সরেজমিন: চুয়াডাঙ্গা—১

ঢাকা-কলকাতা ১০০ কিমি দূরত্ব কমাবে দৌলতগঞ্জ স্থলবন্দর

.

ঢাকা থেকে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরের দূরত্ব ৩১৯ কিলোমিটার। কিন্তু ঢাকা থেকে চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের দৌলতগঞ্জ স্থলবন্দরের দূরত্ব ২২০ কিলোমিটার। আর এ দুই বন্দর থেকে ভারতের কলকাতার দূরত্ব যথাক্রমে ৮৮ ও ৮৪ কিলোমিটার।
এই হিসাব বলছে, দৌলতগঞ্জ স্থলবন্দর ব্যবহার করলে ঢাকা-কলকাতার দূরত্ব অন্তত ১০০ কিলোমিটার কমে যাবে। দৌলতগঞ্জের বিপরীতে ভারতের কৃষ্ণনগর জেলার মাজদিয়া।
ফলে দৌলতগঞ্জ-মাজদিয়া স্থলবন্দরের কার্যক্রম শুরু করতে প্রস্তুত হয়ে আছে বাংলাদেশ। কারণ, দূরত্ব কমা মানে পণ্যের ভাড়া কমে যাওয়া; শেষ বিচারে এসে দামও। পাশাপাশি বেনাপোল ও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের ওপর থেকে চাপও কিছুটা কমাতে পারবে এই বন্দর।
কিন্তু সমস্যা হলো, ভারতীয় অংশ মাজদিয়ায় বন্দরের অবকাঠামো ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়নি। সর্বশেষ তথ্য হলো, ওপারে রাস্তা তৈরির জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে মাত্র।
কৃষিনির্ভর চুয়াডাঙ্গা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে যুক্ত হতে অধীর অপেক্ষায় আছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই বন্দর চালু হলে শুধু চুয়াডাঙ্গা জেলার মানুষই উপকৃত হবে না, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সব জেলায় এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, জীবননগর উপজেলা সদর থেকে সীমান্ত¯ পর্যন্ত বাংলাদেশ অংশের রাস্তা তৈরি। বাংলাদেশ প্রান্তে শুধু সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে নো-ম্যানস ল্যান্ড পর্যন্ত ১৫০ মিটার কাঁচা। এর জন্যও প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পাওয়া গেছে। শিগগিরই কাজ শুরু হবে। বন্দরের জন্য নির্বাচিত জমিতে কাস্টম হাউস, টার্মিনাল, ইয়ার্ড, যাত্রীছাউনিসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোও প্রস্তুত।
বন্দরসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সরকারি দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে চুয়াডাঙ্গার দৌলতগঞ্জ ও ভারতের মাজদিয়া পয়েন্টে শুল্কবন্দর স্থাপন করা হয়। নাম দেওয়া হয় দৌলতগঞ্জ-মাজদিয়া চেকপোস্ট। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় এই বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ ও ১৯৯৪ সালে এই বন্দর দুবার চালু করা হলেও পরে কার্যক্রম থমকে যায়।
গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে এই স্থলবন্দর বাস্তবায়নের দাবিতে উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে বন্দর বাস্তবায়ন কমিটি। এর আহ্বায়ক জীবননগরের আবদুল হক।
চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সাংসদ আলী আজগার বলেন, এই বন্দর চালু হলে স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। আঞ্চলিক অর্থনীতিও চাঙা হবে।
তবে চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি ইয়াকুব হোসেন মালিক বলেন, বন্দরটি চালুর পর তা টিকিয়ে রাখতেও সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। দালালমুক্ত একটি আদর্শ বন্দর হিসেবে একে গড়ে তুলতে হবে।
২০০৯ সালের ১০ অক্টোবর নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান দৌলতগঞ্জ বন্দর এলাকা পরিদর্শন করেন। এরপর বন্দরের জন্য ৩ কোটি ২২ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। ওই প্রকল্পের আওতায় সে সময় সড়ক উন্নয়ন, কাস্টম হাউস, টার্মিনাল, চেকপোস্টসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। ২০১৩ সালের ৩১ জুলাই সরকার দৌলতগঞ্জ-মাজদিয়া বন্দরের প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই বছরের ২৪ আগস্ট বন্দরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।
২০১৪ সালের জুনে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ও ভারতের তৎকালীন হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল দৌলতগঞ্জ স্থলবন্দর এলাকা পরিদর্শন করে। পঙ্কজ শরণ দ্রুততম সময়ে বন্দর চালুর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের একাধিক প্রতিনিধিদল দৌলতগঞ্জ-মাজদিয়া বন্দর এলাকা পরিদর্শন করেছে। এ বিষয়ে গতকাল সোমবার ঢাকায় যোগযোগ করে ভারতের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, স্থলবন্দরটি চালুর ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে মধ্যে আলোচনা চলছে।
দৌলতগঞ্জ স্থলবন্দর ক্লিয়ারিং ও ফরোয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, দৌলতগঞ্জ-মাজদিয়া বন্দর চালু হলে বেনাপোল-পেট্রাপোলে পণ্যজট থাকবে না, দুর্ভোগ কমবে। একই সঙ্গে ঢাকা-কলকাতা পথে চলাচলকারী বাসযাত্রীরাও কম সময়ে স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারবে।
দৌলতগঞ্জ বন্দরের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান তপন কুমার চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ অংশে আমরা প্রস্তুত আছি। ভারতের অংশে তারা এখনো কাস্টমস চালু করতে পারেনি। অবকাঠামোও ঠিক হয়নি। এটা দ্রুত করার জন্য সম্প্রতি আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতকে অনুরোধ পত্র দিয়েছি। সরকারি পর্যায়ের বাইরে দুই দেশের ব্যবসায়ীরাও বন্দরটি দ্রুত চালুর জন্য সক্রিয় আছেন।’
দেশে ২৩টি শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি উন্নয়ন পর্যায়ে আছে। বাকিগুলোর মধ্যে পাঁচটি পরিচালনা করে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। তৈরি, পরিচালন ও হস্তান্তর পদ্ধতিতে আটটি পরিচালনা করেন বেসরকারি বন্দর অপারেটররা।
আগামীকাল পড়ুন: চিনি নয়, লাভ দেয় আখের উপজাত