পরিবার নিয়ে সরকারি এ বাড়িতে থাকতে পারেন। অতীত থেকে সেটাই হয়ে আসছে।

এরই মধ্যে ইতিহাস গড়ে নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন জোহরান মামদানি। ৩৪ বছরের এই তরুণ রাজনীতিক আগামী জানুয়ারিতে শপথ নেবেন। এরপর স্ত্রী রমা দুওয়াজিকে সঙ্গে নিয়ে গ্রেসি ম্যানশনেই উঠতে চান তিনি। বর্তমানে এই দম্পতি কুইন্সের একটি ভাড়া করা ছোট্ট ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন।

নিউইয়র্কে আবাসনসংকট প্রকট। ফ্ল্যাট কিংবা বাড়ির ভাড়া মাত্রাতিরিক্ত বেশি। নির্বাচনী প্রচার চালানোর সময় জোহরান মামদানি নিউইয়র্কবাসীর জন্য সাশ্রয়ী জীবনযাপন ও আবাসন খাতে স্থিতিশীলতা আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর পক্ষে তিনি ব্যাপক প্রচার চালিয়েছেন।

এ ছাড়া নবনির্বাচিত মেয়র পরিবার নিয়ে সরকারি ভর্তুকির একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন—এটা নিয়েও এই ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। যদিও তাঁদের ফ্ল্যাটটিতে শোবার ঘর মাত্র একটি। মাসে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলার ভাড়া গুনতে হয়।

নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি পরিবার নিয়ে সরকারি ভর্তুকির একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন—এটা নিয়েও এই ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। যদিও তাঁদের ফ্ল্যাটে শোবার ঘর মাত্র একটি। মাসে প্রায় ২ হাজার ৩০০ ডলার ভাড়া গুনতে হয়।

তাই বলা যায়, নির্বাচনী প্রচারের সময় থেকে শুরু করে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরও জোহরান মামদানির আবাসস্থল নিয়ে নিউইয়র্কের রাজনীতিতে কম জলঘোলা হয়নি। অবশেষে নিউইয়র্কের এই প্রথম মুসলিম মেয়র জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি স্ত্রীকে নিয়ে ঐতিহাসিক গ্রেসি ম্যানশনে বসবাস করবেন। এ যেন ছোট্ট ফ্ল্যাট ছেড়ে ‘রাজপ্রসাদে’ থিতু হওয়া।

জোহরান মামদানি বলেছেন, দুটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে গ্রেসি ম্যানশনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। একটি হলো পরিবারের সুরক্ষা। দ্বিতীয়টি নিউইয়র্কবাসীর জন্য ‘সাশ্রয়ী জীবনযাপন কর্মসূচি’ বাস্তবায়নের কাজে পুরোপুরি মনোনিবেশ করা।

নদীর ধারে পুরোনো বাড়ি

ম্যানহাটানের আপার ইস্ট সাইডের কার্ল শুরজ পার্কের ভেতর গ্রেসি ম্যানশন অবস্থিত। হলুদ রঙের এ বাড়ি কাঠের তৈরি। নকশা ফোডারেল স্টাইলের। ১৭৯৯ সালে গ্রেসি ম্যানশন তৈরি করা হয়। ১৯৪২ সাল থেকে এটি নিউইয়র্কের মেয়রের সরকারি বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

নিউইয়র্কের ঐতিহাসিক বাড়িগুলো তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা হিস্টোরিক হাউস ট্রাস্ট জানিয়েছে, ইস্ট রিভারের পাশে দোতলা কান্ট্রি ভিলা হিসেবে গ্রেসি ম্যানশনের নকশা করা হয়েছিল। গ্রীষ্মে বাড়ির বারান্দা থেকে ইস্ট রিভারের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়।

