
একটা প্রেমের গল্প লিখতে হবে। লেখক ভাবছে। বহুদিন পর ঢাকার বাইরে এসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়। তবু সে আকর্ষণ ছাপিয়ে, প্রায়ই মন চলে যাচ্ছে এদিক-সেদিক। অনেক দিনের সম্পর্ক, তাই সবার মাঝখান থেকে উধাও হয়ে যাওয়া অদেখা থাকে না। কারও চোখে আগে পড়ে, কারও কারও চোখে পরে। আগে-পরে যা-ই হোক ঠাট্টা, আপত্তি-বিরক্তি প্রকাশ করে যে যার মতো। সবচেয়ে বেয়াড়া নিউইয়র্ক থেকে আসা মুন্না। একটু আগে সে তার তর্জনীটা বাড়িয়ে আরশীর নাকের ডগায় নাচিয়েছে, ‘লেখক, ফেরেববাজি কইরো না, আমাদের সঙ্গে বইসা হে হে করবা আর মনে মনে গল্প খুঁইজা বেড়াইবা—এমুন দুই নম্বরি বাদ দাও।’
ভালো খুচরো খোঁচা দিতে জানে শফিকুল। মুন্নার কথা শেষ হওয়ামাত্র মাথায় পরা রোদটুপির বারান্দাটা পেছনে ঘুরিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘দুই নম্বরি বাদ দিয়ে এ দেশে এক নম্বরি হওয়ার সুযোগ নেই কিন্তু।’
খোঁচা এড়িয়ে দুঃখ প্রকাশ করে আরশী। বলে, প্রায় এগারো বছর পর এ রকম একটা আড্ডার আয়োজনে বসে মাঝে মাঝে গল্পের খোঁজে বেরিয়ে পড়া তার উচিত হচ্ছে না। জেনেবুঝে তা বাদ দিতেও পারছে না। সন্ধান আজ রাতের মধ্যে তাকে পেতেই হবে। কাল লেখা দিয়ে দেওয়ার কথা, পরশু যেতে হবে যশোরে একটা সাহিত্য সম্মেলনে।
বন্ধুদের মধ্যে নোমান কথা একটু কম বলে এবং সে অন্যদের তুলনায় ধীরস্থির। যে কারণে সব বিষয়ে তার বোঝাপড়া বেশ আস্থা রাখার মতো। ঠান্ডা গোছের মানুষ, হুটহাট করে কিছু করে না, বলেও না। কারও কোনো সমস্যা হলে সে বিষয়ে আলোচনা করতে সবাই খুঁজে বেড়ায় নোমানকে।
আড্ডা পালানো ধরা পড়েছে আর প্রতিক্রিয়া তেতো হওয়ার দিকে গড়াচ্ছে দেখে নোমান ভাব পাল্টাতে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে, ‘আরশী এখানে থেকেও থাকছে না। তা ইচ্ছা করে নয়, সেটা নিশ্চয়ই সবাই আমরা বুঝতে পারছি।’
তারপর কী বলতে চেয়েছিল তা আর জানা হয় না। নোমানকে থামতে হলো। বসা থেকে লাফিয়ে উঠেছে মুন্না, হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া তার দীর্ঘকালের স্বভাব, ‘এগারো বছর পর দেশে আসছি। যেদিন টিকিট কাটছি সেইদিন থেইক্যা ভাবতে শুরু করছি দ্যাশে গিয়াই আমরা পাঁচজন একসঙ্গে হমু। বউবাচ্চা সবাইরে নিয়া যামু কক্সবাজার। হইল না সেটা। এর এই কাজ, তার সেই কাজ, পোলা-মাইয়াগো স্কুল চলতাছে, বউগো পক্ষে যাওয়া সম্ভব হইল না। আইলাম সারা দিনের জন্য এই রিসোর্টে। চুটাইয়া আড্ডা মারুম, তার মাঝখানে তুমি, তুমি লেখক বইলা আমাগো ঠকাইয়া গল্প খুঁজবা এইটা বেইমানি।’
‘আমরা ইমান-বেইমানের তাফাৎ রাখছি নাকি?’ খোঁচা মারার সুযোগ ছাড়ে না শফিকুল।
আরশী ব্যাখ্যা দিতে চায়, ‘মানুষ সব পারে, আবার কখনো কখনো তার পক্ষে অনেক কিছু অসম্ভবও।’
‘রাখো তোমার লেখকগিরি। এইখানে সবাই আড্ডার জন্য আসছি, কোনো রকম আঁতলামো চলব না।’
