ওয়াহেদ ম্যানশনের সরু গলিতে পড়ে ছিল ২৬ লাশ
চকবাজারের ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলার একটা গলিতেই পাওয়া যায় ২৬টি মৃতদেহ। একজনের দেহ আরেকজনের ওপর পড়ে ছিল। কেউ ছিলেন চিত হয়ে, কেউবা উপুড় হয়ে। রাত একটার পর এতগুলো লাশ একসঙ্গে দেখেন লালবাগ ফায়ার স্টেশনের লিডার সাইদুল করিম। রাত চারটার দিকে লাশগুলো একে একে বের করে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে।
২৪ বছরের চাকরি জীবনে আগুন নিয়ন্ত্রণে বহু জায়গায় কাজ করেছেন সাইদুল করিম। কিন্তু একসঙ্গে এত লাশ কখনো দেখেননি তিনি। তাঁর ভাষায়, লাশগুলো আগুনে পোড়েনি। আগুনের প্রচণ্ড ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন তাঁরা। নৃশংস সেই স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সাইদুলকে।
আগুন লাগার খবর পেয়ে সেদিন রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে চলে আসেন সাইদুল করিম। এসে তিনি দেখেন, চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। রাস্তায় থাকা যানবাহন জ্বলছে, ভবন জ্বলছে। ওয়াহেদ ম্যানশনের ভেতরে থাকা বডি স্প্রে গ্রেনেড-বোমার মতো বিস্ফোরিত হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা স্থানীয় জনগণের সহায়তা নিয়ে আগুন নেভানোর জন্য প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সাইদুল করিম শনিবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চকবাজারের চুড়িহাট্টায় এসে দেখি, বিশাল আগুন। আমরা কাজ করতে থাকি। এ আগুন ছিল ভয়ংকর। কাজ করার পর আমরা দেখি মানুষের মৃতদেহ। কাজ করার একপর্যায়ে ওয়াহেদ ম্যানশনে গিয়ে একসঙ্গে পাই ২৬ লাশ। একজন আরেকজনের ওপরে শুয়ে আছে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাই। আগুন যখন নিয়ন্ত্রণে আসে, গভীর রাতে লাশগুলো প্যাকেটে স্থানান্তর করি।’
আগুন লাগার শুরুতে কী দেখেছেন? জানতে চাইলে সাইদুল করিম বলেন, ‘রাস্তা থেকে আমরা আগুন দেখতে পাই। ঢাকা শহরের প্রায় ৩৭টা ইউনিট এখানে চলে আসে। দেখি, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ওয়াহেদ ম্যানশনে বিকট আওয়াজ হতে থাকে। গ্রেনেডের মতো বিকট শব্দ হয়। ওয়াহেদ ম্যানশনের দুই তলায় কাজ করেছি। ফায়ার সার্ভিসের প্রত্যেক কর্মকর্তাসহ অন্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন।’
সাইদুল করিম আরও বললেন, ‘আমি দেখেছি বিকট আগুন। বডি স্প্রে বিস্ফোরিত হয়ে পাশের ভবনে যাচ্ছে। ওয়াহেদ ম্যানশনের দেয়ালগুলো ধূলিসাৎ হয়েছে। আশপাশের অনেক ভবন নষ্ট হয়েছে।’
সাইদুল করিম বলেন, ‘লোক মারফত শুনেছি, সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হওয়ার পর রাস্তায় যে যে অবস্থায় ছিলেন, তিনি সেখানে মারা গেছেন। কেউ ছিলেন রিকশায়, কেউ ছিলেন মোটরসাইকেলে, কেউ ছিলেন পিকআপে। আগুনে দগ্ধ হয়ে কয়লার মতো হয়ে গেছেন। কাজ করার সময় দেখেছি পায়ের তলায় লাশ। ’
