রাজধানীর নবাবপুরের টেকেরহাট লেন থেকে গতকাল রোববার দুপুরে দুই সন্তানের হাত ধরে বংশালে যাচ্ছিলেন গৃহবধূ সালমা বেগম। সেখানে তাঁর বাবার বাড়ি। তবে বেড়াতে নয়, যাচ্ছিলেন গোসল করতে। রমজান শুরু হওয়ার পর থেকে এভাবে যাচ্ছেন প্রতিদিন। বললেন, প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে এলাকায় লাইনে পানি আসে না। রোজা শুরু হওয়ার পর আর সহ্য করতে পারছি না। যদিও বংশালেও পানির সমস্যা আছে, তবে এখানকার মতো এত প্রকট নয়।
নবাবপুর রোডের ডান দিকে টেকেরহাট লেনের সামনে গত শনিবার রাতে পানির দাবিতে ক্ষুব্ধ মানুষ টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করে। টানা দুই সপ্তাহের পানির সংকট মেটাতে ওয়াসার একটি গাড়ি এলে অনেকেই পানি না পেয়ে ক্ষোভে সেই গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। রাস্তায় পোড়া টায়ারের দাগ এখনো আছে। এলাকাবাসী বলছেন, রমজানে পরিস্থিতি দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।
টেকেরহাট লেনে পরিস্থিতি সবচেয়ে শোচনীয়। এ ছাড়া নবাবপুরের মহাজনপুর ও বনগ্রাম এলাকার কয়েকটি বাড়িতে ওয়াসার পানি আসছে না। এখানকার কয়েকটি পাম্পের উত্তোলনক্ষমতা অনেক কমে গেছে বলে ওয়াসা জানিয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, তিনটি এলাকায় গতকাল দুপুর পর্যন্ত পানি আসেনি। এলাকাবাসীর অভিযোগ, সমস্যার শুরু থেকে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দিলেও তারা এগিয়ে আসেনি।
টেকেরহাট লেনের গলির মুখে একটি টিউবওয়েল এখন এলাকার প্রায় হাজার তিনেক লোকের ভরসা। সেই টিউবওয়েলে তিনটি পানির বোতলে পানি ঢালছিল ছয় বছরের শিশু তৃষা। বলল, ‘বাসায় পানি নেই। মা এই দুপুরে আসতে পারছে না। তাই আমি এসেছি।’
‘রোজার দিন। এ সময় দূর থেকে পানি নিয়ে আসতে হয়। সেটা চারতলায় নিয়ে উঠতে হয়। শরীরের অবস্থা কী হয় বলেন?’ ক্ষুব্ধ স্বরে বলছিলেন মহাজনপুর রোডের গৃহবধূ মাসুমা খান। তাঁর কথা, ‘৩০ বছর ধরে এলাকায় আছি। কিন্তু এমন পানির সমস্যা দেখি নাই।’
শনিবার রাতের প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন টেকেরহাট লেনের লায়লা বেগম। তিনি বলেন, ‘কুনু সুমায় এলাকায় এমন সমস্যা আগে দেহি নাইক্যা। শবে বরাতের ছময় থ্যাকা শুরু হইছে। রোজায় মানুষের কষ্ট বাইড়্যা গ্যাছে।’
গৃহবধূ রহিমা বেগম বললেন, ‘নিজেরা গোছল করি না, পোলাপানরাও না। পানির লাইগ্যা লজ্জাশরম ছাইড়া দিয়্যা রাস্তার কল থাইক্যা পানি নিতাচি।’ তিনি আরও বলেন, এলাকায় পানির সমস্যা শুরু হওয়ায় ওয়াসার পানিবাহী গাড়ির তোড়জোড় বেড়ে গেছে।
এই এলাকা ওয়াসার জোন-২-এর মধ্যে পড়েছে। এর নির্বাহী প্রকৌশলী এমদাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘টেকেরহাটে পানির গাড়ি ঢোকানোই যায় না। ভ্যানে করে এখানে পানি নিতে হয়। সমস্যার সমাধানে আমরা সর্বাত্মক কাজ করছি।’ তিনি জানান, টেকেরহাটে পানি সরবরাহ করা হয় সুরিটোলার পাম্প থেকে। পর্যাপ্ত উত্তোলন না হওয়ায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
টেকেরহাটের ব্যবসায়ী আবদুল মান্নানের অভিযোগ, প্রায় দুই সপ্তাহ আগে সমস্যা তৈরি হলে ওয়াসাকে জানানো হয়। কিন্তু সমাধানের কোনো উদ্যোগ তারা নেয়নি।
টেকেরহাটে পানির সমস্যা হঠাৎ হয়েছে—এ মন্তব্য করে ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, কয়েকটি পাম্পের উৎপাদনক্ষমতা কমে যাওয়ায় দুই দিন ধরে এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এগুলো পকেট সমস্যা। সংকটের মূলে রয়েছে পুরান ঢাকার বেশির ভাগ বাড়িতে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা না থাকা। যখন লাইনে পানি আসে, তখন তারা পানি ধরে।’ পানির সরবরাহ লাইনের কোনো সমস্যা নেই বলে তাঁর দাবি।
দুই সপ্তাহ ধরে পানি না পাওয়ার যে অভিযোগ এলাকাবাসী করছেন, সে সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটা একটা অদ্ভুত প্রবণতা, এক দিন পানি না পেলে সাত দিনের কথা বলে। সমস্যা দুই দিনের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে।’