জোহরান মামদানি বলেছেন, দুটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে গ্রেসি ম্যানশনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। একটি হলো পরিবারের সুরক্ষা। দ্বিতীয়টি নিউইয়র্কবাসীর জন্য ‘সাশ্রয়ী জীবনযাপন কর্মসূচি’ বাস্তবায়নের কাজে পুরোপুরি মনোনিবেশ করা।

বাড়িটিতে পাঁচটি শোবার ঘর ও পাঁচটি বাথরুম রয়েছে। উঁচু সিলিংয়ের এ বাড়িতে রয়েছে বড় ফায়ারপ্লেস। রয়েছে পৃথক বসার ঘর ও একটি খাবার ঘর। দাপ্তরিক কাজকর্ম সাড়ার সুব্যবস্থাও রয়েছে বাড়িটিতে।

১৯৬০–এর দশকে গ্রেসি ম্যানশনের মূল ভবনের পাশে একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের জায়গা বানানো হয়। নিউইয়র্ক সিটি পার্ক অ্যান্ড রিক্রিয়েশন বিভাগের তথ্য বলছে, সব মিলিয়ে গ্রেসি ম্যানশনে ১২–১৩ হাজার বর্গফুট (প্রায় ১ হাজার ২০০ বর্গমিটার) জায়গা রয়েছে। বাড়িটি নিউইয়র্ক নগরের মালিকানাধীন সম্পদ হিসেবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।

আরও পড়ুন

‘গ্রেসি ম্যানশন’ নাকি ‘পিপলস হাউস’

আর্চিবল্ড গ্রেসি ছিলেন একজন স্কটিশ–আমেরিকান জাহাজ ব্যবসায়ী। ১৭৯৯ সালে তিনি এই বাড়ি নির্মাণ করেন। আর তাঁর নামানুসারে বাড়ির নাম হয় গ্রেসি ম্যানশন। নিরিবিলি পরিবেশে পরিবার নিয়ে বসবাস করার জন্য বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন খ্যাতিমান এই ব্যবসায়ী। তখন বাড়িটি শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছিল।

ধনী ব্যবসায়ী আর্চিবল্ড গ্রেসি একসময় তীব্র অর্থসংকটে পড়েন। তখন বাড়িটি তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায়। যদিও পরের সময়গুলোয় এ বাড়ি তাঁর নামেই পরিচিত ছিল। উনিশ শতকের শেষের দিকে ঐতিহাসিক এ বাড়ি নগর কর্তৃপক্ষের হাতে আসে। তখনো এ বাড়ির নাম বদলায়নি।

১৮৯৬ সালে বাড়িটি নগর কর্তৃপক্ষ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিলে এটি সরকারি সম্পত্তি হয়। পরে নিউইয়র্ক সিটি জাদুঘরের সাময়িক কোয়ার্টার হিসেবেও গ্রেসি ম্যানশন ব্যবহার করা হয়েছে।

১৯৪২ সালে নিউইয়র্ক সিটি পার্ক কমিশনার রবার্ট মোজেস তৎকালীন মেয়র ফিওরেলো লা গার্ডিয়াকে বাড়িটিকে মেয়রের সরকারি বাসভবন হিসেবে বিবেচনা করার অনুরোধ করেন। ওই সময়ে নিউইয়র্ক নগরের মেয়রের জন্য সরকারি কোনো বাসভবন বরাদ্দ ছিল না।

স্ত্রী রমা দুওয়াজির সঙ্গে জোহরান মামদানি
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

মোজেস বাড়িটিকে একটি মর্যাদাপূর্ণ বাসস্থান হিসেবে তৈরির সুযোগ দেখেছিলেন। বাড়িটিতে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য প্রধান শহরের নির্বাহীদের বাসভবনের প্রতিফলন ঘটানোর কথাও ভেবেছিলেন তিনি।

