ফাইজার রূপকথা

ওর নাম ফাইজা আক্তার। আদর করে ডাকা হয় রূপকথা। বয়স এখন ১১ মাস। মুখে আধো আধো বোল। তবে মায়াবী দুই চোখের ইশারায় মনের ভাব বুঝিয়ে দেয় শিশুটি। কখনো খাবার চায়, কখনোবা কোলে ওঠার বায়না। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টাও করে।

সমবয়সী শিশু কাছে যারা আছে, তাদের সঙ্গে ভাব করে, জেদ দেখায়। মনমতো কিছু না হলেই কান্না জুড়ে দেয়। এভাবে আজিমপুরের ছোটমণি নিবাসে কাটছে ফাইজার দিনগুলো।

ছোটমণি নিবাসের বেবি কটে লাল টুকটুকে জামা পরে বসে আছে ছোট্ট ফাইজা। ছবি: জাহিদুল করিম

একটি বছর আগের কথা। দিনটি ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। জন্ম নেওয়ার পরই কারা যেন ফাইজাকে পূর্ব শেওড়াপাড়ায় কাছে ফেলে রেখে যায়। সিমেন্টের বস্তার ভেতর ছিল সে। পুরোনো বিমানবন্দরের রানওয়ের পাশে পাওয়া যায় বস্তাটা। সেখানে কুকুরের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত হয় তার ঠোঁট ও নাকের বেশ খানিকটা অংশ। বাঁ হাতের দুটি আঙুলের মাথাও গেছে কুকুরের পেটে। কান্না শুনে ওই নবজাতককে উদ্ধার করে একদল কিশোর। এদের মধ্যে সাব্বির নামের এক কিশোরের মা জাহানারা বেগম ছুটে গিয়ে শিশুটিকে কোলে নিয়ে নিজের ঘরে যান। নাভির সঙ্গে ঝুলন্ত নাড়িটি তিনি নিজেই কাটেন। ওই দিন সন্ধ্যায় শিশুকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক বিভাগে। এক মাস চিকিৎসা দেওয়ার পর গত বছরের ১১ অক্টোবর ওর ঠিকানা হয় সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত ছোটমণি নিবাসের তৃতীয় তলায়।

ফাইজাকে ভাত খাওয়ানো হচ্ছে। ছবি: জাহিদুল করিম

সেই থেকে ছোটমণি নিবাস একাই যেন মাতিয়ে রেখেছে ফাইজা। এখানে আসার পর প্রথম দিকে তো ওকে দেখার জন্য ভিড় জমে যেত। প্রথম থেকে ফাইজাকে আগলে রেখেছেন নাজমা বেগম। ছোটমণি নিবাসে সবাই ডাকে ‘খালাম্মা’। ১১ মাস বয়সী ফাইজার উচ্চতা এখন ১ ফুট ১১ ইঞ্চি। ওজন সাড়ে আট কেজি। এই তথ্য জানিয়ে নাজমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওর মা-বাবার সন্ধান মেলেনি। তবে আমি আছি। খাওয়া-খেলা সবই দেখছি। কেন জানি মনে হয়, ফাইজা একটু আলাদা স্বভাবের। শারীরিক গড়নেও আলাদা। হয়তো সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান হবে।’

জানা গেছে, প্রথম ছয় মাস ফাইজাকে কৌটার দুধ দেওয়া হতো। এখন সকালে দুধ ছাড়াও দুপুর আর রাতের বেলা সবজি কিংবা মুরগির মাংসের খিচুড়ি খাওয়ানো হয়। একটি করে সেদ্ধ ডিমও খাওয়ানো হয়। সকালে ঘুম ভেঙে খাওয়াদাওয়ার পর সঙ্গীদের সঙ্গে ফাইজার খেলা শুরু হয়।

কান্না থামানোর চেষ্টা চলছে। ছবি: জাহিদুল করিম

নিবাসের সেবিকা আনোয়ারা বেগম বলেন, ফাইজার সঙ্গে আলাদা আলাদা বেবি কটে থাকছে সমবয়সী আরও চার-পাঁচজন শিশু। খেলার সময় ফাইজাই ওদের লিডার। কথা বলার চেষ্টা করে। বেশ জোরে শব্দ করে।

যন্ত্রণা চলে গেলেও হাত-ঠোঁটে কিছুটা ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে ফাইজার। গত ৮ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে মেডিকেল বোর্ড ফাইজাকে পরীক্ষা করেছে।

ছোটমণি নিবাসের উপতত্ত্বাবধায়ক বিলকিস আক্তার বলেন, ফাইজা এখন সংকটমুক্ত। তবে ওর মুখের ক্ষতচিহ্ন দূর করতে অস্ত্রোপচার করাতে হবে। ফাইজার বয়স পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেই এটি করানো সম্ভব হবে বলে বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকেরা লিখিতভাবে জানিয়েছেন।

নিবাসের সেবিকা আনোয়ারা বেগমের কোলে ফাইজা। ছবি: জাহিদুল করিম

নিবাসে গিয়ে দেখা গেল, অচেনা লোক দেখলে ফাইজা প্রথমে বেশ ভয়ে ভয়ে থাকে। একটু সখ্য হলে ভাব জমিয়ে নেয়। জামা পাল্টে দিলে খুশি হয়। একটি জামা বদলে লাল রঙের জামা পরানো হলে আনন্দে আটখানা হয় ফাইজা। ভাবে, ওকে নিয়ে কেউ বেড়াতে যাবে। যদি ফাইজার সব ভাবনা সত্যি হতো! এমন হতো, ফাইজা ওর মা-বাবার কোলে চড়ে বেড়াতে যাচ্ছে! এই কল্পনা কি কখনো বাস্তব হবে? নাকি ওর কাছে রূপকথার মতো অধরাই থেকে যাবে।

নিবাসে খালাম্মা নাজমা বেগমের কোলে ফাইজা। ছবি: জাহিদুল করিম