
>সাত বিভাগে ৬ হাজার ৭১৯টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত। আইসিইউ হবে ২৬৬টি।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এ পরিস্থিতিতে ঢাকার বাইরে সাত বিভাগেও চিকিৎসা–সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে। তবে সাত বিভাগে অনেকগুলো আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত করা হলেও সংকট নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ)। এখন ঢাকার বাইরে আইসিইউর সংখ্যা বাড়ানো শুরু হলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
সংকটাপন্ন রোগীকে ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস সেবা দেওয়ার জন্য আইসিইউ প্রয়োজন হয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের একটি বড় অংশের জন্য আইসিইউর সুবিধা প্রয়োজন। চিকিৎসা–বিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২৯ মার্চ পর্যন্ত ইতালিতে আক্রান্ত রোগীদের ১২ শতাংশের আইসিইউ প্রয়োজন হয়।
ঢাকা ছাড়া সাতটি বিভাগে কোভিড–১৯ চিকিৎসার জন্য মোট ৬ হাজার ৭১৯টি আইসোলেশন শয্যা (বিচ্ছিন্ন রাখার জন্য শয্যা) প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে আইসিইউ থাকবে ২৬৬টি। তবে এসব আইসিইউর অনেকগুলোই এখন পর্যন্ত প্রস্তুত হয়নি। রাজধানীর বাইরে ঢাকা বিভাগে আইসোলেশন শয্যা আছে ৬৯৭টি। চট্টগ্রাম বিভাগে ১৩৩টি আইসিইউ আছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। তবে বাস্তবে কতগুলো আইসিইউ প্রস্তুত আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেখানকার কোভিড–১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সবচেয়ে বড় হাসপাতাল চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালেই এখন পর্যন্ত আইসিইউর সুবিধা প্রস্তুত হয়নি। রংপুরে ৫০টি আইসিইউ বসানো হবে। এখন পর্যন্ত একটিও প্রস্তুত হয়নি।
৪ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, দেশে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য মোট ১১২টি আইসিইউ প্রস্তুত আছে। এর মধ্যে ৭৯টি ঢাকায়। ৩৩টি অন্যান্য বিভাগে। অবশ্য ইতিমধ্যে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে আইসিইউর সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালকেও যুক্ত করা হচ্ছে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের ৮৫ শতাংশ ঢাকা বিভাগের। রাজধানী ঢাকায় ইতিমধ্যে ৯টি হাসপাতাল শুধু কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকায় কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা চলছে। বাকি সাতটি হাসপাতাল প্রস্তুত আছে। এ ছাড়া সরকারি–বেসরকারি আরও ছয়টি হাসপাতাল প্রস্তুত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
মন্ত্রী গতকাল দৈনন্দিন বুলেটিনে জানান, ঢাকায় মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতালের পুরোনো ভবন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুরোনো বার্ন ইউনিট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভবন, রাজধানীর সাহাবউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (৫০০ শয্যা) ও আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (৭০০ শয্যা) কোভিড–১৯ চিকিৎসার জন্য নেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি জেলায় বেসরকারি হাসপাতালগুলো এগিয়ে আসছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, এখন বিশ্বব্যাপী ভেন্টিলেটরের সংকট আছে। এর মধ্যেও ৪০০ থেকে ৫০০ ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ প্রস্তুত হতে আরও সময় লাগবে
রাজধানীর বাইরে জেলাওয়ারি হিসাবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত নারায়ণগঞ্জে। এখান থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংক্রমণ ছড়ানোর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এই জেলা চিকিৎসাসেবা দিতে এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। শহরের খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতালকে শুধু করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। গতকাল ওই হাসপাতালের জরুরি বিভাগ চালু হয়েছে। তবে এটি পুরো প্রস্তুত হতে আরও সময় লাগবে।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক গৌতম রায় প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ, আইসিইউ, ভেন্টিলেটরসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রস্তুত করতে ১৫–২০ দিন লাগবে। ১০টি আইসিইউসহ ৫০ শয্যার আইসোলেশন প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত জরুরি বিভাগে সর্দি, কাশি, জ্বরের রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হবে। এ সময় করোনায় আক্রান্ত ও সন্দেহভাজন রোগীদের দেখে প্রয়োজনে অন্য সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হবে।
এ ছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলে ৫০ শয্যার সাজিদা ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ৩০ শয্যার আইসোলেশন ইউনিটে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রামের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন
