
খবরে দেখলাম, করোনা উপসর্গ দেখা দেওয়ায় মাকে বনের মধ্যে রেখে আসছেন সন্তান ও জামাতারা। পরে, প্রশাসন খবর পেয়ে রাতেই ঢাকায় হাসপাতালে পাঠায়।
আজ আরেকটি খবর দেখলাম ভারতের কেরালা রাজ্যের। সেখানে এক বৃদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অবশেষে মুক্তি মিললে বাসায় ফিরিয়ে আনছিলেন সন্তান। যেহেতু লকডাউন চলছে। রাস্তায় যানবাহন শিথিল। তাই বাধ্যতামূলক অটোরিকশা থেকে নামতে হয় তাঁদের। বৃদ্ধ বাবার কষ্ট হবে, তাই বাবাকে কোলে করে এক কিলোমিটার হেঁটে বাসায় নিয়ে আসেন।
কয়েক দিন আগের আরেকটি ঘটনা। এটিও ভারতের এক রাজ্যের। লকডাউনে সন্তান আটকে পড়ায় মায়ের মন আনচান করছিল। অবশেষে, নিজেই টানা তিন দিন স্কুটার চালিয়ে সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। হ্যাঁ, মায়েরাই এমন পারেন।
এ তিনটি ঘটনা এই কয়েক দিনের মধ্যেই ঘটেছে। প্রথমটি অত্যন্ত খারাপ ও কলুষ মনমানসিকতার ঘটনা। অন্য দুটি বীরত্ব, ভালোবাসা, মহানুভবতার।
কিন্তু এই পার্থক্যের আসলে কারণ কী? খুব সহজ উত্তর মিলবে, আমাদের মানসিকতা। মানসিক অবস্থার পার্থক্য ও ভিন্নতা। দেখেন, এমন আরও কিছু ঘটনা এই কয়েক দিনের মধ্যেই ঘটেছে। স্বাস্থ্যসেবা–সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, নার্সদের বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বলছেন কোনো কোনো বাড়ির মালিক। তালতলায় করোনায় মৃত ব্যক্তি দাফনে বাধা কিংবা উত্তরায় করোনা রোগীর চিকিৎসায় বাধাসহ নানা কিছু আমরা দেখেছি। দেখেছি, চীনের আদলে ভাসমান হাসপাতাল তৈরিতে বাধা দিতেও।
এর কারণ কী? একই, হীন মানসিকতা। এই সংখ্যার মানুষ কি আমরা কম? হয়তো কম, হয়তো কম না। এটি বুঝতে হলে একটু ভাবতে হবে। আপনি আজ রাস্তায় কোনো সেবামূলক কাজ করতে চান। অনেকের পরিবারই দেখবেন নিষেধ করবে। আপনার আশপাশে, করোনা রোগী পাওয়া যাক, দেখবেন, একটু ভিন্ন আচরণ অনেকের মাঝেই চলে আসছে।
এ জন্যই অনেকে ট্রল করে, যাঁরা বাসার সামনে ঘুরে বেড়ান, তাঁদের বাসার সামনে করোনা রোগী ছেড়ে দেওয়া হোক। এমনি পালাবে। কেউ আবার বলে, রোগী পেলে মানুষ মেরেই ফেলবে। এর একটা উদাহরণ হতে পারে, মাদারীপুর। করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ফেরার পরও সামাজিকভাবে তাদের কেউ কেউ আড়চোখে তাকাচ্ছিল। হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হয়েছিল। আবার, মালদ্বীপে আটকে থাকা বাঙালি ভাইদের ত্রাণ পাঠানোর জন্য সরকারের সমালোচনা করছি।
সুতরাং, আমরা এখানে এসে একমত হতে পারি, আমরা নিজেরা কখনো কোনো কিছুতে আক্রান্ত হলে, কম পড়লে বা কোনো খারাপ কিছুর আশঙ্কা করলেই, তখন আমাদের আচরণ হয় রূঢ়। তখন আমরা কে ভাই, কে বোন, কে মা, কে বাবা ভুলে যাই। যদিও সবাই না। তবে, কম না।
এর মূল কারণ হতে পারে, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের পড়ালেখা নেই। এ নিয়ে তেমন আলাপ নেই। পাঠ্যবইয়ে এ নিয়ে তেমন পাঠ নেই। সারা বিশ্বে যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এত পড়ালেখা, এত গবেষণা, স্টাডি, বই, সেখানে আমাদের দেশে সাইকোলজি বিষয় অনেকেই পাগলের চিকিৎসাব্যবস্থা মনে করে। এ বিষয়ে সুযোগ পেয়েও পড়তে চায় না, কারণ এর অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক চাহিদা এই দেশে নেই।
অথচ, আমি মনে করি দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্য নামক বা ভিন্ন নামে এ বিষয়ে পাঠ্যবই হওয়া উচিত। অন্তত ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তিন বছর বাধ্যতামূলক পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত মনে করি। প্রতিটি বিদ্যাপীঠে একাধিক মানসিক স্বাস্থ্য–সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ থাকা প্রয়োজন। একজন শিক্ষার্থীর নানা সময়ে মানসিক অসুস্থতা থাকতে পারে, হতাশায় ভুগতে পারে। তার জন্য কাউন্সেলিং জরুরি। একই সঙ্গে ১৫ দিন অন্তর মা–বাবা মিলে কাউন্সেলিং হতে পারে।
তাদের আচরণ কেমন হবে, কখন কীভাবে নিজের ভূমিকা রাখতে হয়, মানসিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা কীভাবে পেতে হয়, এসব দুর্যোগে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা কী এবং এ ক্ষেত্রে ভূমিকা কীভাবে রাখবে, তা নিয়ে কাউন্সেলিং হতে পারে। আমরা বা আমাদের পূর্বে যা হয়নি, যার জন্য এমন করুণ পরিণতি, তা থেকে অন্তত সামনের দিকে মুক্তি মিলতে বা দীর্ঘ সময়ে এর পরিত্রাণ মিলতে এর বিকল্প কিছু হতে পারে মনে হয় না।
আর এ সময়ের জন্য কেবল সচেতনতা। ঘরে আচরণ কী হবে, করোনা উপসর্গ দেখা দিলে নিজের এবং পরিবারের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে প্রতিদিন প্রতিবেদন, পিএসএ, বিজ্ঞাপন, সচেতনতা বাণী প্রচার করা যেতে পারে। নয়তো, এই মায়ের তথ্য তো পাওয়া গেছে। রাতের অন্ধকারে কোনো মায়ের তথ্য পাওয়া না গেলে জাতি হিসেবে এই দায় কেউ এড়াতে পারব না।