৭ সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা

খাদ্যে ক্ষতিকর মাত্রায় ফরমালিন মেলেনি

সাতটি সরকারি সংস্থা বলছে, বাজার থেকে আমসহ বিভিন্ন ফল ও খাদ্যসামগ্রী কিনে তা পরীক্ষা করে তাতে ক্ষতিকারক মাত্রায় ফরমালিন পাওয়া যায়নি।
কৃষিবিষয়ক পাঁচটি সরকারি সংস্থা যৌথভাবে একটি এবং বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি আলাদাভাবে বিভিন্ন ফল পরীক্ষা করেছে।
কৃষিবিষয়ক সংস্থাগুলো বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) কাছে এবং বিএসটিআই হাইকোর্টে তাদের পরীক্ষার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এসব সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীর বিভিন্ন বাজার থেকে আমসহ অন্যান্য মৌসুমি ফল সংগ্রহ করে তা স্বীকৃত ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে যে মাত্রায় ফরমালিনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, তা মানবদেহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিকের ব্যবহার কতটা নিরাপদ? শীর্ষক গবেষণাটি করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে৷ সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিল বিএআরসি৷
ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ফরমালিন পরীক্ষার জন্য ‘জেড-৩০০’ নামের যে যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয় এই গবেষণায়৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের গবেষকেরাও যন্ত্রটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
তবে ফলমূল ও অন্যান্য খাদ্যে ফরমালিন আছে কি না, থাকলে তা কোন মাত্রার এবং তা কতটুকু ক্ষতিকারক—তা নিয়ে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যেই মতবিরোধ রয়েছে৷ পরিবেশবাদীদের একাংশ বলছে, ফল ও অন্যান্য খাদ্যে ক্ষতিকর ফরমালিন মেশানো হচ্ছে, যা মানবদেহের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দেশজুড়ে সাড়াশি অভিযানে নেমেছে৷ তারা যে যন্ত্র দিয়ে ফলে ফরমালিন পরীক্ষা করছে, সরকারি পাঁচটি গবেষণা সংস্থা সেই যন্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে৷
২০১১ থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত করা ওই গবেষণায় বলা হয়, আম, লিচু ও জামের মতো বেশির ভাগ মৌসুমি ফলে প্রাকৃতিকভাবেই ফরমালিন থাকে। কিন্তু ওই যন্ত্রে চিহ্নিত ফরমালিন প্রাকৃতিক নাকি কৃত্রিমভাবে দেওয়া—তা বোঝা যায় না।
গবেষণাটির তত্ত্বাবধানকারী বিএআরসির পুষ্টি বিভাগের পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ফরমালিন চিহ্নিতকরণ যন্ত্র কোনো ফলের সামনে রাখলে তা ফরমালিন আছে বলে সংকেত দেয়। কিন্তু ওই ফরমালিন ফলের প্রাকৃতিক ফরমালডিহাইড, না বাইরে থেকে প্রয়োগ করা—তা নির্ণয় করার কোনো প্রযুক্তি বাংলাদেশে এখনো নির্ধারণ হয়নি। এমনকি কোন ফলে প্রাকৃতিকভাবে কী পরিমাণ ফরমালিন আছে, তার কোনো হিসাবও সরকারি কোনো সংস্থার কাছে নেই।
িবএআরসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফলমূল ও অন্যান্য খাদ্যে ফরমালিনের চেয়ে মারাত্মক সব বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু পুলিশের অভিযানে ফরমালিন ছাড়া অন্য কোনো রাসায়নিক চিহ্নিত করা হচ্ছে না। ফলে কীটনাশক, হরমোনগ্রোথসহ নানা ধরনের রাসায়নিক ব্যবহারের বিষয়টি আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।
গবেষকদের মতে, কীটনাশক ও হরমোনগ্রোথ (ফলের বৃদ্ধি সহায়ক রাসায়নিক) ফলমূলে প্রয়োগ করায় তা অবশেষ আকারে খাদ্যে রয়ে যাচ্ছে। খাদ্যের সঙ্গে তা শরীরে প্রবেশ করে তৈরি করছে ক্যানসারসহ নানা ধরনের প্রাণঘাতী রোগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক মনে করেন, খাদ্যে রাসায়নিকের ব্যবহার বন্ধে পুলিশ বর্তমানে যে অভিযান পরিচালনা করছে, তাতে নিরাপদ খাদ্য নিয়ে একধরনের সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ী ও উৎপাদকেরা এতে সাবধান হবেন। দু-এক বছর এ ধরনের অভিযান চললে তা ভবিষ্যতে নিরাপদ খাদ্য পেতে সহায়তা করবে।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন এই মতের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন৷ তিনি বলেন, ফল-সবজি ও