কোভিড–১৯ চিকিৎসার জন্য কয়েকটি নির্ধারিত হাসপাতালসহ মোট ১ হাজার ৬৬৩টি শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। স্বাস্থ্য বিভাগের চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক হাসান শাহরিয়ার কবির দাবি করেন, এই বিভাগে ১ হাজার ৬৬৩টি শয্যার মধ্যে আইসিইউ আছে ১৩৩টি। ভেন্টিলেশন আছে ৬৬টি। আড়াই শ শয্যার চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, বিটিআইডিআইটির ৩২ শয্যাসহ ২০ শয্যার কয়েকটি হাসপাতাল শুধু কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসার জন্য ৬৬ শয্যা প্রস্তুত আছে।
তবে চট্টগ্রামের প্রস্তুতি বিশেষত আইসিইউ নিয়ে প্রশ্ন আছে। কোভিড–১৯–এর জন্য নির্ধারিত জেনারেল হাসপাতালে গতকাল পর্যন্ত কোনো আইসিইউ ছিল না। সেখানে তিন বছর ধরে আটটি আইসিইউ পড়ে আছে। নতুন ১০টি আইসিইউ এসেছে। কিন্তু সেগুলো এখনো প্রস্তুত নয়। পার্ক ভিউ নামে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালকে ১০টি আইসিইউ প্রস্তুত রাখতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যে ১৩৩টি আইসিইউর কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোর বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতালের। কিন্তু সেগুলো দেওয়া হবে কি না, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
চট্টগ্রাম বিভাগের সমন্বয়কারী ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আ ন ম মিনহাজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কাগজে চার ধাপে ১২টি বেসরকারি হাসপাতালের নাম আছে, যারা আইসিইউ সেবা দেবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব হাসপাতাল ব্যবহার করতে দেবে কি না, তা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। হাসপাতাল দিতে রাজি আছে, সে রকম কোনো চুক্তিও হয়নি।
সিলেটে প্রস্তুত হচ্ছে ৯ আইসিইউ, ময়মনসিংহে ৮০০ শয্যা
সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, ওই বিভাগে কোভিড–১৯ চিকিৎসার জন্য মোট ৬৩৭টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে আইসিইউর সুবিধা থাকবে ১১টি। এখন পর্যন্ত দুটি ভেন্টিলেটর ও আইসিইউ ইউনিট প্রস্তুত আছে।
সিলেটে করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ১০০ শয্যার সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাকে (সদর হাসপাতাল) নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে দুটি ভেন্টিলেটর এবং আইসিইউ ইউনিটে দুটি শয্যা প্রস্তুত রয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি ঢাকা থেকে আরও ৯টি ভেন্টিলেটর এবং ৯টি আইসিইউ শয্যা পাঠানো হয়েছে। এগুলো স্থাপনের কাজ শেষ হতে আরও সপ্তাহখানেক লাগবে বলে জানিয়েছেন ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক হিমাংশু লাল রায়।
সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে ময়মনসিংহ বিভাগে ৮০০টির মতো শয্যা প্রস্তুত আছে। এর মধ্যে আইসিইউ আছে ১৬টি। বিভাগের চারটি হাসপাতালকে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো ময়মনসিংহে ৬০ শয্যার এস কে হাসপাতাল, এখানে পাঁচটি আইসিইউ আছে। শেরপুরে ১৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল, নেত্রকোনার ৫০ শয্যার আধুনিক সদর হাসপাতাল ও জামালপুরে নির্মাণাধীন শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি ভবনে ১০০ শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে। ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক আবুল কাশেম প্রথম আলোকে এসব তথ্য জানান।
রংপুরে বসবে ৫০ আইসিইউ
রংপুর বিভাগে মোট আইসোলেশন শয্যা আছে ৭৮৭টি। নবনির্মিত ১০০ শয্যার রংপুর শিশু হাসপাতালে ৫০টি আইসিইউ শয্যা স্থাপনের কাজ চলছে। প্রথম পর্যায়ে বসবে ১০টি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় কার্যালয় সূত্র জানায়, রংপুর বিভাগে এখন পর্যন্ত ১৫ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। রংপুরে শয্যা প্রস্তুত হওয়ার আগে যদি কারও আইসিইউ প্রয়োজন হয়, তাহলে ঢাকায় পাঠাতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক গোপেন্দ্রনাথ আচার্য বলেন, রাজশাহীতে মোট শয্যা রাখা হয়েছে ১ হাজার ৫৯০। আইসিইউ আছে ১৬টি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি অংশ ব্যবহার করার জন্য প্রস্তুত আছে। আরেকটি হাসপাতাল নেওয়ার চেষ্টা চলছে।
বরিশাল ও খুলনা
স্বাস্থ্য বিভাগের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক রাশেদা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, খুলনা বিভাগে আইসোলেশন শয্যা আছে মোট ৭৯৫টি। এর মধ্যে আইসিইউ আছে ১৮টি। খুলনা ডায়াবেটিক হাসপাতালকে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলা পর্যায়ে ৩৬৩টি এবং প্রতিটি উপজেলায় দুটি করে ৮৪টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে। মোট আইসোলেশন শয্যা আছে ৪৪৭টি। এখানে ২৮টি আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, সম্পদ সীমিত, সাধারণত হাসপাতালগুলোত একটি নির্দিষ্টসংখ্যক শয্যা থাকে। হঠাৎ করে একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেসরকারি সব মেডিকেল ও ক্লিনিকের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। সারা দেশে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে যত আইসিইউ আছে, যখন প্রয়োজন হবে এসব আইসিইউ ব্যবহার করা হবে।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা)