
লাঠির বদলে মাইক হাতে পাড়ায় পাড়ায় গান গাইছে পুলিশ। ‘পেটোয়া’ বাহিনীর এই নতুন রূপের সঙ্গে আমজনতার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস। সামাজিক দূরত্ব তৈরির জন্য পুলিশ শুধুই মারধরই করে না, মানুষকে ঘরে থাকার জন্য সচেতন করতে গান লিখে গাইতেও পারে। কলকাতা পুলিশের অর্কেস্ট্রা দলের সেই গান গাওয়া নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়েছে।
এত দিন পুলিশ ভেবেছিল, আইন প্রয়োগ করতে হলে তাদের অতিমাত্রায় কঠোর হতে হবে। আর এখন ভাবছে, কতটা মানবিক হয়ে আইন প্রয়োগ করা যায়। কাজও হবে আবার মানুষ ক্ষুব্ধ হবে না—এমন পুলিশিং এখন সারা দুনিয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে কারণে, করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য মানুষকে ঘরে আটকে রাখতে বা লকডাউন কার্যকর করতে পুলিশকে আরও কী করতে হবে, শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে কত দূরে যেতে হবে—পৃথিবীর সব পুলিশ তা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখছে।
সংক্রামক ব্যাধি হোক বা না হোক, রোগে আক্রান্ত মানুষকে সেবা দিয়ে, চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলা চিকিৎসক ও চিকিৎসা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাজ। সেটা কোনোভাবেই পুলিশের নয়। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড, ভবন ধস, জঙ্গি–সন্ত্রাস মোকাবিলা বা দুর্ঘটনায় পুলিশ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সহায়তাও করেছে। সেটাও ছিল স্থান-কাল-পাত্রবিশেষে। এখন সেখানে করোনা এনে দিয়েছে এক ভিন্ন বাস্তবতা। সেই বাস্তবতা দুনিয়াজুড়ে। এখানে ‘ব্যবস্থাপত্র’ হিসেবে চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুলিশিং। এই পুলিশিংয়ের আরেক নাম ‘লকডাউন’। যেন জীবন বাঁচাতে ওষুধ ও লকডাউন—দুটো দাওয়াই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
তবে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে সব দেশের পুলিশ যে মানবিক আচরণ করেছে তেমনটা নয়, অনেক দেশ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশি আক্রমণাত্মকও হয়েছে। কোনো কোনো দেশে মারাত্মক সহিংসতারও সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে নতুন আইন করতে হয়েছে। অনেক দেশ চোখধাঁধানো প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়েছে। আর হয়তো সে কারণেই নিউইয়র্ক থেকে ব্যাংকক বা ইউরোপ থেকে বাংলাদেশ—সর্বত্র মানুষ সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছে।
যদিও এসব করতে গিয়ে সাধারণ নাগরিকের মতো পুলিশকেও করোনার মুখে পড়তে হচ্ছে। খোদ নিউইয়র্ক সিটির সাড়ে পাঁচ হাজার পুলিশ সদস্যকে করোনা পরীক্ষার পর ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশও তা থেকে বাদ নেই। দেশের দুটি থানার সব পুলিশসহ তিন শ পুলিশকে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হচ্ছে। অনেক পুলিশ সদস্যের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে।
ঢাকায় মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা মোকাবিলায় দেশের পুলিশের কাজের তালিকা অনেক। যেমন সংক্রমণ ছড়ানো ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, রাস্তায় জীবাণুনাশক ছিটানো, শ্রমজীবী মানুষকে সহায়তা করা, সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করা, চিকিৎসা না পেয়ে থানায় হাজির হওয়া মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, ঘরে থাকা মানুষের কাছে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য পৌঁছে দেওয়া, কোয়ারেন্টিন থেকে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা, লকডাউন এলাকায় মানুষের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা। এ ছাড়া করোনায় মৃতদের দাফনের ব্যবস্থাতেও পুলিশকে থাকতে হচ্ছে। ঢাকাসহ সারা দেশের লাখের বেশি পুলিশ দিনরাত এ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম বললেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি, কতটা মানুষের পাশে থাকা যায়। এখন সেটাই পুলিশের জন্য খুব জরুরি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশ প্রতিদিন ছয় হাজার মানুষকে এক বেলা করে খাবার দিচ্ছে। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ প্রতিদিন অনেক মানুষের বাড়িতে বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। পুলিশের এসব কাজকে ভালো চোখে দেখছে মানুষ।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, রাস্তায় দেখা মানুষকে ঘরে যেতে বললে পুলিশের সেই নির্দেশ তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে ঘরে ফিরে যাচ্ছেন। কারণ, তাঁরা ধরে নেন এই নির্দেশের পেছনে হয়তো একটি নিষ্ঠুরতা আছে। কিন্তু সেই নির্দেশদাতা যখন সঙ্গে একটি খাবারের প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দেন, তখন দায়িত্ববোধের সঙ্গে মানবিকতাও যুক্ত হয়ে যায়।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কমিশনার মাহবুবর রহমান বললেন, এই পুলিশিং বাংলাদেশের পুলিশ আগে কোনো দিন করেনি। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি এটাকে সেবা ও আস্থা অর্জনের কাজও বলা যেতে পারে। যাতে ভবিষ্যতে পুলিশ মন্দ কাজ করলেও মানুষ যেন বিবেচনায় নিতে পারে, এরা ভালো কাজও করে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, লকডাউন কার্যকর করতে তাঁরা দুটি আইন সহজেই প্রয়োগ করতে পারেন। এর একটি হলো, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮৮ ধারা, যেখানে সরকারের জারি করা আদেশ না মানাকে অপরাধ হিসেবে দেখা হয়েছে। অন্যটি হলো, সংক্রমণ রোগ প্রতিরোধ আইন, যা ২০১৮ সালে প্রণীত হয়। এই আইনে সংক্রামক ব্যাধি ছড়াতে সহায়তা করাকে অপরাধ হিসেবে দেখা হয়েছে। কিন্তু এই আইন প্রয়োগের চেয়ে তাঁরা জোর দিচ্ছেন মানুষের সচেতনতায়।
বিশ্বব্যাপী আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা পুলিশ এক্সিকিউটিভ রিসার্চ ফোরামের নির্বাহী পরিচালক চেক ওয়েক্সলার নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, সামাজিক দূরত্বের কারণে প্রচলিত অপরাধ হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু এতে যেন মানুষ বিষাদগ্রস্ত না হয়ে পড়ে এবং এর কারণে পারিবারিক নির্যাতন না বাড়ে, সেদিকেও দৃষ্টি দেওয়ার সময় এসেছে।
মানবাধিকার রক্ষার দেশ বলে পরিচিত অস্ট্রেলিয়া লকডাউন কার্যকর করতে নতুন আইন করেছে। এই আইনে প্রয়োজন ছাড়া বাইরে এলেই সর্বোচ্চ ১৬৫২ ডলার জরিমানা গুনতে হবে। সেখানে পুলিশের ত্রাণসামগ্রী বিতরণের কোনো কাজ নেই। তার বদলে তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখছেন মানুষ কেমন আছেন। কোনো সমস্যা আছে কি না, পারিবারিক নির্যাতন হচ্ছে কি না, সে খবরও নিচ্ছে পুলিশ।
অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী সাংবাদিক ফজলুল বারী বললেন, সেখানে রাতের বেলা হেলিকপ্টারে করে পাহারা দেয় পুলিশ। এ সময় কপ্টার থেকে কড়া আলো রাস্তায় এসে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নিজের ক্ষমতাবলে নতুন নির্দেশ জারি করেছেন। দরকার ছাড়া রাস্তায় বের হলে ৫০০ ডলার পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হবে। কিন্তু পুলিশের সেই কঠোরতা সেখানে নেই। জরিমানা করেছেন এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। করোনায় কেউ মারা গেলে সবার আগে পুলিশ গিয়ে সব খতিয়ে দেখবে, তারপরই লাশের শেষকৃত্য হবে। নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র জরুরি নম্বরে ফোন করলেই পুলিশ এসে দরজায় হাজির হয়।
লকডাউন কার্যকর করতে নতুন আইন করেছে যুক্তরাজ্যও। নতুন আইনে খুব দরকার ছাড়া সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। কেউ সেই আইন ভাঙলে প্রথম দফা তাঁকে ৬০ পাউন্ড জরিমানা গুনতে হবে। পরেরবার একই অপরাধ করলে জরিমানা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এভাবে দফায় দফায় এক হাজার পাউন্ড পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। এর আগে যুক্তরাজ্য সরকার মানবিক কাজে সহায়তার জন্য স্বেচ্ছাসেবী চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয়। তাতে ৩৫ লাখ লোক সাড়া দেয়। সব বাছাই করে ১৫ লাখকে চূড়ান্ত করা হয়। এসব স্বেচ্ছাসেবী হাসপাতালে রোগী পৌঁছে দেওয়া, চিকিৎসার কাজে নিয়োজিত ডাক্তার, নার্সসহ হাসপাতাল কর্মীদের খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। কেউ আক্রান্ত হলে তাঁরা এগিয়ে যাচ্ছেন। স্বেচ্ছাসেবীদের কারণে পুলিশের কাজ সেখানে অনেকটা সহজ হয়ে গেছে।