ওয়াহেদ ম্যানশনের ২৬ লাশ পাওয়ার ব্যাপারে সাইদুল করিম বলেন, ‘আশপাশে ছিল ওষুধ ফার্মেসির দোকান, ছিল ফ্লেক্সিলোডের দোকান। আগুন লাগার পর যে যার দোকানে ছিলেন। তাঁরা বাঁচার জন্য ওয়াহেদ ম্যানশনের ভেতরে একটা সরু গলি ছিল, সেই গলিতে বাঁচার জন্য গিয়েছিলেন সবাই। যদি পেছন থেকে যাওয়ার কোনো পথ থাকত, তাহলে সবাই বেঁচে যেতেন। কিন্তু সবাই মারা গেছেন ধোঁয়ার জন্য। একটা লোকও কিন্তু পোড়ে নাই। ২৬ লাশের মধ্যে কোনো নারীর লাশ ছিল না। শুধু শিশুর একটা লাশ পাই। বয়স তাঁর পাঁচ বছরের মতন। রাত একটা থেকে দেড়টা সময়, এই লাশের খোঁজ আমরা পাই। লাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাই। রাত যখন গভীর হয়, তখন লাশ বের করে আনা হয়। লাশগুলো অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।’
চুড়িহাট্টার রাস্তার লাশগুলো পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। ফায়ার লিডার সাইদুল করিম বলেন, ‘ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে ডেন্টাল ক্লিনিকে পাওয়া লাশগুলো পোড়েনি। চেয়ারের ওপর বসেছিলেন এমন লাশ পাওয়া যায়। রোগীদের কেউ শুয়ে ছিলেন, ওই অবস্থায় তিনি মারা যান। তাঁরা বাঁচতে পারতেন কিন্তু শাটার বন্ধ করে দেওয়ায় বের হতে পারেননি তাঁরা।’
চুড়িহাট্টার গলিতে সেদিন ছিল যানজট। আগুন লাগার পর যানজটে আটকে থাকা অবস্থায় অনেকে মারা গেছেন। সাইদুল করিম বললেন, ‘সেদিন এখানে প্রচণ্ড যানজট ছিল। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তা আশপাশে ছড়িয়ে গেছে। কেউ কোথাও যেতে পারে নাই। রাস্তায় যে এত লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, প্রথমে আমরা বুঝতে পারিনি। আমরা কল্পনাও করিনি, রাস্তায় লাশ পড়ে আছে। প্রথমে ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনের সড়কে একটা প্রাইভেট কারের পাশে একটা শিশু আর এক নারীর লাশ দেখি। এরপর যত সামনে যাই রাস্তায় লাশ দেখতে পাই।’
ফায়ার লিডার সাইদুল করিম বারবার বলছিলেন, ‘ওয়াহেদ ম্যানশনের ভেতর একসঙ্গে পাওয়া ২৬ লাশের স্মৃতি আমি জীবনে কোনো দিন ভুলতে পারব না। লাশের এই দৃশ্য না দেখলে কাউকে বোঝানো যাবে না। পাঁচ বছরের শিশু বাচ্চাটা ছিল চিত হয়ে। আমার ধারণা, রাস্তার মানুষগুলো সবার আগে মরেছেন। মুহূর্তের মধ্যে এতগুলো মানুষের প্রাণ হারিয়ে গেল। শেষ হয়ে গেল মানুষের জীবন।’
চকবাজারের চুড়িহাট্টার আগুন কেড়ে নিয়েছে ৬৭ জনের প্রাণ।
আরও পড়ুন
-
চুয়াডাঙ্গায় ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
-
স্কুল, মাদ্রাসায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ক্লাস বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের
-
প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ, সব প্রাথমিক বিদ্যালয় ২ মে পর্যন্ত বন্ধ
-
সুশৃঙ্খল ব্যাংক খাতের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করার পরামর্শ এডিবি কান্ট্রি ডিরেক্টরের
-
আগামীকালও ঢাকাসহ ২৭ জেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করল শিক্ষা মন্ত্রণালয়