মুন্নাকে সবাই জানে, জানে সে যেটা বলতে চায় সেটা বলবে, শোনা তার ধাতে নেই। তবু আবার চেষ্টা করে নোমান, ‘আরশীর বিষয়টা ধরলে চলবে না। এখানে থাকার চেষ্টা করলেও লেখকের মন বেঁধে রাখা মুশকিল। কথার ফাঁকে এদিক-সেদিক যাওয়া সে থামাতে পারবে না। আজ নতুন দেখছি না, বহুদিন ধরে সেটা আমরা জানি।’
নোমানের মুখের এদিক-সেদিক যাওয়া নিয়ে ফোড়ন কাটে খোঁচাবিশেষজ্ঞ শফিকুল, ‘আমরা গেলেই যত দোষ। দোষ পায় বউ, বন্ধুরা। লেখক হও, লেখকের জন্য সাত খুন মাফ।’
তাপস বসা শফিকুলের পাশেই। হাসে, ‘নাড়, তোমার যাওয়া আর লেখকের এদিক-ওদিক যাওয়া এক নয় বন্ধু।’
সবাই হো হো করে হেসে ওঠে সে কথায়।
তাকে যে নাড় বলে ডাকা হতো, অনেক দিন পর আবার শোনা গেল নামটা।
শফিকুল তেতে উঠেছে, ‘যত দোষ শালা নন্দ ঘোষের। তোমাদের যাওয়া-যাওয়ির গল্প নিয়ে কেউ টুঁ-শব্দ করে না, আমি করলেই দোষের।’
তাপস সেই উষ্মার মাঝখানে একটা প্রবাদ মনে করিয়ে দেয়, ‘চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড় ধরা।’
শফিকুল সে কথা মানে না। তার কথা হলো, ‘চুরি চুরিই। চুরি করে চোর। ধরা পড়লেও চোর, না পড়লেও চোর।’
নোমান দেখে প্যাকেটের সিগারেট শেষ। মনে অন্য ভাবনা। মুখে মিটিমিটি হাসি। শফিকুল বা নাড় যেন বুঝতে পারে নোমানের মনে কী চলছে, ‘দ্যাখ, দ্যাখ, আমাদের বক শালা হাসে। ক্যান হাসে? কখনো ধরা খায় নাই তাই। দেদারসে প্রেম করেছে, কেউ জানে না। আমারটা লুকাইতে পারি নাই, তাই সকল সাধুর মধ্যে আমি ব্যাটাই চোর।’
নোমানের মুখের সেই হাসিটা বেড়ে যায়।
‘হাসিস না নোমান, রহস্য রাখ। মনে কী আছে সাহস থাকলে বল।’
‘লুকানোর কিছু নাই। শোন নাড়, এদিক-সেদিক যাওয়া-যাওয়ি করেছি বিয়ের আগে।’
‘বিয়ের পরে আমাদের কার কী গল্প আছে, সাহস থাকলে কে বলবে বলুক শুনি।’
নাড়-এর এই চ্যালেঞ্জ বেশ উৎসাহের। উল্লসিত হয় মুন্না, ‘হ্যাঁ, বল দেখি, এগারো বছরে কারও কোনো গল্প জানি না। কার কি প্রেম-পিরিতির গল্প আছে ধারাবাহিকভাবে বলতে থাকলে এ আসর ভালোই জমব।’
‘নাই নাই কারও কোনো গল্প নাই, সবাই গোপনে চালিয়ে যাচ্ছে সব। ইজ্জত সবারটা আছে মজবুত। আমিই কেবল ধরা খাইয়া হারাইছি সব।’ শফিকুলের কথায় আপত্তি তাপসের, ‘যা মিথ্যা তা জোর করে সবার কাঁধে চাপানো ঠিক না।’
আরশী ভাবে, আপাতত চুপ করে থাকাই মঙ্গল। মুন্না আচমকা তার দিকেই প্রশ্ন ছোড়ে, ‘লেখক, চুপ ক্যান। এক বউতে তোর চলে নাকি? শুনি লেখক-শিল্পীদের মাঝে মাঝে অনুপ্রেরণা দরকার হয়।’
‘সাহস থাকলে বলুক লেখক। শালা, লেখার মধ্যে তো মহত্ত্বের বাবারে হাজির করো। পাঠক কাইত হইয়া যায়। মানুষ তো তুমি সাধারণই। সুন্দর মেয়ে তোমার ভক্ত নাই? তারা ফোন করলে গলা ভারী করে কথা বলো না? আমাদের সঙ্গে যেমন ভাষা, মেয়েদের সঙ্গে কি একই রকম? কারও টেলিফোন নাম্বার চাওনি কোনো দিন?’
