দ্বিতীয় শীর্ষ শ্রমবাজার কাতার

বাংলাদেশিদের জয়জয়কার

বিমানবন্দরের ভেতরে বা বাইরে, শহরের কোনো সড়ক বা খাবারের দোকান, সবজির বাজার বা মসজিদ —কাতারের রাজধানী দোহারে এমন এলাকা খুঁজে পাওয়া কঠিন—যেখানে বাংলাদেশি নেই। দোহার ন্যাশনাল কিংবা নাজমা তো রীতিমতো বাঙালি এলাকা।

আর ছোট্ট দেশ বাহরাইন ঘুরলে মানুষজন দেখে মনে হবে, এও বুঝি আরেক বাংলাদেশ। এখানকার বহু এলাকা বাঙালি গলি নামেই পরিচিত। এসব এলাকায় দোকানপাটের সাইনবোর্ড থেকে শুরু করে ক্রেতা-বিক্রেতাদের অধিকাংশই বাংলাদেশি।

গত ১৫ দিন কাতার ও বাহরাইন ঘুরে মনে হলো এমন দৃশ্যই যেন এ দেশে স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের সাফল্যের কথা যেমন জানা গেছে, তেমনি সাত থেকে আট লাখ টাকা খরচ করে ‘ফ্রি ভিসা’য় বিপুলসংখ্যক লোক আসা নিয়ে শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন অনেকে।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে ওমানের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় শীর্ষ শ্রমবাজার এখন কাতার। আর সিঙ্গাপুরের পরপরই চতুর্থ অবস্থান বাহরাইনের।

কাতারে বাংলাদেশের দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, এখন প্রতিদিনই দুই থেকে আড়াই শ বাংলাদেশি আসছেন এ দেশে। মাসে সেই সংখ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে সাত থেকে আট হাজার। গত দেড় বছরেই এখানে এসেছেন এক লাখ লোক। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ৫৭ হাজার ৫৮৪ জন আর এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬২ হাজার ২৮০ জন বাংলাদেশি কাতারে এসেছেন।

কাতারে যাঁরা আসছেন, তাঁদের বেশির ভাগই নির্মাণশ্রমিক। ২০২২ সালের বিশ্বকাপ আর ২০৩০ সালে পৃথিবীর সেরা দেশ হওয়ার জাতীয় যে লক্ষ্যমাত্রা, সেটি সামনে রেখে কাতারজুড়ে চলছে নির্মাণযজ্ঞ।

 তিন থেকে সাত লাখ টাকা খরচ: ২৮ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে তিনটায় ঢাকা থেকে দোহার ফ্লাইট। রাত দেড়টায় হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের ৫ নম্বর গেটে গিয়ে চোখে পড়ল লম্বা লাইন। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের রজব আলী, কুমিল্লার দাউদকান্দির মোহাম্মদ মইনুল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আবদুল বারেক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের মিলন মিয়াসহ আরও অনেকের সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা সবাই নির্মাণশ্রমিক। রজব আলী লেখাপড়া খুব একটা করেননি। দেশে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। প্রত্যেকেই জানালেন, কাতারে যেতে তাঁদের দুই থেকে তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

উড়োজাহাজে পাশের আসনে বসেছিলেন নোয়াখালীর সেনবাগের আমির হোসেন। ২১ বছর আগে ১৯৯৩ সালে তিনিও নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাতারে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর এখন নিজেরই একটি প্রতিষ্ঠান আছে। আমির হোসেন বললেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের হাল ধরতে কাতার চলে গিয়েছিলাম। আমার ছোট ভাইবোন আটজন। সবাইকে মানুষ করেছি। দেশে বাড়ি করেছি। আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। কাতারের যেখানেই যান, বাংলাদেশের লোক পাবেন।’

আমির হোসেনের কথার সত্যতা পাওয়া গেল দোহার হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই। এখানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের অধিকাংশই বাংলাদেশি। তাঁদের মধ্য থেকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের ইমাম হোসেন ও শাহপরান জানালেন, তাঁরা তিন লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ করে এসেছেন। তাঁরা বেতন হিসেবে বাংলাদেশি ২০ হাজার টাকা ও খাওয়া খরচ বাবদ সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার সমান অর্থ পান। যে টাকা খরচ করে এসেছেন, সেটা তুলতেই দুই বছর লেগে যাবে।

দোহার নাজমা এলাকার হারেজ মার্কেট কাতারের আসবাব কেনাবেচার সবচেয়ে বড় বাজার। এখানে যত দোকান আছে, তার অধিকাংশই চালান বাংলাদেশিরা। হারেজ মার্কেটে কিছুক্ষণের অবস্থানে দেখা গেল কোনো গাড়ি এলেই পিছু পিছু ছুটছেন ১০ থেকে ১৫ জন বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে আছে অনেক কিশোরও।

এভাবে ছোটার কারণ সম্পর্কে জানতে কথা হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের সবুজ মিয়া, মোহাম্মদ লিটন, আবু কাউসার, মাসুদ ভুইয়া, আনোয়ার হোসেন, নোয়াখালীর লোকমান হোসেন, চাঁদপুরের মোহাম্মদ রুবেল, মোহম্মদ রাফেজসহ আরও অনেকের সঙ্গে। জানা গেল, সাত লাখ টাকা খরচ করে ‘ফ্রি ভিসা’য় তাঁরা এসেছেন। দালালেরা বলেছিল, যেখানে ইচ্ছা কাজ, মাসে আয় লাখ টাকা। কিন্তু এসে দেখেন কাজ নেই। কাজেই যখনই কোনো আরব এখানে গাড়ি নিয়ে আসেন, সবাই মিলে ছোটো তাঁর পেছনে ছোটেন। যদি কোনো কাজ পাওয়া যায়।

