বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিল

নূরুল আমীনের মধ্যরাতের পদত্যাগ

মার্কিন জাতীয় মহাফেজখানা থেকে প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে বায়ান্নর মার্কিন দলিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা এসব গোপন দলিলের ভিত্তিতে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ চতুর্থ কিস্তি

বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিল
বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিল

৬২ বছর পরে নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেল যে একুশে ফেব্রুয়ারিতে গুলিবর্ষণের ঘটনায় মুসলিম লীগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন ছাত্র-জনতার উত্তাল দাবির মুখে পদত্যাগ করতে চূড়ান্তভাবে মনস্থির করেছিলেন। দিনটি ছিল শুক্রবার। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। নূরুল আমীন পদত্যাগপত্র লিখেছিলেন। তিনি ওই দিন গভীর রাতে পদত্যাগ ঘোষণা করার পরিকল্পনা করেছিলেন।
১৯৫২ সালের ১ মার্চ ঢাকা থেকে মার্কিন কনসাল জন ডব্লিউ বাউলিং ওয়াশিংটনে পাঠানো এক বার্তায় ওই তথ্য উল্লেখ করেছিলেন। ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ ঢাকার দাঙ্গা শিরোনামে পাঠানো ওই গোপন বার্তায় বাউলিং আরও জানিয়েছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মুখ্য সচিব আজিজ আহমেদের নেতৃত্বাধীন একদল সরকারি কর্মকর্তা তাঁকে ওই রাতে পদত্যাগ করা থেকে নিবৃত্ত করেছিলেন।’ উল্লেখ্য, পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মুখ্য সচিব আজিজ আহমেদ ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট একজন প্রভাবশালী আমলা। পরে তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব হয়েছিলেন।

ভাষা গবেষক আহমদ রফিক গতকাল নিশ্চিত করেন যে ওই সময় ছাত্ররা ‘নূরুল আমীনের কল্লা চাই’ স্লোগানে ফেটে পড়েছিল। তাঁর সরকারের পতন ঘটারও জোর গুজব ছিল। তাঁর পদত্যাগ চেয়ে দৈনিক আজাদ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল। কিন্তু তিনি যে সত্যিই পদত্যাগপত্র তৈরি করেছিলেন এ কথা এই প্রথম উদ্ঘাটিত হলো।
মার্কিন কনসাল জন বাউলিং তাঁর ওই তারবার্তায় ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহের ঢাকার পুরো পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন। এতে নূরুল আমীন সরকারের প্রতি তাঁর প্রচ্ছন্ন সমর্থন প্রকাশ পায়। এর অন্যতম কারণ হলো, নূরুল আমীন সরকারের পতন ঘটলে পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্টদের শক্তি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।
বাউলিং তাঁর প্রতিবেদনটির শুরুতেই মন্তব্য করেন, ‘পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে ঢাকার দাঙ্গা থেকে উদ্ভূত সবচেয়ে তীব্র রাজনৈতিক সংকটের প্রাথমিক পর্যায় পূর্ব বাংলার সরকার সাহসিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে অন্তত আজ পর্যন্ত মোকাবিলা করতে পেরেছে। এশিয়ার এ অংশে কমিউনিজম ঘাঁটি গেড়েছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে এর বেশির ভাগ শীর্ষ নেতা আসন গাড়তে পারেননি। অন্তত অস্থায়ীভাবে হলেও তাঁদের উদ্দেশ্য পূরণের চেষ্টা ঠেকানো গেছে। তাঁদের তাড়া করা সম্ভব হয়েছে।’
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অন্তত সাময়িকভাবে দাঙ্গা বন্ধ হয়েছে। প্রদেশটি তার স্বাভাবিক অর্থনৈতিক জীবনে ফিরেছে। ঢাকার শীর্ষস্থানীয় কমিউনিস্ট এবং কমিউনিস্টপন্থী নেতাদের কারাগারে রাখা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, যেটি বিশৃঙ্খলার মূল কেন্দ্র সেটা বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু মুসলিম লীগের মন্ত্রিসভা বেশির ভাগ শহুরে জনগণের বৈরিতার সম্মুখীন। তারা যদিও ক্ষমতা সংহত করতে পেরেছে। কিন্তু এখন তাদের আইনসভার আগামী অধিবেশন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বাত্মক লড়াই চালাতে হবে।’
নূরুল আমীনের পদত্যাগ প্রসঙ্গে তিনি জানান, মুখ্যমন্ত্রী পদে নূরুল আমীনের বহাল থাকা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁর মন্ত্রিসভার অন্তত দুজন সদস্য এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অ্যাসেম্বলিতে নূরুল আমীনের প্রতি সমর্থন দ্রুত কমে যাচ্ছে। ভাষার প্রশ্নে নূরুল আমীন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি অত্যন্ত তিক্ত ছিলেন। কারণ, ভাষা প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে একটি ‘পাঞ্চিং ব্যাগ’ (মুষ্টাঘাত করার থলে) হিসেবে ব্যবহার করছিল। কেন্দ্রের সাধারণ রাজনৈতিক যোগ্যতা সম্পর্কে তিনি তাঁর আস্থা হারিয়েছিলেন। তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুখ্য সচিবের নেতৃত্বাধীন সরকারি কর্মকর্তাদের একটি গ্রুপের পীড়াপীড়িতে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। ওই গ্রুপটি তাঁকে অবহিত করেন যে ফজলুল হকের ভীমরতি ঘটেছে। এবং ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী হলে তাঁর মন্ত্রিসভায় কমিউনিস্টদের প্রতি অনুরাগী এবং যুক্ত বাংলার সমর্থকদের প্রাধান্য ঘটবে। নূরুল আমীন সরকারের পতন ঘটার অর্থ হবে পূর্ব পাকিস্তান অধ্যায়ের অবসান পর্বের সূচনা। ওই সব কর্মকর্তা তাই শপথ নিয়েছিলেন যে, যদি মন্ত্রিসভার পতন ঘটে তাহলে তাঁরাও সবাই পদত্যাগ করবেন।