বাংলা একাডেমিতে দিনভর জমজমাট পাঠক উৎসব

বাল্যবিবাহ বন্ধের প্রত্যয়

পাঠক উৎসব
পাঠক উৎসব

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে দৃপ্তকণ্ঠে আওয়াজ উঠল প্রথম আলোর ১৮ বছর পূর্তির পাঠক উৎসবে। গতকাল শুক্রবার সকালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত দিনভর এই উৎসবের শুরুতে নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দেওয়া ঝালকাঠির স্কুলছাত্রী শারমিন আক্তার স্লোগান ধরেন, ‘আঠারোর আগে বিয়ে নয়। কুড়ির আগে মা হওয়া নয়’। উপস্থিত সবাই তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মেলান। অনুষ্ঠানের শেষেও ছিল এই আহ্বান। বিনোদন জগতের তারকা শিল্পীরা দর্শকদের নিয়ে আহ্বান জানিয়েছেন বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের।
প্রথম আলো আজ দেশের সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকায় পরিণত হয়েছে তার ৫৫ লাখ পাঠকের আস্থা ও ভালোবাসার জন্য। তাই পাঠকদের নিয়েই আয়োজন করা হয়েছে ১৮ বছর পূর্তি উৎসব। গতকাল সকাল সাড়ে নয়টায় বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে বাংলা ঢোলবাদন পরিবেশন দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।
সকালে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পরে দেখানো হলো বর্ষপূর্তি উপলক্ষে নির্মিত তথ্যচিত্র অধিনায়ক ও নায়কেরা। ইতিমধ্যে তথ্যচিত্রটি সারা দেশে ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে। এতে এক দিনের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা তাঁর চোখে চারজন নায়কের কথা বলেছেন। তাঁদের একজন ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার। গত বছর পরিবারের পক্ষ থেকে তার বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। শারমিন নিজেই এ বিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছিল। তথ্যচিত্র প্রদর্শনের পরে মঞ্চে আমন্ত্রণ জানানো হয় শারমিন আক্তার এবং অন্য তিনজনকে। তাঁরা হলেন এসএ গেমসে স্বর্ণপদক জয়ী মাবিয়া আক্তার সীমান্ত, সদরঘাটের দুই পা হারানো ফুটবলার আবদুল্লাহ ও চট্টগ্রামের প্রকৌশলী সাইফুল ইসলামকে, যিনি অফিস ছুটির পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দুস্থ রোগীদের সেবা দেন, প্রয়োজনে ওষুধপথ্য কিনে দেন।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক যখন চার নায়ককে মঞ্চে ডাকলেন, তখন এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। দর্শকেরা সবাইকে করতালিতে অভিনন্দিত করেন। তাঁরা চারজনও প্রথম আলোকে অভিনন্দন জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন।
শারমিন আক্তার তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাতে এসে বলেন, ‘আমি চাই না, ১৮ বছরের কম বয়সী কোনো মেয়ের বিয়ে হোক। মেয়েরা প্রতিবাদ করতে শিখুক। সকল অভিভাবকের আছে আহ্বান জানাই, মেয়েদের পড়ালেখার সুযোগ করে দিন। কোনো মেয়ে যেন অসহায় না থাকে। দুই কোটি কিশোরী মিলে দেশকে জয় করব।’ তিনি দৃপ্তকণ্ঠে আওয়াজ তোলেন ‘আঠারোর আগে’, সমবেত সবাই বলেন ‘বিয়ে নয়’। এ সময় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ-সংক্রান্ত স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড তুলে দেওয়া হয় সবার হাতে। সেই নিয়ে তাঁরা স্লোগান দেন ‘কুড়ির আগে মা নয়’। সবাই মিলে দেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেন। পরে তরুণ প্রজন্মের দুই প্রতিনিধি রাজশাহীর আনিকা বুশরা ও ঢাকার টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিক তাঁদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
পুরো প্রাঙ্গণ সাজানো হয়েছিল মেলার মতো বর্ণাঢ্য সাজসজ্জায়। দক্ষিণে মূলমঞ্চ। এ ছাড়া আরও একটি মঞ্চ করা হয়েছিল উত্তরে আমতলার সামনে। বটতলায় প্রথমা প্রকাশনের বইয়ের স্টল। সামনের প্রাঙ্গণে শিশির ভট্টাচার্য্যের কার্টুন ও সংবাদচিত্রের প্রদর্শনী।
