অগ্নিকাণ্ডে নিখোঁজ শ্রমিকদের মধ্যে শামিমসহ ১২ জনের বাড়ি ভোলার চরফ্যাশন ও শশিভূষণে।
বাবা ফখরুল ইসলাম মসজিদে ইমামতি করে সংসার চালাতেন। তবে কয়েক মাস ধরে তাঁর সেই চাকরি নেই। তাই পরিবারকে সহায়তা করতে এবং নিজের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে হাসেম ফুড লিমিটেডে কাজ নেয় অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ শামিম। ইচ্ছা ছিল কয়েক মাস চাকরি করে বাড়ি ফিরে আবার লেখাপড়া শুরু করবে। কিন্তু কারখানার ভয়াবহ আগুনে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে।
হাসেম ফুড লিমিটেডে অগ্নিকাণ্ডে যেসব শ্রমিক নিখোঁজ, তাঁদের মধ্যে শামিমসহ ১২ জনের বাড়ি ভোলার চরফ্যাশন ও শশিভূষণ থানায়।
চরফ্যাশনের বকতিরহাট সিনিয়র মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল শামিম। গতকাল রোববার ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে সিআইডির ডিএনএ সংগ্রহ বুথে নিজের নমুনা দিতে এসেছিলেন শামিমের বাবা ফখরুল ইসলাম। তিনি জানাচ্ছিলেন, আর্থিক অনটনের মধ্যেও শামিমের পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার অদম্য ইচ্ছার কথা।
কথা বলতে বলতেই খেই হারিয়ে ফেলেন অসহায় বাবা ফখরুল ইসলাম। অনেকক্ষণ কথা বলার পর ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শামিমের খালু আনোয়ার বলেন, ‘বিচার চাই না, আমরা আমাদের ছেলের লাশ চাই।’
ভোলার চর উলানিয়াতে নিজেদের বাড়ি ছিল। নদীভাঙনের কবলে পড়ে ঘরবাড়ি সব হারিয়েছেন নিখোঁজ মোহাম্মদ নোমানের বাবা আবদুল মান্নান মাতব্বর (৬৫)। পরে একই জেলার শশিভূষণ থানার এওয়াজপুর ইউনিয়নে উত্তরাধিকার সূত্রে স্ত্রীর পাওয়া জমিতে ঘর করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাকেন তিনি। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে নোমান চতুর্থ।
লকডাউনে যানবাহন বন্ধ থাকায় ও হৃদ্রোগী হওয়ায় আত্মীয়স্বজনেরা প্রথমে আবদুল মান্নানকে ঢাকায় আসতে দেননি। শেষে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা দিতে আসতে হলো তাঁকে। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। অসুস্থ আবদুল মান্নানের কথা বলার ক্ষমতা নেই বললেই চলে। ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছিলেন না তিনি। বহু কষ্টে দেখালেন ছেলের ছবি।
মান্নান মাতব্বর বলেন, ‘পেটের দায়ে কাজ করতে এসেছে আমার ছেলে। ঈদে বাড়ি গিয়েছিল। তখন গাড়ি না থাকায় বালুর জাহাজে করে নারায়ণগঞ্জে এসেছে। ছেলে মাসে পাঁচ–ছয় হাজার টাকা দিত। এখন কী কইরা খামু, মাথায় ধরে না।’
শিফট শেষ হওয়ায় রাজীব হোসেন কারখানার বাইরে এসে খাচ্ছিলেন। স্ত্রী আমেনা বেগমের শিফট তখনো চলছিল। হঠাৎ নিচতলার ফ্লোরে আগুন দেখতে পান তিনি। স্ত্রীর কথা চিন্তা করে লাফ দিয়ে ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওপরে ওঠার দুটি সিঁড়ির গোড়ায় আগুন থাকায় আর ভেতরে যাওয়া হয়নি রাজীবের।
গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে কথা হচ্ছিল রাজীবের সঙ্গে। চার বছরের ছেলে রাফিনের অপেক্ষা মায়ের জন্য। কাছে যেতেই রাজীব বললেন, ‘ও এখনো কিছু জানে না। ও জানে মা দাদাবাড়ি গেছে। কাল আসবে।’
রাজীব ছয় হাজার টাকা ও আমেনা পাঁচ হাজার টাকা বেতনে কাজ করতেন। রাজীব বলছিলেন, ‘বিচার কি আর হইব? আমাদের চাওয়ার কিছু নাই, লাশটা যেন পাই।’
গত বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডসের কারখানায় আগুনে ৫২ জন মারা যান। আগুনে পুড়ে যাওয়ায় লাশের পরিচয় নিশ্চিত করতে স্বজনদের নমুনা নিচ্ছে সিআইডি। গতকাল পর্যন্ত ৪৫টি লাশের পরিচয় শনাক্তের জন্য ৬৩ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।