‘না চাইনি।’ শফিকুলকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় আরশী। ঢংটা অনেকটা প্রতিবাদের মতো। নিজেকে দেখতে না পেলেও বুঝতে পারে চেহারাটা একটু বদলেছে। নোমান দুহাত তুলে শান্তি শান্তি উচ্চারণ করে।
থামে সবাই। হাত নামিয়ে তাপসের দিকে বাড়ায়, ‘লালু, তুই একটা সিগারেট দে। ও তো আমাকে দিতে রাজি হবে না এখন।’ ও মানে শফিকুল। দেখতে পায় শফিকুল আবার টুপির বারান্দা পেছন থেকে সামনে এনেছে। তার মানে রাগ বেড়েছে বোঝা গেল। সিগারেট বের করতে যায় তাপস। থামায় মুন্না, ‘দয়া কইরা কেউ আসরটারে গান্ধা কইরো না, এখন এখানে সিগারেট না প্লিজ...।’
হাত গুটিয়ে নেয় নোমান, ‘ঠিক আছে দরকার নেই সিগারেট, কিন্তু একটা অনুরোধ, কার কি উপরি প্রেম-ট্রেম—এইসব নিয়ে আলোচনা চলবে না। বুড়ো হওয়া মানুষেরাই সুযোগ পেলে পেছনকে সামনে টেনে আনে। এক শহরে থাকি, এমন করে একসঙ্গে হওয়া বহুদিন হয়নি। মুন্না নিউইয়র্ক থেকে দশ দিনের জন্য এসে সবাইকে একসঙ্গে করেছে, এটা সম্পূর্ণ ওর কৃতিত্ব। দিনটা ভালোভাবেই উদ্যাপন করা উচিত। একসঙ্গে হয়ে সবচেয়ে ভালো লাগছে, নিজেদের ছেলেমানুষি কাণ্ডকারখানা। আমাদের বয়স বাড়লেও সবার মধ্যে আগের সময়ের সবই টিকে রয়েছে। আমরা আগের মতো ভাষা ব্যবহার করছি, ঝগড়াঝাঁটি, তর্ক-বিতর্ক—সবই পুরোনো দিনের মতো। এসব নিশ্চয় আমাদের সম্পর্কের অসাধারণত্ব।’ এ পর্যন্ত বলে আরশীর দিকে তাকায় নোমান। সায় চায়, ‘ঠিক বলেছি, বুলু!’
কিছু একটা ঘটে গেল মনের মধ্যে। বুলু নামটা বিরক্তিকর ছিল, আজ এত দিন পর মনে হলো, ভালোই তো। আরশী মাথা দোলায়। মুখে ফুটে ওঠে হাসি। মানে কিছু বলবে সে। তার কথা বলার ধরন এমন, গলায় জোর থাকে কম। সবাইকে একটু বেশি মনোযোগী হয়ে শুনতে হয়।
‘এমন আড্ডাই হওয়া উচিত। এখন যেখানে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি, মনে হচ্ছে পেয়ে গেছি একটা জাদুর বাক্স। তার থেকে বের হয়ে চলছে সাদা কবুতর, রঙিন রুমাল, নীলপদ্ম...। এখন এখান থেকে আমি কিন্তু গল্পের সন্ধানে এদিক-সেদিক যেতে পারব না। আমাদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সম্পর্ককে আটত্রিশ বছর পর ফিরে পেয়েছি। সবাই ভুলে গিয়েছিলাম আমাদের আলাদা আলাদা নাম ছিল। সে নামগুলো বাবা-মায়ের রাখা নয়। আমরাই রেখেছিলাম আমাদের নাম।’
শফিকুল হেসে ফেলে, ‘আমি নাড় খেয়েছিলাম এক বসায় উনিশটা, ব্যস, নাম হয়ে গেল নাড়। হা হা হা।’
সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠে। সেই হাসি আয়োজন করা যন্ত্রসংগীতের মতো শোনায়। উত্তেজনায় পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে শফিকুল, ‘এ্যাই, এবার একটু সিগারেট পান না করলে চলেই না।’ মুন্না হালুম করে পড়ে, ‘না।’
নোমান বিস্মিত হয়ে বলে, ‘যে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধোঁয়াখোর সে বারবার বাধা দিচ্ছে, রহস্যটা কী?’
