সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে আমের চাষ বাণিজ্যিক রূপ নিয়েছে। কিন্তু আম বাংলাদেশের মানুষের কাছে শুধুই একটি বাণিজ্যিক কৃষিপণ্য নয়। আমগাছ এ দেশের জাতীয় বৃক্ষ তো বটেই, একই সঙ্গে তা আমাদের সংস্কৃতি ও পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তার অন্যতম উৎস। এসব বিশ্লেষণ তুলে ধরে আম গবেষক ও বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ দেশের মাটি ও আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা আমগাছে রাসায়নিক উপকরণের ব্যবহারের চেয়ে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনাই বেশি লাভজনক ও টেকসই হবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুর রহিম এ পর্যন্ত একাই ২৩টি আমের নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন। ইতিমধ্যে উদ্ভাবিত অনেক আমের জাতের উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বেশি ও নিরাপদ ফলন নিয়ে তাঁর গবেষণা রয়েছে। অধ্যাপক রহিমের মতে, ‘কালটার’ বা প্যাকলোবিউট্রাজল নামের রাসায়নিক উপকরণটি বাংলাদেশের আম চাষের জন্য উপযুক্ত নয়। কেননা, এটি প্রয়োগ করে উৎপাদন বাড়লেও আমের গুণগত মান কমে যায়। আমের আঁশের স্বাদ ও পুষ্টিমানও কমে।
অধ্যাপক রহিম ও তাঁর ছাত্র বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বাবুল চন্দ্র সরকার যৌথভাবে বাংলাদেশের আম, ফুল ও সবজি চাষে কালটারের ব্যবহার নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণা করেছেন। কালটার ব্যবহার করে ফলানো আম এবং শুধু সার, গোবর ও সেচব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে চাষ করা আমের মধ্যে তাঁরা কিছু তুলনাও করেছেন। তাতে দেখা গেছে যে দ্বিতীয় ধরনের আমের পুষ্টিমান ও স্বাদ অপেক্ষাকৃত ভালো।
২০১৩ ও ২০১৪ সালে বাংলাদেশ জার্নাল অব অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশিত ওই দুই গবেষকের একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, আমগাছে কালটার পরিমিত মাত্রায় ব্যবহার করলেও তা দীর্ঘ মেয়াদে গাছের জন্য ক্ষতিকারক। এটি আমের প্রাকৃতিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। মাটি থেকে আমগাছের খাদ্য গ্রহণের প্রক্রিয়াকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এ ব্যাপারে এম এ রহিম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের জন্য আম চাষের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনাই উপযুক্ত। এখানে আমগাছে যত বেশি রাসায়নিক উপকরণ ব্যবহার করা হবে, তত বেশি ঝুঁকি তৈরি হবে। নিয়ম মেনে এটি ব্যবহার করলেও তা আমগাছের ক্ষতি করবে।
অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও আম গবেষক শরফ উদ্দিনের মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত, চীন বা ব্রাজিলের আম চাষের বেশ পার্থক্য রয়েছে। ওই সব দেশে জমির পরিমাণ অনেক বেশি। তারা কোনো একটি জমিতে টানা ২০ থেকে ৩০ বছর কোনো একটি ফসলের চাষ করে। তারপর ওই গাছগুলো কেটে ফেলে নতুন ধরনের কোনো একটি ফসলের চাষ করে। ফলে ওই সময়ের মধ্যে তারা নানা আমগাছে নানা ধরনের রাসায়নিক উপকরণ ব্যবহার করে অল্প সময়ে বেশি মুনাফা পায়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে আমগাছ ও বাগান শুধু স্বল্প মেয়াদে মুনাফার ব্যাপার নয় বলে মনে করেন শরফ উদ্দিন। তাঁর মতে, এখানকার মানুষ একটি আমগাছ লাগিয়ে তা শত বছর ধরে বংশপরম্পরায় যত্ন করে। কালটার ব্যবহার স্বল্প মেয়াদে মুনাফার জন্য উপযুক্ত। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা আমগাছের জীবনীশক্তি শেষ করে দেয়। আমগাছ বেশি দিন বাঁচে না।