
চুয়াডাঙ্গায় সমাবেশ করে স্থানীয় মানুষের হাতে লাঠি-বাঁশি তুলে দিয়েছে পুলিশ। মাগুরাতেও একই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ধারাবাহিক গুপ্তহত্যা ও জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মনোবল ও সচেতনতা বাড়াতে এ কর্মসূচি
নেওয়া হচ্ছে।
তবে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের সর্বোত্তম পন্থা এটা না, এ দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় বাহিনীর। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া লাঠি হাতে মানুষ অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে।
গত ২৬ এপ্রিল দুর্বৃত্তের হাতে নিহত ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নানের বাড়িতে গিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী মানুষের ঘরে ঘরে পাহারা দিতে পারবে না। নাগরিকদের
নিজস্ব নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে এলাকাবাসীর সঙ্গে পুলিশের সুসম্পর্ক থাকবে, সহযোগিতা থাকবে।
পুলিশপ্রধানের এ বক্তব্যের সমালোচনা এসেছিল বিভিন্ন মহল থেকে। এর মধ্যেই দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দুটি জেলার পুলিশ নাগরিকদের হাতে লাঠি-বাঁশি তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়।
চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জানান, গতকাল মঙ্গলবার চুয়াডাঙ্গার পুলিশ সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ ও বদরগঞ্জ বাজারে পৃথক ‘সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ’ করে। বেলা তিনটায় সরোজগঞ্জ বাজারের সমাবেশে অন্তত ৪০ জনের হাতে লাঠি ও বাঁশি তুলে দেওয়া হয়। বাজার উন্নয়ন কমিটির সভাপতি এম আবদুল্লাহ শেখের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. রশীদুল হাসান। এসপি বলেন, এলাকায় টার্গেট কিলিং, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সভায় জেলা কৃষকলীগের সভাপতি আজিজুল হক, কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আলি আহাম্মেদ হাসানুজ্জামান বক্তব্য দেন। বিকেল পাঁচটায় বদরগঞ্জ বাজারে একই ধরনের সমাবেশ হয়।
একইভাবে গত দুই দিনে মাগুরার চার উপজেলার সাতটি মন্দির এলাকায় সভা করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হাতে বাঁশি ও লাঠি তুলে দেয় পুলিশ। গত সোমবার বিকেলে মাগুরা সদরের সাতদোহা ল্যাংটা বাবার আশ্রম ও শ্মশানে পুলিশ সভা করে লাঠি-বাঁশি তুলে দেয়। সভায় জেলার এসপি এ কে এম এহসান উল্লাহ, অতিরিক্ত এসপি মো. তারিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
সভায় এসপি বলেন, মনোবল বাড়ানোর জন্য মানুষের হাতে লাঠি ও বাঁশ তুলে দেওয়া হচ্ছে, মারামারি করার জন্য না। পুলিশ-জনগণ এক হয়ে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করবে।
রোববার শ্রীপুর উপজেলার গাংনালিয়া, সদরের গোপিনাথপুর, কৃঞ্চবিলা মন্দিরে, সোমবার শ্রীপুরের রামনগর, শালিখার তালখড়ি, গঙ্গারামপুর এবং ল্যাংটা বাবার শ্মশানে সভা করে পুলিশ।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. তারিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মূলত গুপ্তহত্যা, জঙ্গি হামলা, সন্ত্রাস দমন, উগ্রবাদের বিরুদ্ধে অরক্ষিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সচেতনতা বৃদ্ধি ও মনোবল বাড়াতে এ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মুহাঃ নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, এ রকম লাঠি-বাঁশি কর্মসূচি আগেও নেওয়া হয়েছিল নাটোরে। এসব ক্ষেত্রে মূল বিষয়টা হচ্ছে নিয়ন্ত্রণের। ঝুঁকি থাকে এদের কেউ সংঘটিত হয়ে অপরাধ না করে বসে। তাই এ রকম উদ্যোগকে সার্বক্ষণিক নজরদারির জন্য একজন দায়িত্ববান কর্মকর্তার ওপর ভার দিতে হবে। তবে পুলিশের বিদ্যমান আইনের সঙ্গে এটা সাংঘর্ষিক নয়। আইনে আছে, অন্যের কোনো ক্ষতি করা যাবে না। এ কর্মসূচি প্রয়োগের ভিত্তিতে বোঝা যাবে এর কোনো নেতিবাচক দিক আছে কি না।
মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল মনে করেন, এটা নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের সর্বোত্তম পন্থা না। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, নাগরিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর। মানুষকে যদি এভাবে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয় তাহলে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর কাজ কী? একজন মানুষ কি ২৪ ঘণ্টা লাঠি-বাঁশি নিয়ে ঘুরে বেড়াবে? যখন তিনি কাজে যাবেন, স্কুল-কলেজে যাবেন তখনো কি তিনি লাঠি-বাঁশি বহন করবেন? এ ছাড়া কারও হাতে লাঠি দিলেই তো হলো না। এটা ব্যবহারের জন্য তো একটা দক্ষতা লাগে। আবার কার সঙ্গে কার শত্রুতা রয়েছে, সে দিক থেকেও এগুলোর অপব্যবহারের ঝুঁকি রয়েছে। এগুলোর নিয়ন্ত্রণ কে করবে?
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এটাকে নিয়মিত কাজেরই একটা বর্ধিতাংশ বলা যায়। সাধারণত সন্ত্রাস বা অপরাধ বেড়ে গেলে পুলিশ বিভিন্ন রকম উদ্যোগ নেয়। সম্প্রতি ঘটে চলা গুপ্তহত্যার মতো অপরাধ মোকাবিলায় সমাজের লোকজনকে সম্পৃক্ত করতেই এ ধরনের উদ্যোগ।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ ধরনের উদ্যোগের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আছে কি না জানতে চাইলে ডিআইজি বলেন, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে কমিউনিটি পুলিশিং জোরদার করার নির্দেশনা রয়েছে। সেখান থেকেই এ ধরনের উদ্যোগের ভাবনা এসেছে।