তাপস জনতে চায়, ‘বাদ দিয়েছিস নাকি রে?’
‘হে হে হে বউ বোধ হয় সম্পাদনা করে দিয়েছে।’ খোঁচা দান করার সুযোগ নষ্ট করে না শফিকুল। শুনে বেশ রেগে গেল মুন্না, ‘বউরে ক্যান দোষ দিস। দোষ ছাড়ান দিতে পারলে সেইটা মাইনষের কৃতিত্ব। পারলে আমারে তালি দে তোরা।’
‘ভূতের মুখে শুনি রাম নাম। সিগারেটের জন্যে হালুম হুলুম করতি, এখন হয়ে গেছিস ভদ্দরনোক।’
‘পেয়ে গেছি!’ স্বভাববিরুদ্ধভাবে চিৎকার করে ওঠে আরশী।
সবাই অবাক। আর কেউ না, চেঁচিয়ে উঠেছে আরশী। কী কারণ?
‘মুন্নার নামটা মনে করতে পারছিলাম না, শফিকুল হালুম বলাতে মনে হয়ে গেল, মুন্না ছিল হালুম।’
মুন্না বা হালুমের চেহারায় জেগে ওঠে কপট বিরক্তি, ‘ছাড়ো পুরোনো দিনের কিসসা। পুরোনো নাম-টামের দরকার নেই।’
তাপসের মনে পড়ে, একটা লাল চেক শার্ট ছিল। আরশীকে মনে করিয়ে দেয়, ‘তোর ভাই বিদেশ থেকে একটা নীল শার্ট পাঠিয়েছিল, মনে আছে আরশী?’
‘মনে থাকবে না। ওই দুই শার্ট পরে তুই-আমি একসঙ্গে ডিপার্টমেন্টের পিকনিকে গিয়েছিলাম। আমাদের নাম হয়ে গেল লালু-বুলু।’
হো হো করে হেসে ওঠে সবাই। নোমান হাসতে হাসতে হঠাৎ থামে। কপালের মাঝখানে ভাঁজ পড়ে। কয়েক সেকেন্ড চোখ বুজে মনে করার চেষ্টা করে, তার নাম বক কে রেখেছিল। কে কে? কারও কথাই মনে পড়ে না। অস্বস্তি তাড়াতে আসরে পেড়ে ফেলে কথাটা, ‘আমার নামটা কে রেখেছিল যেন, মনে পড়ছে না।’ বলামাত্র শফিকুল চেঁচিয়ে বলে, ‘আমার বউ।’ সমস্বরে সমর্থন পাওয়া যায়, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ।’
আরশীর মনে পড়ে যায়, অনেক বছর আগে সবাই একসঙ্গে যেমন থাকা হতো, কোন জাদুবলে তা ঠিকঠাক ফেরত এসেছে। লালু-বুলু-হালুম—সবাই হারিয়ে গিয়েছিল। নাড়-বক সবাইকে ফেরত পাওয়া গেছে আজ। শফিকুলের বিয়ে হওয়ার পর প্রায়ই আড্ডা বসত ওদের মনিপুরিপাড়ার বাসায়। তাস খেলার আসরে নোমানের বসার ভঙ্গিটার সঙ্গে বকের মিল খুঁজে পেয়েছিল শফিকুলের বউ লোপা। সবাই সেই নাম শুনে হুড়মুড়িয়ে তালি বাজিয়েছিল সেদিন। আজও সেদিনের মতো হল্লা, তালি, হা হা হি হি হলো। খানিকক্ষণ হইচই হুলুস্থুলের পর তলিয়ে যাওয়া একটা সময় আসে। উড়ে এসে জুড়ে বসে নৈঃশব্দ্য। কান পাতলে সবার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ তখন পাওয়া যায়। মনে হয়, মন খারাপের হাওয়া সবার ওপর দিয়ে যাবে, তাই অপেক্ষায় আছে। নৈঃশব্দ্য ভাঙে।
‘আমাদের বয়স বেড়েছে।’ একটু বিষণ্নবোধ করে নোমান। আরশী একমত হয় না, ‘বয়স বাড়ুক, আমরা কেউ বুড়িয়ে যাইনি।’ নোমানের চোখের অসহায়ত্ব কাটে না সেই জোর যুক্তিতে। মন খারাপ করা গলায় বলে, ‘কে এই নামটা রেখেছিল, ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ভুলে গিয়েছিলাম।’
‘অমন হয়, হতেই পারে।’
আরশী মোবাইল ফোনটা উঁচু করে ধরে, ‘নিজের নাম্বারটাও মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলেছি, মনে হয় না?’
সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ানো সায় মিলে যায় সবার থেকে।
‘ফোন, যেটা সর্বক্ষণের সঙ্গী, সেটা হাতে নিয়ে সারা ঘরে ফোন খুঁজে বেড়াই, হয় না এমন?’
হয়, হয়—বলে সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠে। হা হা হা-এর মাঝখান থেকে কী মনে করে যেন হো হো হো হাসিতে ফেটে পড়ে হালুম। আচমকা সেই কাণ্ডে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, কী হয়েছে, হলো কী রে?
হাসছে হালুম। সবার মনে অস্থিরতা, ‘আরে কী হয়েছে বলবি তো।’ কোনো রকমে আচমকা হাসি খানিকটা সামাল দিতে পারে মুন্না, ‘নাড়ের বিয়ের পর ওর বউকে লোফা ডাকছিলাম মনে আছে? লোফা শুধরাইয়া দিছিল, আমার নাম লোফা না, লোফা।’
মুন্নার ঘাড় চেপে ধরে শফিকুল, ‘তুই এখনো লোফাই বলছিস হালুম। কোনো উন্নতি ঘটে নাই তোর। এত বছর আমেরিকায় থাকলি, সুপার পাওয়ারকে তো সুপার পাওয়ারই বলিস। পা বলতে পারিস, পাখি বলতে পারিস। পকেট, পাজামা, পাগল—সব বলতে পারিস, শুধু লোপার বেলায় লোফা ক্যান রে?’
পুরোনো দিনের দারুণ মজার একটা ঘটনা নতুন দিনে দারুণ মজা নিয়েই হাজির হয়। তাপস ভাবে, আরশীর কথাই ঠিক, বয়স বাড়লেও কেউই বুড়িয়ে যায়নি। কেউ বদলায়ওনি বিশেষ। মনে হয়েছিল মুন্না বদলেছে কিন্তু লোপা প্রসঙ্গ এনে প্রমাণ করে দিল, যেমন ছিল আছে তেমনই। হাসাহাসি চলছে।
কাঁচুমাচু হয়ে তাকিয়ে হালুম বা মুন্না। মুখে একটা শিশুসুলভ হাসি। নোমানের কৌতূহল, ‘তুই কি সত্যি সত্যি লোপা উচ্চারণ করতে পারিস না। এ কী করে সম্ভব! যে সব “প” উচ্চারণ করতে পারে শুধু লোপার বেলায়...’ মাথা নেড়ে কথা শেষ করতে দেয় না হালুম। সবার মনোযোগ পুরোপুরি তার দিকে।
‘একটা কথা শুনলে তোরা আকাশ থেকে পড়বি। লজ্জার কথা, তবু আজ বলতে ইচ্ছে করছে।’
সবার হাসি থেমে যায়। কী কথা বলবে মুন্না। নিশ্চয়ই তা কোনো হাসির কথা হবে না। মুন্না বলবে। সবাই তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে। তার অভিব্যক্তি চেনা মুন্নার মতো মনে হয় না।
‘আমার বউয়ের নাম কিন্তু নীরা নয়।’
চমকে ওঠার মতো কথা। কী বলছে মুন্না! নিশ্চয়ই মিথ্যা নয়। ঠাট্টাও হতে পারে না। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একজনও বলার কিছু খুঁজে পায় না। কেউ একজন জানতে চায়, ‘নীরা, নীরা নয়?’
উত্তর আসে না। সবাই আশা করে থাকে উত্তর আসবে। আরশী ভাবে, একটা গল্প পেতে চলেছে। নিজের মধ্যে একটা শিহরণ টের পায়। উত্তেজনা, অস্থিরতা সেই শিহরণকে বেঁধে ফেলতে চায়।
‘তার মানে কি নাম তার নীপা?’ প্রশ্ন করে আরশী।
‘হ্যাঁ, নীপা হবে নিশ্চয়।’ মাথা দুলিয়ে সায় দেয় হালুম। খোঁচাপ্রিয় শফিকুল সেই নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া বারান্দায় বিস্ময়ের রং ছড়িয়ে দেয়, ‘তুই তো মহা লাকি রে হালুম। বউয়ের নাম উচ্চারণ করতে পারিস না বলে নীপা হয়ে গেছে নীরা। চৌদ্দ বছর এইভাবে সংসার করে যাচ্ছিস?’
