ফিরে এল কাসিদা
‘সাবকো রোজা রাখনে কি য়া আল্লাহ তাওফিক দে
সাবকো নামাজ পাড়নে কি য়া আল্লাহ তাওফিক দে
এক মাহিনা ৩০ রোজা ছোড় চালে
বারকাত কা দিন আব তো দেখো ছোড় চালে’
বুড়িগঙ্গার পানির ওপর দিয়ে অন্ধকারে ভেসে আসছে উর্দু সংগীত। মাইকে সাহ্রির আহ্বান আর সংগীতের মৃদু বাজনা মিশে যাচ্ছে নৌকা চলার শব্দের সঙ্গে। এই দৃশ্যের সঙ্গে বর্তমান প্রজন্ম কিছুটা কম পরিচিত। তবে আগের প্রজন্মের কাছে বিষয়টি অজানা নয়। বিশেষত যাঁরা পুরান ঢাকার বাসিন্দা, পবিত্র রমজানে শেষ রাতের দিকে এই আহ্বান শোনার জন্য তাঁদের মন অপেক্ষায় থাকত।
যে সংগীত আর দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়া হলো, তা কাসিদা অব ঢাকা নামের একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের। বাংলাঢোলের প্রযোজনায় চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন অনার্য মুর্শিদ। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে নির্মাতা এই প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন প্রায় ৪০০ বছরের বিস্তৃত উপমহাদেশীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতিকে। শুধু পরিচয়ই নয়, এই সংস্কৃতির নৃতাত্ত্বিক ভিত্তিও উঠে এসেছে পর্দায়।
কাসিদা শব্দটি আরবি। এর অর্থ প্রশংসা বা প্রশস্তিমূলক কবিতা। ইসলাম ধর্মের প্রথম পর্বেই আরবি সাহিত্যে কাসিদার বড় ভান্ডার গড়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে ফারসি, তুর্কি, উর্দু ভাষায় কাসিদার বিস্তর দেখা মেলে।
পবিত্র রমজান এলেই পুরান ঢাকায় সাহ্রির সময় রোজাদারদের ঘুম ভাঙানোর জন্য মহল্লায় মহল্লায় কাসিদা গাওয়া হতো। এটিকে তাঁরা সওয়াবের কাজ মনে করতেন। আর ঈদের দিন মহল্লায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে নজরানা নিয়ে আসতেন। দুই দশক আগেও ঢাকার লালবাগ, হাজারীবাগ, মালিবাগ, খিলগাঁও, রামপুরা, মোহাম্মদপুর এলাকায় কাসিদার প্রচলন ছিল। এমনকি বছর পাঁচ আগেও পুরান ঢাকার পাতলা খান লেন, লক্ষ্মীবাজার এলাকায় কাসিদা গাওয়া হয়েছে।
ঢাকায় রমজানে কবে, কখন থেকে কাসিদার প্রচলন শুরু হয়, তা নিয়ে মতভেদ আছে। ধারণা করা হয়, মোগল আমলে শুরু হলেও ইংরেজ আমলে এসে তার শানশওকতে মরিচা পড়ে। তবে লেখক, সাংবাদিক হাকিম হাবিবুর রহমানের বর্ণনা থেকে ধারণা করা যায়, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে হয়তো আবার তার প্রচলন ঘটে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ঢাকা: স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৪৭-এর পর উর্দুভাষী মোহাজেররা ঢাকায় এসে কাসিদায় নতুন মাত্রা যোগ করেন।
কাসিদার সুর প্রয়োগ করা হয় শাহেদি, মার্সিয়া, নাত-এ রাসুল, ভৈরবী, মালকোষ প্রভৃতি রাগে। অধিকাংশ কাসিদার সুর তৎকালীন ছায়াছবির গান থেকে নেওয়া। কাসিদা মূলত গাওয়া হয় সম্মেলক কণ্ঠে। এই সংগীত যাঁরা লিখতেন, তাঁদের বলা হয় কাসেদ। যিনি দলের নেতৃত্ব দেন, তাঁকে বলা হয় সালারে কাফেলা।