বটতলা ঘিরে ভাষা ও দেশের জন্য আত্মদানকারী বীর তরুণ শহীদদের প্রতিকৃতি। তাঁদের মধ্যে বরকত, আসাদ, রুমি, রাউফুন বসুনিয়া, নূর হোসেন থেকে ছিল সম্প্রতি হলি আর্টিজানে বন্ধুত্বের জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী তরুণ ফারাজ আইয়াজ হোসেনের প্রতিকৃতি।
আমতলায় ‘বিনোদন’-এর প্যাভিলিয়ন। প্রাঙ্গণজুড়ে চলচ্চিত্র ও টিভি তারকাদের প্রমাণ আকারের প্রতিকৃতি। সেই প্রতিকৃতির সঙ্গে সেলফি তোলার ভিড় লেগেই ছিল সারাক্ষণ। মজার মজার খেলার আয়োজন ছিল রস+আলোর স্টলের সামনে। সেখান থেকে দেওয়া হচ্ছে সনদ। সেটি যথারীতি সুদৃশ্য। তবে তা দেওয়া হয়েছিল ‘মর্মাহত’ হয়ে। কিন্তু সেটি পেয়ে শুক্রাবাদের আতিক-উজ-জামান যারপরনাই খুশি। বললেন, বাঁধিয়ে রাখবেন। গলফ বল গর্তে ফেলে ওই সনদ অর্জন করেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এবং রস+আলোর স্বঘোষিত ‘একনিষ্ঠ ভক্ত’ আতিক।
নকশার স্টল সারা দিনই জমজমাট করে রেখেছিলেন বিভিন্ন অঙ্গনের তারকারা। পাশেই ফিচার বিভাগের স্টল। পুকুরের পাড় দিয়ে উত্তরের প্রান্তে ছিল আইসক্রিম আর গরম গরম ম্যাগি সুপ ও নুডলস। পশ্চিম দিকে বার্তা বিভাগের স্টল। আরও ছিল খেলা, স্বপ্ন নিয়ে, কিশোর আলো, বিজ্ঞানচিন্তা ও বন্ধুসভার স্টল। বেঙ্গল মিটের খাবারের স্টলও ছিল এদিকে। আর বহেড়াতলায় বাচ্চাদের জন্য চক্রাকার ঝিকঝিক রেলগাড়ি, লম্ফঝম্প, দোলনাসহ মজার মজার সব খেলার আয়োজন।
সকালের পর্বের পরে ছিল পূজা সেনগুপ্তর পরিচালনায় নাচের দল তুরঙ্গমীর নৃত্যানুষ্ঠান বসন্তপট। পরে গান গেয়ে শোনান শফি মণ্ডল, অনিমা রায়, সায়ান আশিক, মুন, রাগী ও অর্পিতা। ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতাটি নিয়ে থিম গান পরিবেশন করেন মিনার, প্রিতম, তৌফিক, নাওমী ও ঐশী। শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য দেন গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ ও চিত্রনায়ক ফেরদৌস। এরপর মধ্যাহ্নের বিরতি।
বিরতির পরের অনুষ্ঠানে ছিল প্রাচ্যনাটের গীতিনৃত্যনাট্য আঠারো বছর বয়স-এর পরিবেশনা। এরপর মূল মঞ্চের সামনে খালেদের নির্দেশনায় হয় ফ্ল্যাশমব। মঞ্চে বব ডিলানের পাঁচটি গান গেয়ে শোনান শাহেদ, শর্মী, ওয়ার্দা ও সুহাশ।
এরপর বেলা তিনটায় প্রথম আলো সরাসরি পাঠকদের মুখোমুখি হয়। এ সময় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানসহ বিভিন্ন বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মীরা পাঠকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
বিকেল চারটার দিকে শুরু হয় সাংস্কৃতিক পর্ব। এক এক করে তারকাশিল্পীরা মঞ্চে ওঠেন আর গান গেয়ে শোনান। তাঁদের মধ্যে ছিলেন তপন চৌধুরী, শাফিন আহমেদ, এস আই টুটুল, পিন্টু ঘোষ, মুহিন, রন্টি, সাব্বির, কিশোর, পুলক, সালমা, পারভেজ, কর্নিয়া, ইমরান, সাজেদ ফাতেমী, রাগীব। এর মধ্যে তপন চৌধুরী দুটি ও শাফিন আহমেদ তিনটি এবং অন্যরা একটি করে গান গেয়ে শোনান।
উৎসবে দিনব্যাপী ছিল তারকাদের উপস্থিতি। তারকাদের মধ্যে ছিলেন জুয়েল আইচ, আফজাল হোসেন, আফসানা মিমি, শহীদুজ্জামান সেলিম, কচি খন্দকার, ফারজানা ব্রাউনিয়া, সাজু খাদেম, আর এফ সৈয়দ, অন্তু করিম, নাদিয়া, মাহি, এস এস নাইম, মিশু সাব্বির, আবু হেনা রনি, মৌটুসী বিশ্বাস, আজরা মাহমুদ, রুনা খান, বাঁধন, স্বাগতা, শবনম ফারিয়া, বুলবুল টুম্পা, ধ্রুব গুহ, বেলাল খান, পূজা, জয় শাহরিয়ার, নাবিলা, মারিয়া নূর, সাবিলা নূর ও লেনিন। আরও ছিলেন রন্ধনশিল্পী শাহানা পারভিন, জেবুন্নেছা বেগম, সেলিনা হোসেন, সারা সুবর্ণা, ফাতেমা আজিজ, সেতারা ফেরদৌস বেগম ও আফরোজা নাজনীন।
বিকেল সাড়ে পাঁচটায় আবার দেখানো হয় তথ্যচিত্র অধিনায়ক ও নায়কেরা। সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক মঞ্চে ডেকে নেন শারমিন, আবদুল্লাহ ও সাইফুলকে। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন সংগীত তারকারা। সবাই মিলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের আহ্বান জানান। দিনাত জাহানের কণ্ঠে ‘বন্দে মায়া লাগাইছে পিরিতে শিখাইছে’ গানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় পাঠক উৎসব।