
বাসার পাশে ট্রামগুলো চলতে লাগল জনমানবহীন। জানালা দিয়ে মানুষ দেখার আশায় বসে থাকি, কিন্তু রাস্তাঘাট সুনসান। খালি ট্রামের যাওয়া-আসা দেখে মন বিষণ্ণ হয়। পাশের ওল্ডহোমে একই দিনে একসঙ্গে নয়জন বয়সী লোক মারা গেলেন।
একাকিত্বের কবলে যে না পড়েছে, তার পক্ষে বোঝা কঠিন এর ভার কী ভয়াবহ। যে সময় পাশে কাউকে দরকার, তখন প্রবাসে আমাকে কাটাতে হয়েছে একা। চারপাশে অবিশ্বাস্য গতিতে করোনা ছড়িয়ে পড়ায় কী যে অসহায় হয়ে পড়েছিলাম! একদিকে নিজের, অন্যদিকে দেশে সন্তান ও পরিবারের সবার চিন্তা আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল।
জার্মানিতে কোভিড রোগীর প্রথম মৃত্যু ঘটে ৯ মার্চ। ক্রমে বাড়তে থাকে মৃত্যুর সংখ্যা। প্রতিদিন চার-পাঁচ হাজার করে পজিটিভ কেস আসতে শুরু করে। সরকার লকডাউন ঘোষণা করে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে। মাসের শেষে গ্রোসারি, ফার্মেসি ছাড়া সব দোকানপাট বন্ধ করে দিতে হলো। সর্বত্র আতঙ্ক। কিছু কিছু শহরে লোকজন ভয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এতটাই কিনল যে সব খালি হয়ে যাওয়ার জোগাড়। এই হুজুগ এখানে বসবাসরত বিদেশিদের মধ্যেই বেশি। আমি সপ্তাহ দুয়েকের চাল-ডাল-খাবার কিনে রাখলাম, যাতে বারবার বাইরে যেতে না হয়। দোকানে গেলেই মনে হয় শরীরে ভাইরাস নিয়ে ফিরলাম।
বাসার পাশে ট্রামগুলো চলতে লাগল জনমানবহীন। জানালা দিয়ে মানুষ দেখার আশায় বসে থাকি, কিন্তু রাস্তাঘাট সুনসান। খালি ট্রামের যাওয়া-আসা দেখে মন বিষণ্ণ হয়। পাশের ওল্ডহোমে একই দিনে একসঙ্গে নয়জন বয়সী লোক মারা গেলেন। খবরটা আমাকে একদম অন্য রকম করে দিল। খবর দেখা বা পড়া বন্ধ করে দিলাম। এই ফ্ল্যাটে আমি একা মরে থাকলেও তো কেউ দেখার নেই।
ওদিকে নিয়মিত কর্মঘণ্টা সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার জায়গায় ৪ ঘণ্টায় নামিয়ে আনা হলো, সঙ্গে হোম অফিস। ফলে না রইল কাজের চাপ, না বাইরে যাওয়ার অবস্থা। রইল কেবলই করোনার খবর আর মৃত্যুশোক। অবসাদ আর বিষণ্ণতা আরও জেঁকে বসল। কী করব ভেবে ভেবে শেষে বসলাম পেইন্টিং নিয়ে। দেখা গেল, পেইন্টিং করে ঘর ভরে ফেলেছি। এবার নকশিকাঁথা সেলাই আর রান্না। নিজেকে ব্যস্ত না রাখলে তো পাগল হয়ে যাব। একদম একা একটা শহরে, আত্মীয়হীন জীবন আগে কাটাইনি। জার্মানিতে এসেছিলাম একা, পড়তে। চাকরি হওয়ায় থেকে যাওয়া। পড়াশোনা বা কর্মজীবনে প্রতিনিয়ত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ। এমন জনবিচ্ছিন্নতার প্রশ্নই ছিল না।
আমার দুজন জুনিয়র বাঙালি সহকর্মী খোঁজ নিয়েছেন মাঝেমধ্যেই। দোকানে যেতাম টাইম মিলিয়ে একসঙ্গে। তিনজন মানুষ অন্যত্র একত্র হওয়া ছিল নিষিদ্ধ। তাই দোকানই ভরসা। চেনা মানুষের মুখ দেখাও যে বড় একটা ভাগ্যের ব্যাপার, এটা প্রথম বুঝতে পারলাম। আত্মীয়-বন্ধুরা ফোনে ও মেসেঞ্জারে খোঁজ নিয়েছে, কিন্তু কারও সঙ্গে বসে এই অস্থির সময়ে দুই দণ্ড কাটানোর অবস্থা ছিল না। সবাই বলত, একটা মেয়ে হয়ে একা আছ। বুঝিনি, এই বিপর্যয়ে ছেলে আর মেয়ের একা থাকায় কী পার্থক্য!
করোনা বুঝিয়ে দিয়েছে চারপাশে আপনজন থাকা কতটা ভাগ্যের ব্যাপার। শুধু বলব, নিজের ও আপনজনের কাছে থাকুন আর নিজেসহ অন্যদের নিরাপদ রাখুন।
জুন মাস থেকে অফিসে যাওয়া শুরু করতেই মনে হলো, জীবনের একটা বড় অংশ থেকে কত দূরে ছিলাম। করোনা আসলে বুঝিয়ে দিয়েছে, একা একা থাকা যেকোনো মানুষকে কতটা বিষণ্ণ আর অসহায় করে দেয়। মানুষের টিকে থাকার জন্য মানুষের সাহচর্য যে কত জরুরি, এই তিন মাসে প্রতিটি মুহূর্তে সেটা টের পেয়েছি।
জার্মানির অবস্থা এখন অনেক স্বাভাবিক। নতুন করোনা কেসের সংখ্যা দুই থেকে পাঁচ শর মধ্যেই ওঠানামা করে। মৃতের সংখ্যাও অন্য দেশগুলোর তুলনায় কম। কারণ, প্রতিটা মানুষ এখানে নিয়ম মেনে চলেছে, বিভ্রান্তি ছড়ায়নি, চিকিৎসক ও রোগী উভয়েই পরস্পরকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছে এবং কমিউনিটি নিজেদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। এসব কারণে পরিস্থিতি খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণে এসেছে। মানুষও তার সুফল পেয়েছে।