মহিষের পাল ঘাস খাচ্ছে। কাছেই দাঁড়িয়ে রাখাল। ভোলার চরে মহিষবাথান টিকিয়ে লাখতে এই রাখালেরাই সব
মহিষের পাল ঘাস খাচ্ছে। কাছেই দাঁড়িয়ে রাখাল। ভোলার চরে মহিষবাথান টিকিয়ে লাখতে এই রাখালেরাই সব

সম্ভাবনার খাত

ভোলার চরে মহিষ পালন

কয়েকটি সমস্যা সমাধান করলে ভোলায় মহিষ পালন একটি লাভজনক খাত হয়ে উঠবে। এখানে পর্যাপ্ত চর থাকার পরও গো-চারণ ভূমির সংকট রয়েছে। কারণ, এসব চর প্রভাবশালী ও বন বিভাগের দখলে। শীতের শেষে লোনাপানি, উচ্চ জোয়ার, আর মহিষগুলোর ইনব্রিডিং সমস্যার সমাধান দরকার।

জোয়ার শেষে ভাটায় টান দিলে আবদুল আজিজ ওরফে কালুমাঝির (৫৪) দুই ছেলে মেঘনা নদীতে মহিষ ভাসিয়ে দেয়। তাঁর ছোট, মাঝারি, বড়—সব মিলিয়ে মহিষ ২২টি। বর্গা পালেন আরও ৪টি। বড় মহিষগুলো মেঘনার ঢেউ উপেক্ষা করে সাঁতরে এগিয়ে চলে চরের অভিমুখে। নদীর মাঝে জেগে ওঠা লেচকি চর (নতুন চর)। শুধু ছোট বাচ্চাগুলোকে নৌকায় তুলে নিয়ে চরে ছেড়ে দিতে হয়। ওরা এখনো ঢেউয়ের প্রতিকূলে সাঁতরাতে শেখেনি।

লেচকি চর ভাটায় জেগে ওঠে, জোয়ারে ডুবে যায়। ভাটার সঙ্গে চরে জেগে ওঠে সবুজ ঘাস। পলিমাখা সে ঘাস খেয়ে পেট ভরে মহিষের। চরে মহিষ তুলে আবদুল আজিজের ছেলেরা নদীতে জাল পাতে। মাছ ধরতে ধরতে আবার জোয়ারে চর ভরে ওঠে কানায় কানায়। তখন হাঁক দিয়ে চর থেকে নদীতে নামিয়ে দেয় মহিষের পাল। সাঁতরে ফিরে আসে ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের নাছিরমাঝি মাছঘাটের দক্ষিণে খালপাড়ে। সেখানে একখণ্ড জমি কিনে ছোট্ট একটি বাথান গড়েছেন আবদুল আজিজ। ছয় মাস ধরে জোয়ার, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে এখানেই থাকে তাঁর মহিষ। শুধু ভাটার সময়ই নদীর মাঝে জেগে ওঠা চরে নামে ঘাস খেতে।

আবদুল আজিজ জানান, তাঁরা মাদি মহিষকে ডাকেন ‘মাদাম’, পুরুষকে ডাকেন ‘চেলা’, বাচ্চাকে ডাকেন ‘গেরা’। পুরুষ গেরাকে ডাকেন ‘চেলা ছাও’, আর মাদি গেরাকে ডাকেন ‘পারি ছাও’। এই জোয়ারের সময়ই তিনি মাদাম মহিষের দুধ দোহান। চিকিৎসাসেবা দেন। এ সময় মহিষ বিশ্রাম নেয়, ঘুমায়। নইলে চরের মহিষের দিন-রাতে ঘুমানোর নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। কারণ, রাতদুপুরে ভাটায় টান দিলে মহিষ চরে নামে ঘাস খেতে। এ নিয়মে অভ্যস্ত মহিষজীবন। ১৭-১৮ নভেম্বর ফজরের আজানের আগে ভাটার টান দেয়। বাধ্য হয়ে ওই অন্ধকার রাতে নদী সাঁতরে চরে ঘাস খেতে যায় মহিষের পাল। ১৯ বছর ধরে মহিষ পালন করছেন আবদুল আজিজ। কখনো এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি।

