ফারজানার লড়াইটা যেন থেমে না যায়

মেয়ের সঙ্গে শেখ ফারজানা রহমান
ছবি ফেসবুক থেকে নেওয়া

গত বছরের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে শেখ ফারজানা রহমানের প্রথমে গলা, ঘাড়ে ও হাতে কালো কালো ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসে ডান দিকের স্তনে চাকা অনুভব করেন। জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে ফারজানার শরীরের কোমরের নিচ থেকে ডান পাশটি অবশ হয়ে আসতে থাকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ফারজানার মস্তিষ্কে বাঁ দিকে বড় টিউমারের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। ২১ জুলাই অস্ত্রোপচারের পর সেই টিউমারের বায়োপসি রিপোর্টে ক্যানসার ধরা পড়ে। তবে চিকিৎসক জানালেন, স্তনের সেই চাকাই মস্তিষ্কের এই টিউমারের উৎস। এটি ছড়িয়েছে ঘাড়েও।

এই এক বছরেই পাল্টে গেল জীবন। হাস্যোজ্জ্বল ফারজানা ছিলেন পরিবার ও বন্ধুদের গল্প-আড্ডার মধ্যমণি। এখনো তিনি আলোচনার মধ্যমণি, তবে সেই আড্ডায় তিনি আর উপস্থিত থাকেন না, হয়ে গেছেন আড্ডার বিষয়বস্তু। বেঁচে থাকাটাই এখন তাঁর কাছে অনেক বড় লড়াই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (২০০০-২০০১ শিক্ষাবর্ষ) অর্থনীতি বিভাগে পড়াশোনা শেষ করে ফারজানা নরসিংদী সরকারি কলেজের প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১১ বছরেরর সংসারে স্বামী ও দুই সন্তান আছে। অন্য আট-দশজন নারীর মতো ভালোই কাটছিল তাঁর দিন। ফারজানার স্বামী ব্যাংকে কর্মরত।

২০১৮ সালে স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলেন ফারজানা

তবে বায়োপসি রিপোর্ট পাওয়ার পর জীবনটা যেন থমকে দাঁড়ায়। নিজের অবর্তমানে দুই সন্তান কীভাবে বড় হবে? চিকিৎসা খরচই বা কীভাবে সামাল দেবেন? এ ধরনের চিন্তায় রাতে দুচোখের পাতা এক করতে পারেন না। চতুর্থ ধাপে ক্যানসারটি (ফোর মেটাস্টেসিস) ধরা পড়েছে।

গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ১০টি রেডিওথেরাপি ও ৬টি কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছে ফারজানার। কেমোথেরাপি দেওয়ার পরের দিন দিতে হতো একটা ইনজেকশন। প্রতিটি কেমোতে লেগেছে পৌনে তিন লাখ টাকা। এ বছরের জানুয়ারিতে পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে স্তনের টিউমারটি অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসক। মার্চ মাসে ভারতের চেন্নাইয়ে গেলে সেখানকার চিকিৎসকেরা আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তখন আবার মাথায় তিনটি টিউমার ও ফুসফুসে চাকা ধরা পড়ে। চিকিৎসক তখন স্তনে অস্ত্রোপচারের বিষয়টি বাতিল করে দিয়ে মাথায় ১০টি রেডিওথেরাপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর নতুন ধরনের ৬টি কেমোথেরাপি শুরু হয়। ভারতে একেকটি কেমোর খরচ ছিল প্রায় পৌনে তিন লাখ রুপি। তাই একটি কেমো দিয়ে দেশে ফিরে আসেন ফারজানা। ভারতে তাঁর চিকিৎসার পেছনে খরচ হয় ১১ লাখ রুপির মতো।

পঞ্চম কেমোটা আবার ভারতে গিয়ে দিতে বলা হলেও করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ফারজানার পক্ষে আর যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে অনলাইনে সেখানকার চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। ভারতের চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর এই ক্যানসার পুরোপুরি নির্মূল করা যাবে না।

এখনো ফারজানাকে ডান পা টেনে টেনে হাঁটতে হয়। ডান হাতটা দিয়েও আর আগের মতো ভালো করে কিছু করতে পারেন না। সপ্তাহে পাঁচ দিন করে ফিজিওথেরাপি নিচ্ছেন।

ফারজানা আক্ষেপ করে বলেন, ‘আবার কি প্রিয় ক্লাসরুমে ফিরতে পারব? শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারব? চক দিয়ে বোর্ডে লিখতে পারব? ছেলেটা এ ঘরে থেকে ও ঘরে দৌড়ায়। ও চায় ওর সঙ্গে খেলি। কিন্তু আমি যে আর ছুটতে পারি না। মেয়েটা বড়। ও শুধু বোঝে মায়ের অসুখ হয়েছে।’

বর্তমানে ফারজানা বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চিকিৎসক অ্যাসোসিয়েট কনসালট্যান্ট আরিফুর রহমানের অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ফারজানার বর্তমান শারীরিক যে অবস্থা, তাতে তাঁকে ২১ দিন পর পর কেমো নিয়েই চলতে হবে। এরপরই যদি এটি শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে আবার হয়তো নতুন করে ভাবতে হবে। এখন যে কেমো চলছে, তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলেও জানান তিনি।

ফুটফুটে দুই সন্তানই এখন ফারজানার বড় চিন্তা। তাঁর অবর্তমানে কীভাবে তারা বড় হবে ভেবে কুলকিনারা পান না তিনি

এই কেমোর বাইরেও ফারজানার তিন মাস পরপর বড় বড় কিছু পরীক্ষা করাতে হবে। আর প্রতিদিনই লাগছে নানা ধরনের ওষুধ। এ পর্যন্ত দেশে-বিদেশে চিকিৎসায় ৬০ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। পরিবার, সহকর্মী, প্রিয় কর্মস্থল ও শিক্ষা ক্যাডার, ক্যাম্পাসের বন্ধুরা ফারজানাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন। কিন্তু প্রতি মাসেই তো চিকিৎসার জন্য দরকার হচ্ছে সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই লাখ টাকার মতো। স্বজন-বন্ধুরা আর কতটাই বা টানতে পারেন।

২০০৭ সালে মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হওয়ার কয়েক দিনের মাথায় বাবাকে হারান ফারজানা। সরকারি কর্মকর্তা বাবা কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন। কল্যাণপুরে পৌঁছে বাসায় (বাসাবো) ফোন দিয়ে বলেছিলেন, বাসায় এসে ভাত খাবেন। এর কিছুক্ষণ পর থেকে বাবার ফোন বন্ধ ছিল। রাতে বাবাকে পেয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। মলম পার্টির খপ্পরে পড়ে মারা গিয়েছিলেন তিনি। সেই স্মৃতি আজও তাড়া করে বেড়ায় তাঁকে।

ফারজানা বললেন, ‘মানুষ যখন-তখন মরে যায়। সেই তুলনায় আল্লাহ আমাকে অন্তত লড়াই করার সুযোগ তো দিয়েছেন। সবার কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি, তা নিয়ে লড়াইটা শেষ করতে চাই। আমার এ স্বপ্ন পূরণে আরও অনেক মানুষের সহযোগিতা চাচ্ছি।’
ফারজানাকে সহযোগিতার ঠিকানা
Account Name- Farzana Ovi
A/C No- 115912133017995
Bank Name- Mercantile Bank Limited
Branch- Dholaikhal, Dhaka
Routing No- 140271841

বিকাশ/ রকেট/ নগদ- 01757136426