সবার একটাই পরামর্শ, বাংলাদেশ থেকে সাত লাখ টাকা খরচ করে কেউ যেন ফ্রি ভিসায় না আসেন। কারণ, মাসে খরচ কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা। কিন্তু অনেক সময় সেই টাকাও মেলে না।

বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশিরা: তেলসমৃদ্ধ কাতার এখন মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে সবচেয়ে ধনী দেশ। মাথাপিছু আয় এক লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলারের ওপরে। দেশটির নিজেদের জনসংখ্যা মাত্র আড়াই লাখ। বাকি ১৭ লাখ প্রবাসী। এর মধ্যে প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশি। বাংলাদেশিদের অধিকাংশ মানুষই খুব ভালো আছেন। কাতারের প্রায় ৭০০ মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন বাংলাদেশের।

বাংলাদেশিদের মধ্যে ৮০ ভাগই নির্মাণশ্রমিক। তবে প্রতিষ্ঠিত কয়েক হাজার ব্যবসায়ীও এখানে আছেন। কাতারের ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও সবজির ব্যবসা বাংলাদেশিদের নিয়ন্ত্রণে। আবু হামর এলাকায় গিয়ে চোখে পড়বে সবজির বিশাল হাট। সেখানে একচেটিয়া কাজ করছেন বাংলাদেশিরা। এ ছাড়া কাতারের বোরকা ও আতরের মার্কেটও বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে। কাতারে বাংলাদেশি ব্যাংকার, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরাও আছেন।

কাতারের বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর শফিউল আজিম বললেন, ‘এখানে বাংলাদেশি কর্মীদের অনেক সুনাম। তবে ফ্রি ভিসা বলে কিছু নেই। এভাবে যেন কেউ না আসেন।’

বাহরাইনের সর্বত্র বাংলাদেশি: ৫ অক্টোবর দোহা থেকে বিমানে মানামা যাওয়ার পথেই আলাপ হয় বাহরাইন বিমানবন্দরের সাবেক কর্মকর্তা নাদের সাকিবের সঙ্গে। জানালেন, বাহরাইনের সর্বত্রই বাংলাদেশিরা আছেন।

বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে মনে হবে এও আরেক বাংলাদেশ। মাত্র ৭৮০ বর্গকিলোমিটারের ছোট্ট দেশ বাহরাইন। শহরের সর্বত্রই বাংলাদেশিদের দাপট। চোখে পড়বে অসংখ্য বাংলা লেখা সাইনবোর্ড। মানামা, মহররক, রিফসহ বিভিন্ন এলাকায় আছে বাঙালি গলিও।

বাহরাইনের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেল, ২০১৩ সালে ২৫ হাজার ১৫৫ জন এবং ২০১৪ সালের নয় মাসে ১৭ হাজার ৫৬৫ জন বাংলাদেশি এখানে এসেছেন। সব মিলিয়ে এক লাখের মতো বাংলাদেশি আছেন বাহরাইনে।

রাজধানী মানামার প্রাণকেন্দ্রে গেলে চোখে পড়বে খাবারের দোকান থেকে শুরু করে ইন্টারনেটের দোকান, সবজির বাজার, সেলুন, বোরকার দোকান—সবই চালাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। এখানকার অধিকাংশ হোটেলের কর্মচারীও বাংলাদেশের।

বাহরাইনের সবচেয়ে বড় খাবার দোকানগুলোর একটি কিউই রেস্টুরেন্ট। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশির মিয়া জানালেন, প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় হাজার লোক তাঁর দোকানে খেতে আসেন।

মানামা ছাড়াও মহররক, রিফাসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়েও বাংলাদেশিদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেখা গেছে। শহরের সর্বত্র নির্মাণকাজে অংশ নিচ্ছেন বাংলাদেশিরা। হিদ এলাকার মাছ ধরার জেলেদের প্রায় সবাই বাংলাদেশি। সবচেয়ে বড় মাছ ব্যবসায়ী চট্টগ্রামের সন্দীপ এলাকার বেলাল হোসেন জানালেন, এখানকার জেলেদের অধিকাংশই চট্টগ্রামের।

বাহরাইনের সবচেয়ে বড় মাছের বাজার গালফ ফিশ মার্কেটও বাংলাদেশিদের নিয়ন্ত্রণে। তাঁদের অধিকাংশের বাড়িই আবার সিলেট। এ ছাড়া কাররানা এলাকায় বাহরাইনের মরুভূমিতে সবজি চাষ করছেন বাংলাদেশিরা। এখান থেকেই সবজি যায় শহরের বিভিন্ন সুপারশপে।

মানামার প্রবাসী বাংলাদেশিরা জানালেন, বাহরাইনে অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশি আছেন। তাঁরা ফ্রি ভিসায় এসে এখন অন্য জায়গায় কাজ করতে গিয়ে অবৈধ হয়ে গেছেন।

বাহরাইনের বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর মহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বললেন, ‘ফ্রি ভিসার নামে অনেক বাংলাদেশি এখানে আসছেন, যাঁরা অন্য জায়গায় কাজ করছেন। এভাবে আসা বন্ধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে সংকট তৈরি হবে।’