
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক বিশ্বের অন্যতম পর্যটকপ্রিয় শহর। দারুণ গোছানো ও পরিচ্ছন্ন নগরী। মূলত মার্চে দুটো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা পুরস্কার গ্রহণের উদ্দেশ্যেই ব্যাংককে যাওয়া। তবে একটি দিন রেখেছিলাম সাফারি ওয়ার্ল্ড পরিদর্শনের জন্য। যারা সেখানে গেছেন বা যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমার মনে হয়, সত্যিই টাকা উশুল হয়ে যাবে।
১৯৮৮ সালে ব্যাংকক শহরের মিনবুড়ি এলাকার অব্যবহার্য ভূমির সর্বমোট ৪৮০ একর জমি নিয়ে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় বিশ্বের অন্যতম বিনোদনকেন্দ্র সাফারি ওয়ার্ল্ড। এখানে গড়ে তোলা হয়েছে খোলা চিড়িয়াখানা ও পাখির পার্ক।
খুব সকালে হোটেলের নিচে গাড়ি এসে হাজির। বন্ধু ফিরোজ আলমসহ আমাদের পাঁচজনের টিম। আমরা প্যাকেজ নিয়েছি, যার মধ্যে যাতায়াত, সাফারির প্রবেশ ও বিভিন্ন শোর টিকিট, দুপুরের খাবার অন্তর্ভুক্ত ছিল। হোটেল থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। হাতে পেলাম প্রবেশ টিকিট ও শোগুলোর সময়সীমা। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে দেখলাম বহু পর্যটক এসেছেন। এসেছে স্থানীয় স্কুলের খুদে শিক্ষার্থীরা। ওদের সঙ্গে ছবি তুললাম, বাংলাদেশের অপার সৌন্দর্য ও বাংলাদেশে ভ্রমণের কথা বলছিলাম এক শিক্ষকের সঙ্গে, হঠাৎ মনে হলো এখনই তো শুরু হবে ওরাংওটাং শো। মানে বনমানুষের বিশেষ শারীরিক প্রদর্শনী। দিলাম দৌড়।
হাজারখানেক দর্শকের কেউ গ্যালারিতে বসেছেন, আবার কেউ বসার জায়গা খুঁজছেন। আমিও সিটে বসতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাথার ওপর দিয়ে হঠাৎ দ্রুতগতিতে একটি বনমানুষ ঝুলতে ঝুলতে ছুটে গেল মঞ্চে। তার পেছন পেছন একে একে ছুটে গেল আরও চারটি বনমানুষ, শুরু হলো হইহুল্লোড়, সঙ্গে সঙ্গে সাফারি ওয়ার্ল্ডে বিশ মিনিটের হাস্যরসাত্মক ওরাংওটাং শো। এমন দৃশ্যেরই মুখোমুখি হতে হয় ব্যাংককের সাফারি ওয়ার্ল্ডে। প্রশিক্ষিত বনমানুষ গিটার, ড্রাম, বেহালা বাজিয়ে নেচেগেয়ে শুরু করে বিনোদনমূলক বক্সিং খেলা। এতে প্রায় ১ হাজার দর্শক হাসি আনন্দে মেতে থাকেন পুরো ২০ মিনিট। শো শেষে বনমানুষের সঙ্গে শিশু-কিশোরসহ সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত।
এক শো শেষ হলে দর্শক পায়ে হেঁটে চলছে আরেকটি গেম শো দেখতে। এভাবে চলে সি লায়ন শো, ডলফিন শো, কাউবয় শো, এলিফেন্ট শো, বার্ড শো, স্পাই ওয়ার শো। যেখানে দেখা যায় সি লায়ন ও ডলফিনগুলো দর্শকদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে। দেখাচ্ছে নানা শারীরিক কসরত, ডিগবাজি। পুলের এক প্রান্ত থেকে পিঠে মানুষ নিয়ে ছুটে চলেছে অন্য প্রান্তে। সুরের তালে তালে চলছে, কখনো একক আবার কখনোবা দলীয় নৃত্য। হাতিদের ফুটবল খেলা, রংতুলি দিয়ে ছবি আঁকা, পাখিদের গেম শো, কাউবয়দের অস্ত্র হাতে ঘোড়া নিয়ে ছুটে চলা আর মারামারি।
