বাংলার সমৃদ্ধ লোকসাহিত্য ও লোকগীতি হারিয়ে যাচ্ছিল। ড. দীনেশচন্দ্র সেন গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে প্রাচীন বাংলার পুঁথি সংগ্রহ করেন এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করেন। লেখনীর মাধ্যমে তিনি গ্রামবাংলার লোকসাহিত্য বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান আকাশছোঁয়া।
আচার্য ড. দীনেশচন্দ্র সেনের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে বক্তারা এসব কথা বলেন। মানিকগঞ্জ শহরের বিজয় মেলা মাঠে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের আয়োজন করে জেলা প্রশাসন এবং মানিকগঞ্জ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ। সম্মেলন চলবে কাল শনিবার পর্যন্ত।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, রবীন্দ্রনাথের সময়ে সাহিত্যে খ্যাতি লাভ করা সহজসাধ্য ছিল না। দীনেশচন্দ্র সেন সেই কঠিন কাজকে সহজসাধ্য করেছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার। তিনি গ্রামবাংলার লোকসাহিত্য ও পুঁথি সংগ্রহ করতেন। এরপর তিনি বিশ্বখ্যাত মৈমনসিংহ গীতিকা রচনা করেন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ওপর তাঁর লেখা বঙ্গভাষা ও সাহিত্য একটি সুশৃঙ্খল ও ধারাবাহিক তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণাগ্রন্থ, যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ সমকালীন পণ্ডিতদের প্রশংসা লাভ করে। এই গ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় দীনেশচন্দ্র সেন এ বিষয়ে পথিকৃতের সম্মান লাভ করেন। তিনি জীবিত থাকাবস্থাতেই স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ হিস্ট্রি অব বেঙ্গলি লিটারেচার প্রকাশিত হলে তা সর্বমহলের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। সাহিত্য ও গবেষণায় অবদানের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি দেয়। এ ছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করে।
অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ। সাহিত্যে দীনেশচন্দ্র সেনের অবদানের বিষয়ে তিনি বলেন, বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিতে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অবদান রয়েছে—এই সত্য দীনেশচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। আধুনিকতা-পূর্ব বাংলা সাহিত্যে মুসলমান গ্রামীণ কবিদের সাহিত্যকর্মকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেছেন দীনেশচন্দ্র। এ জন্য পূর্ব বাংলার মানুষ তাঁর কাছে ঋণী। তাঁর সাহিত্যকর্ম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তোলে ও তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়।
জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন জেলা পরিষদের প্রশাসক গোলাম মহীউদ্দীন, মানিকগঞ্জ পৌর মেয়র গাজী কামরুল হুদা, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার তোবারক হোসেন এবং মানিকগঞ্জ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদের সভাপতি আজহারুল ইসলাম প্রমুখ। পৌর মেয়র তাঁর বক্তব্যে মানিকগঞ্জে দীনেশচন্দ্র সেনের নামে একটি ইনস্টিটিউট নির্মাণের দাবি জানান।
আলোচনা পর্ব শেষে সন্ধ্যায় শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে কিরণ চন্দ্র রায়, সাইদুর রহমান বয়াতি ও অন্য শিল্পীরা গান পরিবেশন করেন।
দীনেশচন্দ্র সেন ১৮৬৬ সালের ৩ নভেম্বর মানিকগঞ্জ পৌর এলাকার বগজুরি গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার বাড়ি ঢাকার ধামরাই উপজেলার সুয়াপুর গ্রামে। ১৯৩৯ সালের ২০ নভেম্বর তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।