Thank you for trying Sticky AMP!!

করোনায় বদলে যাওয়া এক শহরের গল্প

করোনার কারণে প্রায় সবকিছু বন্ধ। আর চিরচেনা রাজধানী ফাঁকা এক শহর। ছবি: লেখক

বিশ্বে এখন এক আতঙ্কের নাম কোভিড-১৯। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে পুরো দুনিয়ার হিসাব–নিকাশ ওলট-পালট করে দিয়েছে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস। চীনের উহানে ধরা পড়ার পর এ ভাইরাস আজ সারা বিশ্বের সবার দরজায় পৌঁছে গেছে। ইতিমধ্যে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের বুকেও তার করাল থাবা বসিয়েছে। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের আগমনী বার্তার মধ্যে কিছুদিন আগে ছেলেটাকে পেটের সমস্যায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। অবশেষে এক সপ্তাহ কাটানোর পরে গত বৃহস্পতিবার রিলিজ পাওয়া গেল।

ছেলেটাকে যখন ভর্তি করা হয়েছিল, তখন করোনা নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে এতটা সতর্কতা অবলম্বন করতে দেখিনি। কিন্তু হঠাৎ করেই দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে লাগল। হাসপাতালের সদর দরজা লাগিয়ে দিয়ে সীমিত আকারে রোগী ভর্তি ও দর্শনার্থী প্রবেশের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হলো। যাদের প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছিল, সবাইকে হ্যান্ড থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মেপে প্রবেশ করানো হয়। হাসপাতালের প্রবেশদ্বারে সাবান রেখে সবারই হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করে বাধ্যতামূলক করে হয়েছিল। এই পরিবর্তনগুলো সবই হঠাৎই কয়েক দিনের মধ্যে করা হলো।

যা হোক, এর মধ্যে ছেলের রিলিজের দিনে বাসায় আসার জন্য রাস্তায় দাঁড়াতেই (২৮ মার্চ) দেখি, জনমানবহীন, গাড়িবিহীন এক নতুন শহর। এর মধ্যেই সরকার কোভিড-১৯ প্রতিরোধের অংশ হিসেবে ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে এবং সেই সঙ্গে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো বন্ধ করে দিয়েছে তার কয়েক দিন আগেই। যা হোক, বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা পেলাম। অতিরিক্ত ভাড়ায় সিএনজিতে চড়তে বাধ্য হলাম। দুপুরের পরে মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচ থেকে সিএনজিচালিত অটোরনিকশা এগিয়ে চলেছে। চৈত্রের দুপুরে চারদিকে এক সুনসান নীরবতা। একমাত্র সিএনজিচালিত অটোরিকশার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ কানে তো আসেই না, এমনকি কোন গাড়ি ও চোখে পড়ল না। জাহাঙ্গীর গেট পার হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা আগারগাঁওয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। অন্য সময় এই জায়গায় বিজয় সরণিতে গাড়ির দীর্ঘ সারি লেগে থাকে। আজ কোনো গাড়িই চোখে পড়ল না।

এর মধ্যে অটোরিকশা আগারগাঁও মোড়ে চলে এসেছে। আগারগাঁও মোড়ে একজন ট্রাফিককে দেখলাম দায়িত্ব পালনের স্বার্থে রৌদ্রের মধ্যে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন। অন্যদিন এই সময় তাঁর খুব ব্যস্ত সময় কাটে। এসব ভাবতে ভাবতে অটোরিকশা তালতলা হয়ে শেওড়াপাড়ায় প্রবেশ করল। দুই পাশের দোকানপাট বলতে গেলে সবই বন্ধ। অবশেষে বাসায় ফিরলাম। বাসার নিচের চায়ের দোকানটাও আজ বন্ধ। সেই চিরচেনা আড্ডাটা আজ নেই।

যা হোক, বাসায় ফিরে আবার গৃহবন্দী জীবন কাটাতে লাগলাম। তিন দিন পরে জরুরি কিছু কেনাকাটার জন্য সকাল ১০টার পরে বাসা থেকে মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস পরে বের হলাম। বাসার নিচে নামতেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল, এ এক পুরাই অচেনা নগরী। গলিতে কোনো মানুষ নেই। দু–একটা কুকুর অলস শুয়ে আছে। তাদের দেখে মনে হলো তারাও মানবজাতিকে খুব মিস করছে। এসব ভাবতে ভাবতে মূল রাস্তার সঙ্গে একটা সুপারশপের উদ্দেশে পা চালালাম। পথিমধ্যে শুধু একজন বাসার দারোয়ানকে দেখলাম মাস্ক পরে মোবাইলে যেন কিছু একটা দেখছে। আশপাশের দোকানপাট সব বন্ধ। চারদিকে এক ভীতিকর নীরবতা। মূল রাস্তায় এসে দু–একটা রিকশা দেখলাম। জরুরি প্রয়োজনে আমার মতো দু-একজন বের হয়েছেন, তাঁদের জন্য এই রিকশাই একমাত্র বাহন। সুপারশপে ঢুকে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে রিকশায় বাসার উদ্দেশে রওনা দিলাম। রিকশা এগিয়ে চলেছে আর মনে মনে ভাবছি, আমরা তো এই রকমই একটা শহর চেয়েছিলাম, যেখানে কোনো যানজট থাকবে না। মানুষের কম কোলাহল থাকবে। ধুলাবালুমুক্ত একটা শহর হবে। কিন্তু না, এই শহর দেখে কেমন জানি ভালো লাগছে না। খুব বেশি বেমানান লাগছে। মিস করছি ওই সব মানুষের কোলাহল, যারা জীবিকার তাগিদে এই আজব শহরে ভিড় জমায়। বাসের হেলপারের হাঁকডাক মিস করছি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, পিজি, বারডেম...।

হয়তো খুব তাড়াতাড়ি এই অচলাবস্থা কেটে যাবে। কোভিড-১৯ বিদায় নেবে এই দুনিয়া থেকে। মানুষ আবার নিয়মিত জীবনে ফিরে যাবে। যেখানে সকালবেলা বাবা তার ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছেলের হাত ধরে স্কুল পানে ছুটবে। কর্মজীবী মানুষ সকাল সকাল অফিসে যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষায় লাইনে দাঁড়াবে, গলির পাশের চায়ের দোকানে আবার আড্ডা জমবে, নতুন বাইকওয়ালা সন্ধ্যাবেলা হেলমেট ছাড়া অলিগলি দাপিয়ে বেড়াবে, যানজটে স্থবির হয়ে যাবে আমাদের এই প্রিয় শহর, বাসচালকের সহকারী গলা ফাটিয়ে আবার বলবে, ওস্তাদ বাঁয়ে প্লাস্টিক...।