সেই সকালে গেছি, মজার বিষয় হচ্ছে সামান্য ক্লান্তিও অনুভব করিনি। মজার মজার শোগুলো দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে এল। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে এখানে মুসলমানদের নামাজের ঘর রয়েছে।
হঠাৎ মনে হলো প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত আমরা। সবাই ‘জঙ্গল ক্ররস রেস্টুরেন্ট’-এ খাবারের জন্য ঢুকলাম। এখানে সবই ভারতীয় খাবার। বিরিয়ানি, লুচি, তরকারি, কলা, ফিরনিসহ নানা খাবার। আমাদের অভ্যস্ত আর সুস্বাদু খাবার পেয়ে সবাই মজা করে খেলাম। এদিকে সময়ও হয়েছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্পাই ওয়ার শো। স্পাই ওয়ার শো হলো হলিউডের ছবির আদলে বিশেষ অভিনয় পারফরম্যান্স। শোটি শেষে মনে হলো এতক্ষণ বুঝি হলিউডের ভেতরেই ছিলাম। এক কথায় দারুণ উপভোগ্য শো।
বিনোদনের সমস্ত উপকরণের মিলন ঘটানো অপরূপ এ সাফারি ওয়ার্ল্ডে প্রতিদিন ভিড় করছেন কয়েক হাজার দর্শনার্থী।
এক শোর মঞ্চ থেকে বেরিয়ে আরেকটি মঞ্চে যাওয়ার পথে দেখা মিলবে উন্মুক্ত গাছের ডালে বসা ম্যাকাউ পাখির। চাইলে এগুলো হাতে নিয়ে ছবি তোলা, খাবার দেওয়া ও আদর করা যায়।
এ ছাড়াও দেখা মিলবে ওয়ালরাস, পোলার বিয়ার, ফার সিল, বড় বড় অ্যাকুরিয়াম ফিশসহ শত শত প্রজাতির পশুপাখির সঙ্গে। এগুলোর কোনোটি কাচের খাঁচা আবার কোনোটি লোহার খাঁচার ফাঁক গলে চেয়ে রয়েছে বাইরের দিকে। সত্যিই অসাধারণ।
এরপর আমরা ঢু মারি সাফারি পার্কে। এখানে রয়েছে ৮ কিলোমিটার লম্বা সাফারি পার্ক। যা গাড়িতে চড়ে ঘুরে আসতে সময় লাগে ৪৫ মিনিট। এ ছাড়া রয়েছে মেরিন পার্ক, পশুপাখির হাসপাতাল, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পাখির অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচুর পশু এখানে জড়ো করা হয়েছে। এমন কোনো প্রাণী নেই, যা এই সাফারি পার্কে নেই। বাঘ, সিংহ, হরিণ, উট, জিরাফ, জেব্রা, গন্ডার, হাতি, ময়ূরসহ কয়েক শ পশুপাখির অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র এ পার্ক।
গাড়িতে করে এক প্রাণীর আবাসস্থল থেকে আরেক প্রাণীর আবাসস্থলে যাচ্ছি আমরা। প্রাণীদের আবাস এলাকায় পৌঁছুলে অটোমেটিক ইলেকট্রিক্যাল গেইট খুলে যাচ্ছে আর গাড়ির ভেতরে বসেই জঙ্গলের সৌন্দর্য অবলোকন করছি আমরাসহ আগত দর্শনার্থীরা।
গাড়ির খুব কাছাকাছি ঘুরছে পশুপাখিগুলো। দেখে মনে হবে না এই চিড়িয়াখানার পশুগুলো দেখতে এসেছে মানুষ, বরং পশুগুলো দেখছে খাঁচায় বন্দী মানুষকে।
প্রশিক্ষিত কর্মিবাহিনী প্রাণী থেকে শুরু করে বিনোদনের প্রতিটি কাজ সুনিপুণভাবে সম্পাদন করে চলেছে। মাত্র ৩২ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই সাফারি ওয়ার্ল্ড বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে শুধু এর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য।
এদিকে পড়ন্ত বিকেল মনে করিয়ে দিচ্ছে, সময় হয়েছে এখন হোটেলে ফেরার...।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ময়ূরপঙ্খী শিশু-কিশোর সমাজকল্যাণ