এত বছর পর সবাই এমন একটা তথ্য পেয়ে না তামাশা না অবাক, কেমন এক ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছে। বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যে এমন রহস্যের হঠাৎ উন্মোচন সবাইকে দিকহারা করে দেয়। ভাষাহারাও হতে হয় সবাইকে। হালুমের জন্য মায়া হয়, করুণা জাগে নাকি একই রকম অনুভূতি মনে মনে ঘুরপাক খায় নীরা বা নীপার জন্য?
‘তুই শালা সত্যিই একটা হালুম রে।’ হঠাৎ খেপে ওঠে নাড় বা শফিকুল, ‘কী সুন্দর একটা মেয়ে নীরা, বিয়ে করে তার নামটা খেয়ে ফেলেছিস। নাম উচ্চারণ করতে পারিস না যার, সে মানুষটা হেসেখেলে তোর সংসার করে যাচ্ছে।’
লেখক অনুভব করে, দিনটা সত্যি অসাধারণ। দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পায়, আশা করা একটা প্রেমের গল্প লতিয়ে লতিয়ে উঠছে। তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে হালুম বা মুন্না। যেন সে বুঝতে পারে লেখক বন্ধুর মনে কী খেলা শুরু হয়েছে। লেখক, আরশীর মনে তখন একটা প্রশ্নের দৌড়ঝাঁপ, নামটা উচ্চারণ করতে পারেনি দেখে কেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তার স্ত্রীর। সৌভাগ্যবশত ঠিক সেই প্রশ্নটাই করে বসে নাড়।
আশ্চর্য, যেন সেই উত্তরটা দেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে ছিল হালুম। তার ভাব বদলে গেছে। বলার আগে শরীর ভঙ্গিমা বলে দেয়, এ যেনতেন ঘটনা নয়। সগৌরব জানান দেয়, ‘প্রেম—বুঝতে পারছ প্রেম।’
হালুম সবাইকে প্রেম বোঝায়। সবাই বোকাসোকা ছাত্র বনে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, ‘সে রাগ করে নাই। বলছিল, খুশি হয়েছি। সবাই যে নামে ডাকে তুমি সে নামে ডাকবা না। তুমি ডাকবা তোমার পছন্দের নামে।’
ছাত্রদের সব মুখ হাঁ করা। মাছি উড়লে মাছি ঢুকে পড়তে পারত তিন-চারটে মুখের মধ্যে। লেখকের মনে হলো সে প্রেমের গল্প পেয়ে যাচ্ছে।
‘নীরার মনে শুধু একটা দুঃখ...’
মুন্নার উচ্চারণে বারান্দায় মানুষগুলো নড়েচড়ে বসে। কথা নেই, নড়াচড়ার শব্দ বলে দেয়, সব মনোযোগ এখন নীরার দুঃখের দিকে। সবার প্রবল আগ্রহ, অস্থির অপেক্ষা কী সেই দুঃখ? কেউ জানে না। লেখকের গল্প লতিয়ে উঠছে। লেখক আরশীকে বলে ধীরস্থির থাক বুলু। ধৈর্য কম নাড় ওরফে শফিকুলের। সে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো করে জানতে চায়, ‘বল মুন্না, কী তার দুঃখ?’ মুন্না হাসে।
‘হাসিস ক্যান রে হালুম?’
হাত জোড় করে মুন্না, ‘তোরা এই নাম থেকে আমারে রেহাই দে। নামটা তার মোটেও পছন্দ না। রাগ করে বলেছিল, বন্ধুরা তোমাকে কেন ও নামে ডাকবে। মানা করো। বলো অন্য আর একটা নাম দিতে। তোরা বন্ধু, বন্ধুত্বের সম্মানটা রাখিস প্লিজ।’
মুন্নার কথা শেষে আর কোনো কথা ওঠে না। মুখে মুখে শব্দহীন হাসি নিভে যেতে থাকে। দুটো কবুতর সে সময় হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে বারান্দায়। এসে বসেই শুরু করে দেয় বাকবাকুম।
লেখক প্রেমের গল্প পেয়ে যায়।