শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন

তুলিতে সচ্ছলতার পরশ

যশোরের কেশবপুরের আলতাপোল গ্রামে নিজের কারখানায় তুলি তৈরিতে ব্যস্ত নজরুল ইসলাম (বাঁয়ে), তাঁর স্ত্রী জামেলা বিবি ও ছেলে আলম হোসেন l ছবি: এহসান-উদ-দৌলা
যশোরের কেশবপুরের আলতাপোল গ্রামে নিজের কারখানায় তুলি তৈরিতে ব্যস্ত নজরুল ইসলাম (বাঁয়ে), তাঁর স্ত্রী জামেলা বিবি ও ছেলে আলম হোসেন l ছবি: এহসান-উদ-দৌলা

ছোট্ট একটা কাঠি, মাথায় পিতল বা টিন দিয়ে মোড়ানো পশুর লোম। নাম তুলি। তাতেই রং মাখিয়ে শিল্পী তাঁর কল্পনাকে দৃশ্যমান করে তোলেন। আঁকা ছাড়া লেখার কাজেও ব্যবহৃত হয় তুলি। যশোরের কেশবপুরে এমন তুলি বানানোর অন্তত ৭০টি কারখানা আছে।
যশোরের কেশবপুর উপজেলার আলতাপোল গ্রাম। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে থাকা এই গ্রামের খুব সাধারণ একজন মানুষের হাত ধরে এখানে গড়ে উঠেছে তুলির কারখানা। তাঁর নাম নজরুল ইসলাম। ১৯৭৪ সালে বয়সে তরুণ নজরুল ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি জমান ভারতে। পশ্চিমবঙ্গের বঙ্গনগরের একটি তুলির কারখানায় কাজ খুঁজে নেন তিনি। চার বছর কাজ করেন সেখানে। তারপর দেশে ফেরা।
অভাব-অনটন পিছু ছাড়ে না। কাজ খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই চার বছরের অর্জিত জ্ঞানই কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন নজরুল। উপকরণ সব চেনা। জোগাড়যন্ত্র করে হাত দিলেন তুলি তৈরির কাজে। জেলা শহরে নিয়ে বিক্রি করা শুরু করেন। আস্তে আস্তে গেলেন পাশের জেলাগুলোতেও। এখন এই গ্রামের তুলি যাচ্ছে সারা দেশে।
নজরুলকে দেখে উৎসাহ পান গ্রামের বেকার যুবকেরা। তুলি তৈরি শেখেন তাঁর কাছে। এভাবে বাড়তে থাকে তুলির কারিগরও। নজরুল জানান, তাঁর কাছ থেকে যাঁরা কাজ শিখেছেন, তাঁরা নিজেরাই এখন কারখানা দিয়েছেন। উপজেলার তিনটি গ্রাম আলতাপোল, মঙ্গলকোট উত্তরপাড়া ও সফরাবাদে গড়ে উঠেছে ৭০টির মতো কারখানা।
নজরুল ইসলাম স্ত্রী জামেলা বিবি ও ছেলে আলম হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে নিজের কারখানাটি চালান। দিনে ৩০০ থেকে ৪০০টি তুলি তৈরি করেন তাঁরা। বিক্রি করে লাভ থাকে ৪০০ টাকার মতো।
আরেক কারখানার মালিক নুর ইসলাম বলেন, তিনি তাঁর কারখানায় তৈরি তুলি এক মাস পর পর বাইরের বাজারে পাঠান। বেশির ভাগই যায় উত্তরাঞ্চলে। মাঝেমধ্যে গ্রামে এসেও বাইরের ব্যবসায়ীরা তুলি কিনে নিয়ে যান।
এখানকার কারিগরদের তথ্য, তাঁদের তৈরি এই তুলি ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পঞ্চগড়, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয়।
এই তুলির কারখানা দিতে বেশি পুঁজি লাগে না। প্রয়োজন একটি এক হর্স পাওয়ার বৈদ্যুতিক মোটর। কাঁচামাল হিসেবে কাঠ, টিন, পিতল, বাজারে পাওয়া পশুর লোম আর রং। মোটরের সাহায্যে কাঠ দিয়ে বানানো হয় তুলির বাঁট। পরে বাঁটে রং করা হয়। এই বাঁটে কাঠ বা পিতল ঢুকিয়ে সঙ্গে পশুর লোম লাগিয়ে হয় তুলি।
ফারুক নামে এক কারখানামালিক জানান, এখানকার কারখানায় তৈরি তুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সেভিলিয়ার, সাথী, কুমার, অভিনাশ, সাথী সুপার, জামান সুপার, দয়াল মিন সুপার, সোনাই। সেভিলিয়ার ও সাথী ব্র্যান্ডের তুলিই বিক্রি হয় বেশি।
তিনটি গ্রামের এই কারখানাগুলোতে কাজ করেন ৩০০-এর মতো কারিগর। এদের অধিকাংশই নারী। হাফিজুর রহমান নামের এক কারখানামালিক বলেন, ‘প্রথমে নজরুল ভাইয়ের কাছ থেকে কাজ শিখি। পরে নিজেই কারখানা দিই। এ কাজে শ্রম দেন স্ত্রী। তারপর যখন তুলির চাহিদা বাড়তে থাকে তখন বাড়তি কারিগরের প্রয়োজন হয়। এখন কারখানায় চারজন কারিগর খাটেন।’
মঙ্গলকোট গ্রামের মনিরুজ্জামান নয় বছর ধরে নিজের কারখানা চালান। তিনি বলেন, ‘আগে আমার দিন চলত না। এখন অভাব নেই। কারখানার আয়ে বাড়ি করেছি। ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখাচ্ছি। আমার মতোই আরও অনেকেই আজ স্বাবলম্বী তুলি বানিয়ে।’
কারিগর মরিয়ম জানান, তিনি অনেক বছর ধরে তুলি তৈরির কাজ করছেন। এখন একবেলা কাজ করে ১০০ টাকা পান। এর আগে মাঠের কাজ করতেন। পেতেন মাত্র ১৫-২০ টাকা।
আরেক কারিগর নাছিমা বলেন, ‘স্বামী ছেড়ে দিলে বাড়ি এসে ভাইদের সংসারে থাকতাম। লজ্জা লাগত। এখন আমি নিজে আয় করি। আমার মতো গ্রামের অসহায় নারীরা এখন কেউ বেকার নেই।’
তুলি কারখানার মালিকদের চোখে এ শিল্পের বড় সমস্যা হচ্ছে পুঁজির। খুব বেশি পুঁজির দরকার না হলেও প্রান্তিক বা ছোট ব্যবসায়ীরা এ কাজ করতে পারছেন না। উপজেলায় তুলির কাজের উদ্যোক্তা নজরুল ইসলাম জানান, যথেষ্ট পুঁজি খাটিয়ে কাজটিকে আরও বড় করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু কোনো জায়গা থেকে টাকা পাননি। সরকারি ব্যাংকেও ধরনা দিয়েছেন। সেখান থেকেও ঋণ পাননি।
আরেক বড় সমস্যা বিদ্যুৎ-বিভ্রাট। মোটর চালাতে গিয়ে কারিগরেরা অনেক সময়ই দেখেন বিদ্যুৎ নেই।
এই সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু সায়েদ মো. মনজুর আলম বলেন, ‘যে বাস্তবতায় সরকারের পক্ষে সবার জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে নিজেদের উদ্যোগে তুলি কারখানা গড়ে তোলা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। আমরা এখন থেকে একে সার্বিক সহায়তা দেব। উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে কীভাবে ঋণ দেওয়া যায়, সে উদ্যোগও নেব।’