গ্রেসি ম্যানশন ১৯৮১ সাল থেকে পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারত্বের মাধ্যমে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। ২০০২ সালে তৎকালীন মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ বাড়িটির ভেতরে–বাইরে বড় ধরনের সংস্কার করেন। এর মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক বাড়িটিতে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার আরও সহজ হয়ে ওঠে। তখন থেকে এ বাড়ি ‘পিপলস হাউস’ নামেও পরিচিত হয়ে আসছে।

আরও পড়ুন

সব মেয়র কি থেকেছেন

আগেই বলা হয়েছে, গ্রেসি ম্যানশন শুরু থেকে নিউইয়র্কের মেয়রের সরকারি বাসভবন ছিল না। বাড়িটি ১৯৪২ সালে মেয়রের সরকারি আবাসস্থল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তখন ফিওরেলো লা গার্ডিয়াই প্রথম ‘নগরপিতা’ হিসেবে বাড়িটিতে ওঠেন।
এর পর থেকে নিউইয়র্কের বেশির ভাগ মেয়র সরকারি এ বাড়িতে থেকেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন এডওয়ার্ড কচ, ডেভিড ডিনকিনস, বিল ডি ব্লাসিও ও বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস।

ব্যতিক্রম ছিলেন মাইকেল ব্লুমবার্গ। তিনি তিন মেয়াদে মেয়র থাকার সময় বসবাসের জন্য সরকারি বাড়ির বদলে নিজের ব্যক্তিগত বাড়িকে বেছে নিয়েছিলেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ব্লুমবার্গ গ্রেসি ম্যানশনে না থাকলেও এখানে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করতেন।

কয়েকজন মেয়র তাঁদের মেয়াদকালের কিছু সময় ব্যক্তিগত বাড়িতে থেকেছেন। আবার কিছুটা সময় গ্রেসি ম্যানশনে থেকেছেন। তাঁদের মধ্যে এডওয়ার্ড কচ অন্যতম। আরও রয়েছেন রুডি জুলিয়ানির পরিবারের সদস্যরা।

আরও পড়ুন

বিক্ষোভ–আন্দোলনের সাক্ষী

গ্রেসি ম্যানশন শুধু ২২৫ বছরের বেশি পুরোনো বাড়ি নয়, নিউইয়র্ক নগরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিক্ষোভ ও আন্দোলনেরও সাক্ষী। এর মধ্যে কয়েকটি বিক্ষোভ আবার নগরের আবাসনের অধিকারকে ঘিরে হয়েছিল।

উদাহরণ হিসেবে ২০২৩ সালের আগস্টের কথা বলা যায়। ওই সময় অভিবাসনবিরোধী একটি সমাবেশ হয়েছিল। পাশাপাশি অভিবাসীদের অধিকারের পক্ষের লোকজন পাল্টা সমাবেশ করেন। তাঁদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে, যা গ্রেসি ম্যানশনের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল।

বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস যখন নিউইয়র্ক নগরে ‘আশ্রয় নেওয়ার অধিকার’–সংক্রান্ত প্রচলিত আইন বাতিলের চেষ্টা করেছিলেন, তখনো গ্রেসি ম্যানশনের বাইরে বড় প্রতিবাদ হয়েছিল। তখন প্রতিবাদকারীরা সেখানে গণহারে ‘ঘুমানোর’ কর্মসূচি পালন করেছিলেন।

অবশেষে ২০২৪ সালের মার্চে এরিক অ্যাডামস গৃহহীন অভিবাসী ও আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয়কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ৩০ দিনের জন্য থাকার অনুমতি দিয়ে গৃহহীনদের পক্ষে কাজ করা অধিকারকর্মীদের সঙ্গে একটি আইনি চুক্তিতে পৌঁছান।

জোহরান মামদানির বর্তমান অ্যাপার্টমেন্টে কোনো পাহারাদার বা বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। গ্রেসি ম্যানশনের আসল সুবিধা হলো এর উঁচু বেড়া, সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ক্যামেরা ও বাইরে অবস্থান করা পুলিশের দল।

আরও পড়ুন