আবদুল আজিজ আরও বলেন, চরের মহিষ চরের ঘাস ছাড়া অন্য কিছুতে মুখ দেয় না। অনেকবার তোলা খাবার দিয়েছেন, কাজ হয়নি। ছোটবেলা থেকে খামারে রেখে খাদ্যাভ্যাস করালে চরের কাঁচা ঘাস ছাড়া অন্য খৈল-ভুসি, দানাদার খাদ্য খেত কি না, তা জানেন না আবদুল আজিজ। তবে এ অভ্যাসের কারণে ভোলার চরাঞ্চলে মহিষ খাদ্যের ব্যাপক সংকট। এক দিনে একটি পূর্ণবয়স্ক মহিষ ৮ শতাংশ (৪০-৫০ কেজি) জমির ঘাস খেতে পারে। তাহলে তার পেট শান্ত থাকে। ভালো দুধ দেয়। তবে ঘাসের সংকটে মহিষের পেট প্রায়ই আধপেটা থাকে। তখন দুধ কমে যায়। এমনিতে একটি মহিষে দেড়-দু লিটার দুধ হয়, তখন হয় আধা লিটার। তখন চর পাল্টাতে হয়। মহিষের একবার ঘাস খাওয়া হলে আবদুল আজিজ সে চরে সার ছিটিয়ে দেন। আবার যান অন্য চরে। সার ছিটালে ঘাস দ্রুত বড় হয়।

আবদুল আজিজ মনে করেন, মহিষের এ খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন দরকার। দরকার খামারভিত্তিক মহিষ পালন। কিন্তু দেশি জাতের মহিষ দিয়ে সম্ভব না। তাঁর একসময় মহিষের সংখ্যা ছিল শতাধিক। এখন কমে যা ঠেকেছে বাইশে। মেঘনা নদী পার হয়ে মদনপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি)। ট্রলারে নদী পার হলে দেখা যায় শত শত গবাদিপশু। আবদুল আজিজের মতো একাধিক মহিষমালিকের সঙ্গে কথা হয়। মদনপুর ইউপির হিসাবে সেখানে প্রায় ৫০ হাজার গবাদিপশু আছে। মহিষ আছে প্রায় ১৪ হাজার।

মদনপুরের আশপাশে ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর মধ্যে জেগে ওঠা এ রকম প্রায় ৭৫টি চরে ৬ লাখ গবাদিপশু পালিত হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসাবে ভোলায় মহিষ আছে ১ লাখ ২৫ হাজার।

চরগুলোতে গবাদিপশুর মালিক মাত্র ৫-৬ শতাংশ। বাকিরা বর্গা পালনকারী। ধনিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা হেলাল উদ্দিন ও তুলাতুলি বাজার ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান অনেক বছর ধরে গবাদিপশুর মালিক। তাঁদের পশু চরের বর্গাদারের কাছে। তাঁরা গবাদিপশু কিনে পালতে দেন। পালনকারী খাইয়ে বড় করেন। মাঝেমধ্যে পশুর অসুখ-বিসুখ হলে ওষুধের টাকা পাঠান। সাধারণত কোরবানির উপযুক্ত হলে বিক্রি করেন। ক্রয়মূল্য বাদ দিয়ে লাভের অংশ সমান সমান ভাগ করে নেন। জেলায় এমন মালিকই বেশি।

চরের মদনপুরে কয়েকটি মহিষবাথান দেখা যায়। একটি বাথানে একাধিক মালিকের কয়েক শ মহিষ থাকে। এটি ভোলার জনপ্রিয় মহিষ পালন পদ্ধতি। বার্ষিক ১৫ থেকে ৫০ একর নিচু জমি লগ্নি নিয়ে চারণভূমি বানায় মালিকপক্ষ। জমির মালিক যিনিই হোন, চরের প্রভাবশালীরা মহিষমালিকদের থেকে বার্ষিক লগ্নিমূল্য নেন। সেই পানিতে ডুবে থাকা নিচু চরে মাটি ফেলে তৈরি হয় ‘কিল্লা’। বড় বড় বাঁশ পুঁতে, সুপারিগাছের খুঁটি পুঁতে কিল্লার ওপর তোলা হয় বাথানিদের ঘর। নাম তার ‘টংঘর’। যার নিচে মহিষের বাচ্চার বাস, চারদিকে তার ঘের দেওয়া। ওপরে মানুষ। কিল্লার ওপর খোলা আকাশ। আকাশের নিচে কালো কালো মহিষ। এক পাশে চেলা, আরেক পাশে মাদাম। প্রতিদিন সকালে ঘোষ মূল ভূখণ্ড থেকে বাথানে আসে দুধ দোহন করতে। দোহন করে কিনে নেন। তাঁরা সারা বছর একদরেই দুধ কেনেন। কিন্তু ভোলার বাজারে মহিষের দুধের দাম পড়ে না। ১০০-১৫০ টাকা লিটার।

