অন্ধকার চিরস্থায়ী নয়
>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com
আমার কাজটাই এমন যে সেটাই আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে করোনার সঙ্গে। ভয় জাগানো এই মহামারির প্রায় শুরু থেকেই আমি কোভিড–১৯ সন্দেহভাজনদের নমুনা সংগ্রহ করে আসছি। এমনকি সাধারণ রোগীদের পরীক্ষা–নিরীক্ষার কাজও চলছে সমানতালে।
প্রথম দিকে যখন নমুনা সংগ্রহ করতে যেতাম, হাড়ের ভেতরে ভয়ের শিরশিরে অনুভূতি হতো। ধীরে ধীরে সব সয়ে এল। এখন তো সব যেন জীবনযাত্রার অংশই হয়ে এল। শুরুতে মনে যখন ভয় জেগে উঠত, মনকে বলতাম, ‘তুমি তো মানুষের সেবার জন্য লড়াই করছ। এমন মানবজীবন আর কি পাবে?’ সেই ভয় এখন কোথায়?
তবে নিজের মনের ভেতরের পৃথিবী আর বাইরের বাস্তবের জগৎ তো আর এক নয়। হাসপাতালে কাজ করি। তাই অনেকেই সব সময় খোঁজখবর রাখতেন। কেমন আছি? কী খবর? যদি কখনো কারও কাজে লেগে যাই। আমার সাধ্যের মধ্য থেকে উপকার করারও চেষ্টা করেছি মানুষকে। কিন্তু করোনা শুরু হওয়ার পর একেবারে উল্টে গেল দৃশ্যপট। করোনার কারণে মানুষ এমনিতেই তো সঙ্গ এড়িয়ে চলতে শুরু করল। কিন্তু আমি হাসপাতালে চাকরি করি বলে হয়ে গেলাম যেন একেবারে অচ্ছুত। দেখলেও কেউ চেনেন না, এমন ভাব।
হাসপাতালের কাজ সেরে বাসায় ফিরে প্রথমেই কাপড়চোপড় বদলে বাথরুমে গিয়ে ভালোমতো গোসল। তারপর বাকি সব কাজ।
আমার বয়স্ক মা থাকেন গ্রামের বাড়িতে। আজকাল কেন যেন তাঁকে খুব বেশি মনে পড়ে। ফোন করে খবর নিই তাঁর। ‘কেমন আছ, মা?’ এ প্রশ্ন করামাত্র মায়ের কণ্ঠে বাষ্প। মা বলেন, ‘ভালো আছি।’ তারপর সেই ভেজা গলাতেই আমাকে অভয় দিয়ে বলেন, ‘তোমার কিছুই হবে না। তুমি ভালো থাকবে।’ তাঁর দোয়ায় আল্লাহর অশেষ রহমতে সুস্থ ও ভালো আছি। এর মধ্যে কোভিড–১৯ পরীক্ষা করিয়েছিলাম। ফলাফল নেগেটিভ এসেছে।
তারপর এই কঠিন সময়ের মধ্যেও সামান্য সময় বের করলাম। চলে গেলাম গ্রামের বাড়িতে, স্ত্রী আর দুই মেয়েকে নিয়ে। কী যে আনন্দপূর্ণ সময় কাটল! বাড়িতে একসঙ্গে খাওয়া, গাছ লাগানো, ঘর গোছানো, হইহল্লা করা। সেই শৈশবের স্মৃতি ফিরে এল। এই বদ্ধ সময়ে ঝরনাধারায় মনটা ধুয়ে গেল যেন।
রাতে আমাদের সবার কথার ঝুলি খুলে যেত। অন্ধকার রাত। গল্প বলার পরিবেশ, ঝিঁঝি পোকার শব্দে ভরা। মাঝেমধ্যে শিয়ালের ডাক। এর মধ্যে কি আর ঘুম আসে? মা তো জেগে জেগেই রাত কাটিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাছে পেয়েছেন। শুধু তাঁর উপরি ঝঞ্ঝাট আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা। কারণ, চারদিকে কানাঘুষা চলছে, আমি নাকি করোনা নিয়ে এসেছি। অথচ করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ হয়েই আমি এসেছি।
একসময় বাড়ি থেকে ঢাকায় ফেরার সময় হয়ে এল। ঢাকার অবস্থা ভালো নয়। তবু বাবার খাওয়াদাওয়ার অসুবিধা হবে বলে মেয়েরাও ঢাকায় ফিরবেই। ঢাকায় ফিরে ওরা আমাকে গরম লেবুপানি দেয়। কিছু লাগবে কি না, তার খোঁজ নেয়। এটাও যেন আরেক মা–ছেলের ভালোবাসা। কিছুদিন পরে আমার স্ত্রীও স্বামী–সন্তানের কাছে ফিরে এল। ফিরে এসে শাশুড়িকে নিয়ে আবার দুর্ভাবনার শুরু। বাড়িতে মা একা একা কী করছে, কী খাচ্ছে? আমার হাসপাতালে ডিউটি নিয়ে বাড়িতে কাতর মা। আর এখানে উৎকণ্ঠিত স্ত্রী–সন্তানেরা।
আমি শুধু মনে মনে ভাবি, রাত যত গভীর হয়, ভোর তো ততটাই ঘনিয়ে আসে। এই অন্ধকার তো চিরস্থায়ী হতে পারে না।