এক দুপুরে বিউটি বোর্ডিংয়ে

যাব যাব করে যাওয়া হচ্ছিল না। কিন্তু চৈত্রের এক সকালে পণ করলাম, আজ যেতেই হবে। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। কাঠফাটা রোদ মাথায় নিয়ে দুপুরে রওনা হলাম পুরান ঢাকার দিকে। গন্তব্য ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিং।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যাওয়াটা সহজ। এরপর বাহাদুর শাহ পার্ক পার হয়ে বাংলাবাজার। একটু এগিয়ে পেলাম প্যারিদাস রোড। রাস্তায় একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘শ্রীশ দাস লেনটা কোথায়? বিউটি বোর্ডিং যাব।’ মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক দেখিয়ে দিলেন।

ডান দিকের নিচতলার খাবারঘরে মিলবে সুস্বাদু খাবার।

বিউটি বোর্ডিংয়ের সাইনবোর্ড দেখে ভেতরে ঢুকতেই স্বাগত জানাল এক টুকরো বাগান। ফুটে আছে নানা রঙের ফুল। বাগান থেকে চোখ ফেরাতেই দেখা মিলল একটি পুরোনো বাড়ির। হলুদ রঙের, অনেকটা ‘এল’ আকৃতির দোতলা। প্রখর রোদের মধ্যেও একটা শীতল ভাব—গাছগাছালি আর বাগানের জন্যই সম্ভবত। ডান পাশে অফিস ঘর। এর সামনে চোখে পড়ল একটি ডিজিটাল ব্যানার। শোকের কালো ব্যাজের ওপর লেখা ‘যে বন্ধুদের হারিয়েছি’। এই বন্ধুদের তালিকায় আছে শামসুর রাহমান, জিয়া আনসারী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু, সমুদ্র গুপ্ত, সন্তোষ গুপ্তসহ আরও কয়েকজনের নাম।

বিউটি বোর্ডিংয়ের বাগানে ফুটে থাকা ফুল।

প্রশ্ন জাগতে পারে, বিউটি বোর্ডিংয়ের সঙ্গে এই নামগুলোর যোগসূত্র কোথায়? উত্তরটা জানতে ফিরে যেতে হবে একটু পেছনে। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর বাংলাবাজার এলাকা মুদ্রণ ও প্রকাশনাশিল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। তখন থেকে শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে বিউটি বোর্ডিং। তাই তাঁদের স্মরণ করছে ‘আত্মার আত্মীয় হে বন্ধু, কাছে থেকো হৃদয়ের’ লিখে।

বিউটি বোর্ডিংয়ের বাগানে ফুটে থাকা ফুল।

বিউটি বোর্ডিংয়ের মূল ভবনের নিচতলার একটি অংশে খাবারঘর। ছোট ছোট টেবিল আর চেয়ার পাতা। হাত ধুয়ে একটি টেবিলে বসতেই সামনে এল স্টিলের থালা আর গ্লাস। এবার একটি জগে করে এল পানি, সেগুলো ধোয়ার জন্য। থালা-গ্লাস ধুয়ে পানিটা ফেলার জন্য পেলাম একটি বাটি। থালা-গ্লাস ধুয়ে যখন খাবার খাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত, তখন ছোট্ট একটা স্টিলের বাটিতে করে দেওয়া হলো লেবু-কাঁচা মরিচ। এবার পাতে পড়ল ভাত। যিনি খাওয়াচ্ছিলেন, তিনি ভাজি-ভর্তার নাম বলে জানতে চাইলেন কোনটা কোনটা খাব। অর্ডার পেয়ে পাতে তুলে দিলেন সেসব পদ। এবার জানতে চাইলেন, মাছ-মাংস কী লাগবে। মাছের কথা বলতেই বড় আকারের যে পেটিটা দিয়ে গেলেন, দেখেই মন ভরে গেল। আর স্বাদটাও টাটকা মাছের।

বিউটি বোর্ডিংয়ের বাগানে ফুটে থাকা ফুল।

খাওয়া শেষে

শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয়েছে প্রয়াত পুরোনো বোর্ডারদের।

বিল দিতে গিয়ে কথা হলো বিউটি বোর্ডিংয়ের বর্তমান দুই মালিকের একজন তারক সাহার সঙ্গে। তিনি জানালেন, তাঁর বাবা প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও চাচা নলিনী কান্ত সাহা মিলে বিউটি বোর্ডিং করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আরও কয়েকজনের সঙ্গে শহীদ হন তাঁর বাবা। এরপর থেকে দেখভাল করছেন তাঁরা দুই ভাই।

জানতে চেয়েছিলাম—বিউটি বোর্ডিংয়ে মানুষ কেন আসবে? তারক সাহা হেসে বললেন, ‘বিউটি বোর্ডিং তো কালের সাক্ষী। সেটা দেখতে আসবেন। খাওয়ার জন্যও আসতে পারেন। ছোট-বড় যে মাছটাই খাওয়াই, সেটা টাটকা থাকে।’ কথোপকথন চলার মধ্যেই এক প্রবীণ ব্যক্তি এসে তাঁদের ঘরে খাবার পাঠিয়ে দিতে বললেন। তিনি চলে যেতেই জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কী? তারক সাহা বললেন, ‘উনারা এখানকার পুরোনো বোর্ডার। মাঝেমধ্যে বন্ধুরা এসে এখানে আড্ডা দেন।’

কাঠগোলাপের গাছে পাতার চেয়ে ফুলই যেন বেশি।

বিল মিটিয়ে বিদায় নেওয়ার সময় বোর্ডিংয়ের মালিক বললেন, খাবারঘরের পেছন দিয়ে সিঁড়ি আছে। চাইলে ঘুরে দেখতে পারেন। তাঁর সেই প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করে দোতলায় গিয়ে পুরোটা ঘুরে দেখলাম। বেশির ভাগ কক্ষই তালাবদ্ধ। সেখান থেকে নেমে দেখা হলো বাগানটা। হঠাৎই চোখে পড়ল, একটা কাঠগোলাপের গাছ। পাতা কম, শুধু ফুল আর ফুল। গাছের নিচে পড়ে থাকা ফুল কুড়িয়ে গন্ধ নিলাম, চুলে গুঁজলাম। বেলা পড়ে এল, ফেরার তাড়া। বাইরের ফটকে পা রাখতেই মনে হলো, কতশত মানুষের স্মৃতি আর গল্পকে পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছি!

পাতাহীন গাছটা যেন বিউটি বোর্ডিংয়ের প্রতিচ্ছবি।