মহিষের রাখালদের স্থানীয় ভাষায় ‘রাখফাল’ বলে। মদনপুর গ্রামের পুবে মো. আলমগীর মহুরীর বাথানে গেলে রাখফাল মো. বশির জানান, ৮০-১০০টি মহিষ দেখাশোনা করেন একজন রাখফাল। তিনি পালন করছেন ১১০টি। মহিষের পালের একটি দলনেতা মহিষ আছে, যাকে বলে ‘চেলামহিষ’। এই চেলামহিষের আলাদা নাম আছে। চিত্রনায়ক-নায়িকা, রাজা-বাদশা-রানি, মন্ত্রী, রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতাদের নামে নাম এসব চেলামহিষের। এসব নাম দেয় রাখফাল নিজেই। কোনো মাদাম মহিষকে দলের প্রধান করা হয় না। চেলামহিষ শুধু রাখফালকে অনুসরণ করে। আর মহিষের পাল অনুসরণ করে চেলামহিষকে। সে যেদিকে ঘুরবে, অন্য মহিষগুলো সেদিকেই যাবে।

মদনপুরে বহুকাল আগে থেকেই আবদুল কাদের ঘোষের বাথানে মহিষ পালন হচ্ছে। সেখানে কথা হয় বাথানের রাখফাল মো. ফয়সালের সঙ্গে। তিনি বলেন, তিনি প্রতিবার ঘাস খাইয়ে মহিষের দলকে কিল্লার ওপর তুলে রাখেন। বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে টংঘরে ওঠার সময় বড় মহিষ, বাচ্চা একনজর গুনে নেন। তারপর বাঁশে কাঁচি দিয়ে দাগ কেটে লিখে রাখেন। প্রতিদিন সকালে ঘোষকে দেওয়া দুধের হিসাবও লিখে রাখেন বাঁশে দাগ কেটে। বাথানে কাগজ-কলমের বালাই নেই। যদি পানিতে কাগজ নষ্ট হয়ে যায় এ ভয়ে!

রাখফাল আরও জানান, বাচ্চাকে সন্ধ্যার আগে একবার পরিমাণমতো দুধ খাইয়ে আটকে রাখা হয় ঘেরের মধ্যে। আবার সকালে দুধ দোহনের পরে আরেকবার খাইয়ে মাদাম-চেলাকে ঘাস খাওয়াতে পাঠান।

আবদুল কাদের ঘোষের ছেলে আবদুল হাইসহ একাধিক মহিষ পালনকারী আক্ষেপ করে বলেন, বহু বছর ধরে তাঁদের মহিষ পালন। লাভ দূরের কথা, পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন মাত্র। প্রভাবশালী ও রাখফালদের হাতে তাঁরা জিম্মি হয়ে তাঁদের মহিষবাথান টিকিয়ে রেখেছেন। একটি মহিষের পেছনে বছরে ৩২ হাজার টাকা খরচ হয়। লাভ বলতে বছর শেষে ওই বাচ্চাটাই সম্পদ। তাকেও টিকিয়ে রাখতে নানা প্রতিকূল সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়।

ভোলার চরের ৫০ জন গবাদিপশুর মালিক, বর্গাদারসহ প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভোলায় মহিষ পালনের ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। তবে কয়েকটি সমস্যা সমাধান করলে মহিষ পালন একটি লাভজনক খাত হয়ে উঠবে। ভোলায় পর্যাপ্ত চর আছে। তারপরেও গো-চারণ ভূমি ও কাঁচা ঘাসের সংকট রয়েছে। কারণ, এসব চর প্রভাবশালী ও বন বিভাগের দখলে। গবাদিপশু চরালেই টাকা দিতে হয়। কারণে-অকারণে অপরিকল্পিত গুচ্ছগ্রাম নির্মিত হচ্ছে। এতে চারণভূমি ও ফসলি জমি নষ্ট করছে।