করোনা মোকাবিলায় লকডাউন কার্যকর করতে ফ্রান্স সব মিলিয়ে এক লাখ পুলিশ মোতায়েন করেছে। সেই সঙ্গে সারা দেশে পথে পথে চেকপয়েন্ট বসিয়েছে। সেই পুলিশ মানুষের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করছে।
মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে লকডাউন একেবারে ভিন্ন রকম। সংক্রমণ ঠেকাতে পুলিশ বহিরাগত কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। মুদিদোকান, ফার্মেসি বা চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে হলে আগে থেকে পুলিশের অনুমতি নিয়ে বের হতে হবে। এই অনুমতি দেওয়া হয় অনলাইনে। কোনো ধরনের ঝামেলা নেই, পুলিশের অ্যাপে ঢুকে একটি ফরম পূরণ করে দিলেই অনুমতি মেলে। তবে বাইরে বেরোলে মাস্ক ও গ্লাভস পরা বাধ্যতামূলক।
গত সপ্তাহে ভারতীয় টেলিভিশন এনডিটিভির এক খবরে দেখা যায়, ভারতের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ জড়ো হওয়া মানুষকে ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা করছে। ১৩ এপ্রিল সিএনএনের খবরে বলা হয়, ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে লকডাউন কার্যকর করতে যাওয়া পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা হয়। এতে একজন পুলিশ সদস্যের হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং ছয়জন কর্মকর্তা গুরুতর আহত হন। পাঞ্জাব পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক হরজিৎ সিংয়ের সেই হাতটি প্রায় আট ঘণ্টা অস্ত্রোপচারের পর সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু এর উল্টো চিত্র আছে বিভিন্ন রাজ্যে। কেরালায় সামগ্রী থেকে শুরু করে সবকিছু বিতরণের দায়িত্ব পুলিশের। পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যে মানুষের মনে আস্থা বাড়াতে পাড়ায় পাড়ায় গান গেয়ে বেড়াচ্ছে পুলিশ। করোনাকালে যেন ভিন্ন এক পুলিশকে দেখছে ভারতবাসী।
মালয়েশিয়ায় লকডাউন কার্যকর করতে ড্রোন ব্যবহার করছে পুলিশ। রাস্তায় কেউ হাঁটছে কি না, পুলিশ তা–ও দেখছে। শহর ও গ্রামের পথে পথে চেকপোস্ট বসিয়েছে পুলিশ। কিন্তু কোনো খাবারের দোকানে পণ্য সরবরাহ ঠিক আছে কি না, সেটাও নিশ্চিত করছে পুলিশ। কোথাও খাবারের ঘাটতি দেখা দিলে দ্রুত তার ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ। আবার কেউ যাতে বেশি পণ্য কিনে মজুত করতে না পারে, তা–ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
সিঙ্গাপুরে সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশি ব্যবস্থা জোরদার হয়েছে। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে সিঙ্গাপুরে আসা লোকদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হচ্ছে। এই থাকা-খাওয়ার খরচ দিচ্ছে সরকার। উড়োজাহাজের বিজনেস শ্রেণির যাত্রীদের রাখা হচ্ছে স্যান্টোসা আইল্যান্ডের পাঁচ তারকা হোটেলে। সে খরচও দিচ্ছে সিঙ্গাপুর সরকার। আবার সিঙ্গাপুরের যেসব শ্রমিক কাজ করছেন, তাঁদেরও খাবার দিচ্ছে সরকার। কাজ না করেও তিন বেলা খাবার চলে যাচ্ছে ঘরে ঘরে। এই পুরো কার্যক্রম তদারক করছে পুলিশ বাহিনী, যেন খাবারের জন্য কেউ ঘর থেকে বের না হন।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিষয়ের অধ্যাপক জেমস কলগ্রোভ ২ এপ্রিল নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘আইন প্রয়োগ করা আরও জটিল হয়ে ওঠে যখন মানুষকে পেটের তাগিদে বাইরে যেতে হয়। এই অবস্থায় মানুষকে কী করতে হবে, সেটা ব্যাখ্যা করে জানিয়ে দিতে হবে, যাতে সে মনে না করে যে তার ওপর সব চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা মনে রাখতে হবে, কেউই হুমকি দেওয়া পছন্দ করে না।’