তিন রকমের কাসিদার কথা বিভিন্ন বইপত্রে উল্লেখ আছে। এগুলো হলো আমাদি, ফাজায়েলি, রুখসাতি বা বিদায়ী।
উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে এ পর্যন্ত এই অঞ্চলে অনেকেই কাসিদা রচনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মুনসেফ, এজাজ, হামিদ-এ-জার, হাফেজ দেহলভি, জামাল মাশরেকি, তালেব কবির, মুজিব আশরাফি, সারওয়ার, শওকত প্রমুখ।
প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটিতে কাসিদা সম্পর্কে তথ্য পরিবেশনে পরিচালক নাটকীয়তার আশ্রয় নিয়েছেন, যা প্রশংসাযোগ্য।
খ্যাতনামা প্রামাণ্যচিত্র-নির্মাতা জঁ রোচা হ্যান্ডি ক্যামেরা ব্যবহার করে ঘটনা বাস্তবের মতো করে দর্শকদের সামনে তুলে ধরে ‘মকুমেন্টারি’ নামের প্রামাণ্যচিত্রের একটি ধারা তৈরি করেছিলেন। সেই ধারা পৃথিবীর অনেক নির্মাতাই এখনো অনুসরণ করছেন। কাসিদার পরিচালকও সম্ভবত সে রকম একটি পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। কোনো সেট তৈরি, প্রপস, অতিরিক্ত পোশাক-পরিচ্ছেদ, মেকআপ—কোনো কিছুর মধ্যেই তিনি যাননি। কাসিদা অব ঢাকা দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার।
চলচ্চিত্রটিতে ধারাবর্ণনা দিয়েছেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। চিত্রগ্রাহক ছিলেন রাসেল আবেদিন। সম্পাদনা করেছেন অনয় সোহাগ।
বিষয়ের গভীরতা এবং শ্রমসাধ্য গবেষণার জন্য চলচ্চিত্রটি গত বছর (২০২০) দিল্লির ইন্দুস ভ্যালি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা প্রামাণ্যচিত্রের পুরস্কার লাভ করে। চলচ্চিত্রটি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ১৯তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও ‘স্পিরিচুয়াল’ ক্যাটাগরিতে প্রদর্শিত হয়েছে। এটি পরিচালকের প্রথম চলচ্চিত্র হলেও এর আগে তিনি বেশ কিছু টিভিসি, ওভিসি, টক শো নির্মাণ করেছেন। মুঠোফোনে আলাপনে অনার্য মুর্শিদ জানান, প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি দর্শকদের জন্য কিছুদিন ইউটিউবে উন্মুক্ত থাকবে। এটি ঢাকার সংগীতের ওপর তাঁর পরিকল্পনায় থাকা সিরিজ প্রামাণ্যচিত্রের একটি। সিরিজের বাকি চলচ্চিত্রগুলোর কাজ শিগগিরই শুরু করতে চান তিনি।
কাসিদা অব ঢাকা দেখতে গিয়ে দর্শক সবচেয়ে বেশি চমৎকৃত হন শেষের দিকে। যখন কাহিনিচিত্রের মতো পরিচালক কাসিদা লেখক তালেব কবিরের মৃত্যুকে উপস্থাপন করেন। কাসিদা সংস্কৃতির প্রতি যাঁর আগ্রহ নেই, তাঁরও চোখ ছলছল হবে এই দৃশ্যে।
আরও পড়ুন
-
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে আজ, যেভাবে চলবে ক্লাস, মানতে হবে কিছু নির্দেশনা
-
দামুড়হুদায় মুনছুরের ব্যাংকে জমা বেড়েছে ২ হাজার ৫৩৮ গুণ
-
মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা চালাচ্ছে চীন: অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন
-
এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী ৯ থেকে ১১ মের মধ্যে
-
আবার জোড়া গোল মেসির, মায়ামির পর এবার শীর্ষে তুললেন নিজেকে