দ্বিতীয়ত লোনাপানির সমস্যা। শীতের শেষে নদীতে লবণপানি ওঠে। তিন-চার মাস থাকে। মাঝে মাঝে চরে ওঠে লোনাপানি। এ পানি খেয়ে গরু-মহিষের পাতলা পায়খানা, গায়ের পশম ঝরে যাওয়া, উকুনসহ নানা রকম রোগ হচ্ছে। অনেক মহিষ মারা যাচ্ছে। মরা বাছুর প্রসব করছে। এ সময় চরগুলোতে স্বাদু পানির অভাব দেখা দেয়।

আরেক সমস্যা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, উচ্চ জোয়ার। ভোলা একটি উপকূলীয় জেলা। বছরে অমাবস্যা-পূর্ণিমায় মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীতে জোয়ারের উচ্চতা বিপৎসীমা অতিক্রম করে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয়। এ সময় এক চর থেকে আরেক চরে, এক জেলা থেকে অন্য জেলায়, এমনকি লক্ষ্মীপুর-নোয়াখালীতে মহিষ ভেসে যাচ্ছে। এসব মহিষ খুঁজে বের করতে অনেক টাকা খরচ হয়। অনেক সময় টাকা খরচ করেও পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে প্রতিটি চরে সরকারিভাবে নির্মিত পর্যাপ্ত কিল্লা ও চারণভূমি দরকার। স্বাধীনতার পর ভোলার চরে সরকার থেকে যেসব কিল্লা নির্মিত হয়, সেগুলোকে স্থানীয় লোকজন বলেন ‘মুজিবকিল্লা’। তবে বর্তমানে ভোলায় সরকারি কোনো কিল্লা বা চারণভূমি নেই।

চার নম্বর সমস্যা হচ্ছে, চরাঞ্চলে বাথানভিত্তিক যে মহিষগুলো পালন করা হচ্ছে, সে মহিষগুলোর অন্তপ্রজনন (ইনব্রিডিং) সমস্যা রয়েছে। অর্থাৎ বংশপরম্পরায় একই বাথানের একই পরিবারের চেলামহিষ দিয়ে ব্রিডিং হচ্ছে। এতে মহিষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা, দুধ ও মাংস কমে যায়। যে মহিষ ৫-৬ লিটার দুধ দিতে পারে, সেটি দিচ্ছে দেড়-দুই লিটার।

ভোলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ইন্দ্রজিৎ মণ্ডল বলেন, ভোলায় গবাদিপশুর মধ্যে মহিষ আবাদ নিয়ে তাঁরাও চিন্তিত। প্রথমত মহিষের জাতের উন্নয়ন দরকার। যদিও এখন বিভিন্ন প্রকল্প শুরু হয়েছে। নানা গবেষণার পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশ সম্পূর্ণ মুররাহ জাতের বিস্তার করবে। এটি ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে বিস্তার হয়েছে। এর উৎপাদন খুবই ভালো। একটি মুররাহ মহিষ ২০-২২ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়।

ইন্দ্রজিৎ মণ্ডল আরও বলেন, ইউনিয়নে ইউনিয়নে চারণভূমি করা দরকার। ভোলায় ৫০টি মুজিবকিল্লার প্রস্তাব আছে। তিন একর খাসজমির দুই একরে কিল্লা, এক একরে পুকুর। পুকুর থেকে মাটি তোলা হবে। পুকুরের পাড় উঁচু হবে। যাতে লোনাপানি প্রবেশ না করে। সেখানে স্বাদু পানির ব্যবস্থা থাকবে। স্বাদু পানির জন্য ২০টি টিউবওয়েল বসছে, ১০টি সদরে, ১০টি চরফ্যাশন উপজেলায়। যেখানে চৌবাচ্চা হবে, মহিষ এসে সে পানি পান করবে।