শস্য উৎপাদনের প্রতিটি পর্যায়ে ক্ষতিকারক মাত্রায় কীটনাশক ও হরমোনগ্রোথ দেওয়া হচ্ছে। ওই খাদ্য ভোক্তা পর্যায়ে আসার পরেও ওই রাসায়নিকের অবশেষ রয়ে যায়, যা খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করছে। কিন্তু এই বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যাপারে সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই।
বিএআরসির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমে আসলে ফরমালিন নয়, বেশি দেওয়া হচ্ছে ইথোফেন নামের একধরনের রাসায়নিক। ফল পাকানো ত্বরান্বিত করতে বিশ্বজুড়ে ইথোফেন প্রয়োগ একটি স্বীকৃত পদ্ধতি। এটি প্রয়োগের পর তা দ্রুত বাষ্প হয়ে উবে যায়। আর এর অবশেষও ফলের মধ্যে থাকে না। ফলে ইথোফেন দিয়ে পাকানো ফল খেলে তা মানবদেহের জন্য তেমন ক্ষতিকারক নয়। তবে ইথোফেন দেওয়া ফলের পুষ্টিমান কম থাকে।
ওই গবেষণায় দেখা গেছে, আম পাকাতে ব্যবসায়ীরা ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করছেন। যার অবশেষ হিসেবে ভারী ধাতু আর্সেনিক ও সামান্য ফসফরাস ফলের মধ্যে রয়ে যাচ্ছে। ফলের মাধ্যমে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে, এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। এই গবেষণা প্রতিবেদনে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
গবেষণাটির জন্য রাজশাহীর বাজার ও আড়ত থেকে আম সংগ্রহ করে ইথোফেন গ্রুপের রাসায়নিকের অবশিষ্টাংশ নিরূপণ করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, আমের প্রতিটি নমুনায় ইথোফেনের অবশিষ্টাংশ বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে কম রয়েছে। উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে ফল আহরণ পর্যন্ত সময়ে আমে ব্যবহৃত কোনো রাসায়নিকের প্রভাব বা অবশিষ্টাংশ পাঁচ-ছয় দিনের বেশি থাকে না।
তবে গবেষণার প্রয়োজনে মাঠপর্যায়ে ঘুরে দেখা গেছে, আম পাড়ার আট-দশ দিন আগে অনেক চাষি গাছে কীটনাশক (কার্বনডাজিন, প্রপিকোনাজল, মেনকোজেব) ছিটান। যার অবশিষ্টাংশ আমে রয়ে যায়। এ ছাড়া, অনেক ব্যবসায়ী বেশি মুনাফার আশায় মার্চ-এপ্রিলে আম পাকার আগেই তা গাছ থেকে পেড়ে তাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দেন।
এ ছাড়া, অধিকাংশ ফলচাষি উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে সিনথেটিক পেস্টিসাইড যেমন সাইফারমেথ্রিন, ক্লোরোপাইরিফস, ইমামোন্টিং, বেনজোয়েট, স্পাইনোসেড, ইমিডাক্লোরপিড, থায়ামিথক্সাম ইত্যাদি প্রয়োগ করেন। সাধারণত উৎপাদনকারীরা অনুমোদিত মাত্রার ১০ থেকে ১৫ গুণ বেশি কীটনাশক ব্যবহার করে থাকেন।
এদিকে, ফরমালিন নিয়ে ভীতি ছড়িয়ে পড়ার পর সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির পক্ষ থেকে ফলমূল পরীক্ষা করা হয়। সিআইডি কর্মকর্তারা ১২টি বাজার থেকে ফল সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেন। পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাপারে জানতে চাইলে সিআইডির প্রধান মোখলেসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সিআইডির পরীক্ষায় ক্ষতিকর মাত্রায় ফরমালিন পাওয়া যায়নি।
বিএআরসির পুষ্টি িবভাগের পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ফরমালিন মেশানোর অভিযোগ তুলে যেভাবে ফলমূল ধ্বংস করা হচ্ছে এবং সাধারণ গরিব খুদে ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হচ্ছে, তা অন্যায় এবং এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
দেশে ফরমালিনের মাত্রা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন ফল ও সবজিতে গড়ে প্রতি কেজিতে ৩ থেকে ৬০ মিলিগ্রাম ফরমালডিহাইড থাকে। আর সামুদ্রিক মাছেও গড়ে প্রতি কেজিতে ১ থেকে ১৪০ মিলিগ্রাম ফরমালডিহাইডের উপস্থিতি রয়েছে।
বিএআরসির ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে ফলে ইথোফেন বা ইথরেল ব্যবহার করা হচ্ছে। ইথোফেন একটি ফলের পক্বতা ত্বরান্বিত করার একটি বৈধ রাসায়নিক। ফলের পরিপক্বতা ও জাত অনুযায়ী এটি প্রয়োগ করা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পদ্ধতি। ল্যাবটেরিতে পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, ইথোফেন প্রয়োগের এক ঘণ্টা পর তা ফলের দেহ থেকে দ্রুত বের হয়ে যায়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা নির্ধারিত মাত্রা ২ পিপিএমে চলে আসে।
গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, বিশ্বের অনেক দেশে মানবদেহের জন্য ফরমালডিহাইডের সহনীয় মাত্রাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যেমন ইতালির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১৯৮৫ সালে খাদ্য হিসেবে মাছ ও চিংড়ির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মাত্রা প্রতি কেজিতে যথাক্রমে ৬০ ও ১০ মাইক্রোগ্রাম নির্ধারণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা কর্তৃপক্ষের মতে, একজন ব্যক্তি প্রতিদিন প্রতি গ্রাম দৈহিক ওজনের জন্য সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম ফরমালিন গ্রহণ করতে পারে।
ভোক্তাদের জন্য পরামর্শ: গবেষণায় ফলে রাসায়নিকের ব্যবহার থেকে যে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়, তা মোকাবিলায় কয়েকটি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ফল কেনার পর তা খাওয়া বা রান্নার আগে প্রবহমান পানিতে চার-পাঁচ মিনিট ধুয়ে নিতে হবে। আম আস্ত না খেয়ে কেটে খেতে হবে। এতে রাসায়নিকের বিস্তার কমে যায়।
মৌসুমের শুরুতে (মার্চ থেকে মধ্য এপ্রিল) আম না খাওয়াই ভালো। এ সময় আম অপরিপক্ব থাকে বলে ক্যালসিয়াম কার্বাইড বেশি ব্যবহৃত হয়। ফলের গায়ে যদি ছোপ ছোপ দাগ থাকে বা পাউডার জাতীয় পদার্থ থাকে, তাহলে তা কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে। বাজার থেকে কেনার পর এক থেকে দুই দিন বাইরে রেখে তার পর খেলে তাতে রাসায়নিকের উপস্থিতি কমে আসে।