নড়াইলের ৪৮টি অবৈধ ইটভাটায় বছরে পুড়ছে ৪০ লাখ মণ কাঠ। জনবসতির কাছাকাছি ও ফসলি জমিতে গড়ে ওঠা এসব ইটভাটা পরিবেশের বারোটা বাজাচ্ছে। দুই উপজেলার এমন তিনটি ইটভাটা গত বুধবার রাতে ভেঙে দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্বাহী হাকিম ইসরাত জাহান। উপস্থিত ছিলেন অধিদপ্তরের যশোর অঞ্চলের উপপরিচালক মো. আতাউর রহমান, পরিদর্শক নিখিল চন্দ্র ঢালী, নড়াইলের সহকারী কমিশনার মীকি মারমা ও ফাতিমা সুলতানা।
পরিবেশ অধিদপ্তর দুপুরে নড়াইল সদর উপজেলার দত্তপাড়া এলাকার এস এস ব্রিকসে অভিযান চালায়। এ সময় মাটি কাটার যন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে এ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। বিকেলে অভিযান চালায় উপজেলার নাওরা এলাকার পিহাম ব্রিকসে। এ সময় ভাটাটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি এর মালিককে ৮০ হাজার জরিমানা করা হয়। সন্ধ্যায় কালিয়া উপজেলায় গিয়ে এম বি ব্রিকস ভেঙে দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। এ ভাটার মালিককে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ তিনটি ভাটাতেই ব্যারেল চিমনি ব্যবহার করা হচ্ছিল।
পরিবেশ অধিদপ্তরের যশোর অঞ্চলের উপপরিচালক আতাউর রহমান বলেন, ‘ভাটা ভাঙার পর আবার উঠে যায়। আমাদের লোকবলও কম, তাই সামলাতে সমস্যা হয়। তবে এখন থেকে পর্যায়ক্রমে অভিযান চালানো হবে।’
ভাটা মালিক-কর্মচারী ও পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, নড়াইলের তিন উপজেলায় মোট ৮৩টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে অনুমোদন আছে মাত্র ৩৫টির। অনুমোদনহীন ৪৮টি ইটভাটা ড্রাম চিমনি ও ব্যারেল চিমনির। এসব ভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানো হয়।
ইটভাটার মালিকদের হিসাব অনুযায়ী, সাধারণত ছোট ইটভাটায় এক মৌসুমে (নভেম্বর থেকে এপ্রিল) ২৫ থেকে ৩০ লাখ ইট পোড়ানো হয়। আর বড় ভাটায় পোড়ানো হয় ৪৫ থেকে ৫০ লাখ ইট। ১ লাখ ইট পোড়াতে ২ হাজার মণ কাঠের প্রয়োজন। সে হিসাবে নড়াইলের অনুমোদনহীন ৪৮টি ইটভাটায় এক মৌসুমে প্রায় ৪০ লাখ মণ কাঠ পুড়ছে। এই কাঠ সংগ্রহ করতে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে গাছপালা, যা পরিবেশের জন্য হুমকি।
একজন ভাটামালিক বলেন, কাঠের তুলনায় কয়লার খরচ কম। তারপরও ভাটামালিকেরা কাঠ পোড়ান। কারণ, কাঠ সহজেই পাওয়া যায়। আবার অল্প পুঁজিতে মাঝে মাঝে কেনা যায়। কিন্তু একবারে অনেক টাকার কয়লা আনতে হয়।
সরেজমিনে গত সোম ও মঙ্গলবার লোহাগড়ার তিনটি ও নড়াইল সদরের তিনটি ইটভাটায় গিয়ে দেখা যায়, এসব ভাটায় স্তূপ করে রাখা হয়েছে কাঠ। আবার বেশির ভাগ ইটভাটা জনবসতিপূর্ণ এলাকায়, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে অবস্থিত। গত বুধবার ভেঙে দেওয়া ইটভাটা তিনটিও জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে ছিল। এর মধ্যে এস এস ব্রিকসের পাশেই দত্তপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অবস্থিত।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুসারে, ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানো দণ্ডনীয় অপরাধ। আর আবাসিক এলাকার তিন কিলোমিটারের মধ্যে ও কৃষিজমিতে ভাটা তৈরি নিষিদ্ধ।
নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্র বলছে, জেলায় ৯৫ শতাংশ ভাটা গড়ে তোলা হয়েছে ফসলি জমিতে। এতে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। আবার কালো ধোঁয়ায় আশপাশের জমির ফসলও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া ইট তৈরি করতে এলাকার আবাদি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। এতে দস্তা, কপার, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, নাইট্রোজেনসহ নানা ধরনের পুষ্টি উপাদান ধ্বংস হচ্ছে। জমির উপরিভাগের ছয়-সাত ইঞ্চি মাটিতে এসব উপাদান বেশি থাকে।
জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ইটভাটার অনুমোদন (লাইসেন্স) পেতে প্রথমে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হয়। এরপর জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এ অনুমোদনের পূর্বশর্ত হলো, ভাটায় আধুনিক প্রযুক্তির চিমনি (জিগজ্যাগ) করা, যা অনুমোদনহীন ৪৮টি ভাটাই নেই।